01বাংলাদেশ একটি অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে এখনই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপ শুরু করতে হবে বলে মনে করেন রাজনীতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সমান তালে রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটাতে হবে। শনিবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (বিআইজিডি) পরিচালিত ‘বাংলাদেশের শাসন পরিস্থিতি ২০১৩: গণতন্ত্র দল রাজনীতি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইজিডির গবেষণাপ্রধান মিনহাজ মাহমুদ। তিনি বলেন, প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের বিদ্যমান রীতি-পদ্ধতি ও চর্চা এ দেশে আধুনিক ও সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তীব্র বাধা সৃষ্টি করছে। তাদের আচরণের কারণে অর্জিত সাফল্য বিপরীতমুখী ধারায় পরিচালিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। দেশে গণতন্ত্রকে সুসংহত ও একে আরও বিকশিত করতে সামাজিক সমঝোতা অথবা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। প্রতিবেদনে রাজনৈতিক অনুন্নয়নের কারণ, প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের মাত্রা, রাজনৈতিক সহিংসতা, অর্থ জোগানদাতা বেসরকারি খাতের সঙ্গে দলগুলোর ক্রমবর্ধমান যোগসূত্র, নারীদের অপ্রতুল ও বাঁধাধরা ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়েছে চার গুণ
প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে মিনহাজ বলেন, রাজনৈতিক বিকাশের তিনটি মৌলিক অংশ রাষ্ট্র গঠন, গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জন্মলগ্ন থেকেই প্রধান দুই দলের প্রবল প্রভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে বহুত্ববাদের ধীরগতি। তিনি রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর দলগুলোর প্রভাবকে দলতন্ত্র বলে আখ্যা দেন। মিনহাজ বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের দ্বৈত আচরণ দ্বারা দলতন্ত্র রাজনেতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। এ থেকে উত্তরণে সুপারিশ হলো, নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতায়ন করা। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতা মূলত দলপ্রণোদিত সহিংসতা। বিগত বছরের তুলনায় ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়েছে প্রায় চার গুণ। উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি রাজনীতিঅনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, প্রতিবেদনটি সময়োপযোগী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তাঁরা প্রতিবেদনটির তথ্য অস্বীকার করেননি। এটি একটি ভালো দিক।’ তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য প্রধান দুই জোটকে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। এতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকেও রাখার কথা বলেন। তিনি বলেন, সংলাপ কেবল একটি ইস্যুতে নয়, জাতীয় স্বার্থের সব ইস্যুতেই হতে হবে। সংলাপ বা রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা কী? একজন দর্শকের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে আসতে পারলে তারা আসবে।

দলের ভালো ও যোগ্যদের প্রতিষ্ঠানে বসানো যেতে পারে: কামাল
ড. কামাল বলেন, দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে একটি উপায় খুঁজ বের করতে হবে। শুধু নির্বাচন হলেই হয় না। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর যে প্রত্যাশা ক্ষমতাসীনদের কাছে ছিল, জনগণ তা পায়নি। কিছু অসন্তুষ্টি রয়ে গেছে। বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, দলের ভালো ও যোগ্যদের ভালো জায়গায় ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে বসানো যেতে পারে। এটা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু অযোগ্য ও মেধাহীনদের বসানো হলে সেটা সমস্যা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাম্প্রতিক অবস্থায় হতাশা প্রকাশ করে এ থেকে উত্তরণের জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

ক্ষমতাসীনেরা জাতিকে রক্ষা করেছেন: সুরঞ্জিত
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না হলে আরেকটি এক–এগারো তৈরি হতে পারত। সেটা থেকে ক্ষমতাসীনেরা জাতিকে রক্ষা করেছেন। তিনি বলেন, সংলাপের পরিবেশ তো তৈরি হতে হবে। স্বাধীনতার পক্ষের সঙ্গে পরাধীনতার সংলাপ হতে পারে না। যেমনটা আগুন-পানি আর তেল-জলে মেলে না। তিনি বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এবার নির্বাচনে যাননি। তাই সংসদে যেতে পারেননি। তাতে কী হয়েছে? আগামীতে যাবেন। এ জন্য অবশ্য নতুন করে তাদের রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অপর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘বিএনপির বাইরের একটি দেশের ওহির ওপর নির্ভর করে নির্বাচনে যায়নি। এর দায় আওয়ামী লীগের নয়। নির্বাচনে না আসলে আওয়ামী লীগের কী করার আছে। সংলাপ চাইলে বিএনপিকে পূর্বশর্ত ছাড়া আসতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, দেশের অর্থনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত যেভাবে এগোচ্ছে, রাজনীতিও সেভাবে এগোবে। দলে পরিবারতন্ত্র এটা সময়ের চাহিদার সঙ্গে পরিবর্তন হবে। চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে তা ভালো হবে না।

এখন জরুরি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন: আমীর খসরু
রাজনৈতিক অগ্রগতিতে বাধা দলীয় কর্মকাণ্ডবিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দলের মধ্যে গণতন্ত্র অবশ্যই জরুরি। তবে এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন। কেননা এখন দেশে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার নেই। তিনি বলেন, এতে চরমপন্থী ও মৌলবাদ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ছে। পুলিশ আর প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে সরকার চলছে। প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বিএনপি কার সঙ্গে জোট করবে, সেটা তাদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। এখানে অন্য দলের বলার কিছু নেই।’

রাজনীতিবিদদের ভাষা সুন্দর করতে হবে: অধ্যাপক ইমতিয়াজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নির্বাচনে ত্রুটিগুলো দূর করতে হবে। রাজনীতিবিদদের ভাষা সুন্দর করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাবকে লাভজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি। সুশাসন থাকলে এই লাভ পাওয়া যায় না, ফলে এ দেশের শাসকেরা সুশাসনের থেকে দূরে থাকেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কিছু কিছু জায়গা যেমন খুলনা ও সাতক্ষীরায় চরমপন্থীরা সক্রিয়। যদিও এটা সারা দেশে নয়, তার পরও এটি বড় সমস্যা।

মধ্যবিত্তরা দ্বৈত চরিত্রের কারণে ভূমিকা রাখতে পারছে না: বিনায়ক
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, গণতন্ত্র কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশে রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক শাসন একভাবে চলছে। কিন্তু এখানে অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নও অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, এদেশে একটি মধ্যবিত্ত সমাজ আছে। এর সংখ্যাও বাড়ছে। তবে তাদের দ্বৈত চরিত্রের কারণে আগের মতো সমাজের এই অংশটি ভূমিকা রাখতে পারছে না। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উল্টোপথে যাত্রা করছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক সুলতান হাফিজ রহমান।