গুলশান হামলা বিদেশি সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরাবিদেশি একাধিক চরমপন্থী দলের পরামর্শে দেশীয় তিনটি জঙ্গি সংগঠন গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এমনকি এই হামলার পেছনে বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত কয়েকজন উগ্রপন্থী নেতার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে মনে করা হচ্ছে, দেশে কারাগারে বন্দি জঙ্গি নেতাদের নির্দেশেই এই হামলা চালানো হয়। গুলশান হামলায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ নেতারা ২০১৪ সালে গাজীপুরের কাশিমপুরে হাই সিকিউরিটি কারাগারে এক যৌথ প্ল্যাটফর্ম গঠন করে। গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত করে দেশে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তবে গুলশান হামলার পরই গোয়েন্দারা এই গ্রুপের সক্রিয়তা সম্পর্কে জানতে পারেন। বন্দি জঙ্গি নেতাদের নির্দেশেই এই হামলা চালানো হয় বলেও ধারণা করছেন তদন্তকারীরা।

গুলশান হামলায় নিহত ছয় হামলাকারীর মধ্যে পাঁচজনকে নিজেদের সদস্য বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। পুরো হামলার দায়ও তারা স্বীকার করে। তবে আইনশৃঙ্খরা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি ছিল, এই হামলার পেছনে দায়ী জেএমবি। তবে পরে এটিকে কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠীর যৌথ হামলা হিসেবে চিহ্নিত করেন গোয়েন্দারা।

তদন্ত কর্মকর্তাদের সূত্রে আরও জানা যায়, তাদের সন্দেহ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানভিত্তিক কয়েকটি উগ্রপন্থী সংগঠনও গুলশান হামলাকারীদের সাহায্য করেছে। পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী কয়েকজন জঙ্গিনেতাও এই হামলার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে। পুরো রহস্যের কিনারা এখনও না হলেও তদন্তকারীদের দাবি, তারা কয়েকজন পরিকল্পনাকারী, সমন্বয়কারী ও অন্তত দুইজন অর্থদাতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন।

এখন পর্যন্ত এই হামলার পরিকল্পনায় সহযোগিতাকারীদের মধ্যে যাদের নাম এসেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন- আনসারুল্লাহর নেতা এবং সেনাবাহিনীর পদচ্যুত মেজর সৈয়দ এম জিয়াউল হক ও ইজাজ আহমেদ (তারা দুজনেই বাংলাদেশে আইএসের সমন্বয়কারী হিসেবে পরিচিত), জেএমবির নেতা তেহজিব করিম, আনসারুল্লাহ ও জেএমবি প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা পালনকারী এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউর রাজ্জাক।

গুলশান হামলায় সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করেছেন- জেএমবির শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন ওরফে সালেহিন (২০১৪ সালে তাকে প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা), সোলায়মান এবং রাজিব ওরফে শান্ত ওরফে আদিল। তবে তাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে গোয়েন্দারা কোনও খোঁজ বের করতে পারেননি।

এদিকে আনসারুল্লাহর প্রধান জসিম উদ্দিন রহমানী, জেএমবির সাবেক প্রধান সাইদুর রহমান, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামের প্রধান আবদুর রউফ এবং কারাগারে বন্দি আরও কিছু জঙ্গি নেতা এই হামলায় জড়িত আছেন বলেও সন্দেহ তদন্তকারীদের। গুলশান হামলার পর কাশিমপুর কারাগারে জঙ্গি নেতাদের আলাদা আলাদা সেলে রাখা হয়েছে। জানা গেছে, গুলশান হামলার আগে তারা ঘন ঘন দেখা করতেন। এখন তাদের ২৪ ঘণ্টা নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলেও কারাগার সূত্রে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দ কর্মকর্তারা আরও জানান, জামিনে মুক্ত এবং বিদেশে অবস্থানকারী আরও কয়েকজন জঙ্গি নেতার সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে গুলশান হামলায়। এক কর্মকর্তা জানান, ‘এ রকম জঙ্গি নেতাদের কয়েকজন সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন। তবে এখন পর্যন্ত আমরা দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিদেশি কোনও জঙ্গি সংগঠনের সরাসরি যোগাযোগের ক্লু পাইনি।’

আইসের একটি ভিডিওতে আরও হামলার হুমকি দিতে যাদের দেখা গেছে তারাও আনসারুল্লাহ ও হিজবুত তাহরীরের সদস্য ছিল বলে দাবি গোয়েন্দাদের। তারা দাবি করেন, পাকিস্তানের কোনও সীমান্ত এলাকায় ওই ভিডিও ধারণ করা হয়ে থাকতে পারে। যদিও আইএস দাবি করেছে, ভিডিওটি হয়েছে সিরিয়ার রাকা শহরে।

গুলশান হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হকও। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, গুলশান হামলার পেছনে বিদেশি সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হলেও এই সন্দেহ তারা বাতিল করে দিচ্ছেন না। তবে হামলাকারীদের সবাই যে বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশেই তাদের রিক্রুট করা হয়েছে তা নিশ্চিত।

যৌথ জঙ্গি প্ল্যাটফর্মের পেছনে বিদেশি সংগঠন

গোয়েন্দাদের সন্দেহ, দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে কাজে আগ্রহী করে তোলার ব্যাপারে বিদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলোর সংশ্লিষ্টতা থেকে থাকতে পারে। এমনকি বিদেশি জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের ব্যাপারেও দেশীয় জঙ্গিদের সহযোগিতা দিয়ে থাকতে পারে।

বিদেশি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা, তেহরিক-ই-তালেবান এবং জইশ-ই-মোহাম্মদের মতো সংগঠনের সঙ্গে এবং স্থানীয় জঙ্গিদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়ে থাকতে পারে এমন লোকদের তালিকা করে খুঁজতে শুরু করেছে গোয়েন্দারা। এজন্য নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গোয়েন্দারা গত নভেম্বরে ইদ্রিস শেখ নামের একজনসহ চার জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে। এরমধ্যে পাকিস্তানি হাইকমিশনের কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ইদ্রিসের। ইদ্রিস তার জবানবন্দিতে জানায়, ফারিনা বাংলাদেশে জেএমবির সদস্যদের জঙ্গি তৎপরতা চালানোর ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন। এরপরই পাকিস্তান সরকার ফারিনাকে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। হিযবুত তাহরীর, জেএমবি ও পাকিস্তানভিত্তিক দল জইশ-ই-মোহাম্মদ এই তিন সংগঠনের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি ২০১০ সালেই প্রকাশিত হয়।

দেশি জঙ্গিদের বিদেশি সংশ্লিষ্টতা

বাংলাদেশি যে সব জঙ্গি বিদেশে অবস্থান করছে গুলশান হামলায় তাদের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। জাপান থেকে নিখোঁজ বাংলাদেশি সন্দেহভাজন জঙ্গি মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি ওরফে আবু মুসার সঙ্গে আইএসের রিক্রুটার ও প্রশিক্ষক আমিনুল ইসলাম বেগের যোগাযোগ ছিল বলে জানা গেছে। বেগ গত বছর সে ঢাকায় গ্রেফতার হয়।

তেহজিব করিম নামের একজনকে গোয়েন্দারা সন্দেহের তালিকায় রাখলেও তিন বছর আগে তিনি জামিন নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। তার ভাই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের আইটি প্রকৌশলী রাজিব করিম ‘জেএমবি’ সদস্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি একটি বিমান উড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ২০১১ সালে কারাদণ্ড পান। এই দুই ভাইয়েরই রিসার্চ সেন্টার ফর ইউনিটি ডেভেলপমেন্ট (আরসিইউডি) নামের একটি এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। এনজিওটি’র সঙ্গে জেএমবি, জামায়াতুল মুসলেমিন ও ইয়েমেনভিত্তিক জঙ্গি দল আল কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলার (একিউএপি) সংযোগ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তেহজিব ইয়েমেনে গিয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে একিউএপির প্রধান আনোয়ার আল-আওলাকির যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাব প্রকাশিত ২৬২ জন নিখোঁজের তালিকায় তেহজিবের নাম আছে।

বনানীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউর রাজ্জাক আরসিইউডিরর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন এবং জেএমডিবর কার্যক্রম বিস্তারে সাহায্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি জর্ডানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুসলেমিনের বাংলাদেশ শাখা খোলার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন বলেও জানান গোয়েন্দারা। গোয়েন্দারা জানান, ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যায় আরসিইউডির অন্তত দুই সদস্য জড়িত ছিল।

গুলশান হামলার পেছনে সন্দেহভাজনদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত কানাডীয় নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীর নাম। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, আফগানিস্তানে নিজের লিংক কাজে লাগিয়ে তিনি গুলশান হামলাকারীদের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে থাকতে পারেন। গত এপ্রিলে আইএসের প্রোপাগান্ডা ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ তামিমকে বাংলাদেশে তাদের (আইএসের) প্রধান বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৩ সালে তামিম কানাডা থেকে নিখোঁজ হন এবং তার বর্তমান অবস্থান অজানা। র‌্যাবের নিখোঁজের তালিকায় তার নামও রয়েছে।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন