23-10-16-al-council_pm-2

আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কাউন্সিলরদের নতুন নেতৃত্ব খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি (শেখ হাসিনা) থাকতে থাকতে নতুন নেতৃত্ব আনুন। আমি চাই বেঁচে থাকতেই নতুন নেতা নির্বাচন করে দলকে শক্তিশালী করতে।রোববার সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলের দ্বিতীয় দিনের শুরুতে দেওয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।

অবশ্য শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের জবাবে কাউন্সিলররা না না বলে সমস্বরে চিৎকার করেন।কাউন্সিল অধিবেশনে যোগ দেওয়া দুজন কাউন্সিলর প্রথম আলোকে এ কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, কাউন্সিলররা এবার সভাপতি পদে কোনো পরিবর্তন দেখতে চান না বলে তাঁদের মতামত জানিয়ে দিয়েছেন।কাউন্সিলে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে। এ জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। সারা দেশ ঘুরে মানুষকে আওয়ামী লীগের ভিশন, উন্নয়ন কর্মকান্ড অবহিত করতে হবে। উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আওয়ামী লীগকে তৃতীয় দফা নির্বাচনে জয়ী হতে হবে মন্তব্য নেতাকর্মীদের সেই লক্ষ্যে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে কাউন্সিল অধিবেশনের কাজ শুরু করেন শেখ হাসিনা।

ছয় হাজার ৫৭০ জন কাউন্সিলর এই কাউন্সিলের মাধ্যমে আগামী তিন বছরের জন্য দলের নতুন নেতৃত্ব ঠিক করবেন।টানা দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসা আওয়ামী লীগ সভাপতি কাউন্সিল অধিবেশনের শুরুতেই ২০১৯ সালের পরবর্তী নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত করার ওপর গুরুত্ব দেন।তিনি বলেন, সামনে নির্বাচন। জনগণের কাছে যেতে হবে। তৃতীয় দফা নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে জনগণের দোরগোড়ায় যেতে হবে। উন্নয়নের কথা বলতে হবে।আর সেজন্য গত সাত বছরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশে উন্নয়নের চিত্র মানুষের কাছে তুলে ধরার ওপর জোর দেন শেখ হাসিনা। ব্যাপক প্রচার করতে হবে। জনগণকে বোঝাতে হবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে।

বিগত সময়ে সরকারে থাকা বিএনপির কর্মকান্ডের বিষয়ে সতর্ক করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, যারা মানি লন্ডারিং করে, পুড়িয়ে মানুষ মারে, যুদ্ধাপরাধীদের মদদ দেয়, তারা যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে।ওই লুটেরা দুর্নীতিবাজ, এতিমের টাকা যারা খায়, মানিলন্ডারিং করে, যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে, তারা আসলে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। তারা জনগণের সম্পদ লুটে খাবে। মানুষকে বোঝাতে হবে এরা যদি আবার ক্ষমতায় আসে, তার মানে যুদ্ধাপরাধীরা ক্ষমতায় আসবে, খুনিরা ক্ষমতায় আসবে। এরা ক্ষমতায় আসলে আবার খুনিদের রাজত্ব, দুর্নীতিবাজদের রাজত্ব হবে।

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে তিনি সততা দেখতে চান। আমি চাই, আমি বেঁচে থাকতে থাকতে নেতা নির্বাচন করে দলকে শক্তিশালী করে যাব।এ সময় মিলনায়তনে উপস্থিত কাউন্সিলররা দাঁড়িয়ে সমস্বরে ‘না, না’ বলে ওঠেন।গত ৩৫ বছর ধরে দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসা শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, অবসরে যাওয়ার সুযোগ পেলে তিনি খুশি হবেন। তবে দলীয় নেতারা বলে আসছেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ আমার পরিবার। আওয়ামী লীগ আমার আপনজন। আমার সন্তানদের এতো সময় দেই নাই আওয়ামী লীগকে যত সময় দিয়েছি। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এখানে বসে তালি বাজালে হবে না। আমাদের অর্জনগুলো জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হবে। জনগণকে বার বার বলতে হবে। আমরা এই কাজ আপনাদের জন্য করেছি। আওয়ামী লীগ করেছে।মানুষেকে বোঝাতে হবে, সরকারের উন্নয়নের ধারা ধরে রাখতে হলে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে আরও একবার ক্ষমতায় আসতে হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ তার সুফল পাবে।

দিন বদলের স্বপ্ন দেখিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় ফেরা আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আরও পাঁচ বছরের জন্য দেশ শাসনের দায়িত্ব পায়।আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের পর্যায়ে পৌঁছে দিতে তার সরকারের কর্মসূচি সাজিয়েছেন। শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের ২০তম সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও সরকারের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দলের নেতা-কর্মীদের সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

ক্ষমতাসীন দলটির এবারের সম্মেলনের স্লোগান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার, এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার।কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনা নেতা-কর্মীদের সম্পদের পেছনে না ছুটে জনগণকে ভালোবাসার পাশাপাশি, তাদের কল্যাণের জন্য সত্যিকারের আর্দশের কর্মী হওয়ার আহ্বান জানান।তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাজই হবে প্রচার করা। ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া। তাদের কাছে যাওয়া। তাদের এই কথাটা বোঝানো যে আওয়ামী লীগ থাকলে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। তারা কিছু পাবে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পাবে।অবকাঠামো উন্নয়ন হবে, রাস্তাঘাট উন্নত হবে, পুল-ব্রিজ হবে। ক্ষেতে ফসল উৎপাদন হবে। এই কথাগুলো মানুষের কাছে ভালোভাবে পৌঁছে দেওয়া। আওয়ামী লীগের এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। এ জন্য সংগঠনকে শক্তিশালী করা আর জনগণের দোরগোড়ায় গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো, এটাই আমরা আশা করি।

কাউন্সিলের দ্বিতীয় দিনে আজ দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র সংশোধন অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর নতুন নেতৃত্বের নির্বাচন হবে। আজ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনা সভাপতি হবেন, এটা প্রায় নিশ্চিত। তবে সাধারণ সম্পাদক কে হবেন, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে এখন পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করার ব্যাপারে কেউ আগ্রহের কথা জানাননি। কাউন্সিলে একাধিক ব্যক্তি এই পদ চাইলে ভোট হবে।

আজ সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করছেন শেখ হাসিনা। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতারা অধিবেশনের উপস্থিত রয়েছেন
শেখ হাসিনা নিজের জীবদ্দশায় নতুন নেতৃত্বের হাতে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব দিয়ে যাওয়ার ইচ্ছার কথা বললেও কাউন্সিলররা তাকেই দায়িত্ব চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেছেন।তাদের বক্তব্েযর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার উপদেষ্টা হিসেবে জয় ‘সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাতেই’ রয়েছেন।শনিবার সম্মেলনের উদ্বোধনের পর রোববার সকালে দলীয় সভাপতির বক্তব্েযর মধ্েয দিয়ে শুরু হয় কাউন্সিল অধিবেশন। দুপুরে কাউন্সিলে যোগ দেন সজীব ওয়াজেদ জয়।

কাউন্সিলের এই অধিবেশনেই আগামী তিন বছরের জন্য নতুন নেতৃত্ব বেছে নেবেন আওয়ামী লীগের ৭২টি সাংগঠনিক জেলা থেকে আসা কাউন্সিলররা। শেখ হাসিনা তার প্রারম্ভিক বক্তব্েয নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমি চাই যে আমি জীবিত থাকতে থাকতে নতুন ভাবে নেতা নির্বাচিত করে এই সংগঠনকে আরও গতিশীল করার চেষ্টা করবেন।৩৫ বছর এই দলের সভাপতি। এত লম্বা সময় কেউ কখনো থাকেনি। শেখ হাসিনা এ সময় সবাইকে বসার ইংগিত দেন এবং বলেন, এখনই নির্বাচন হচ্ছে না। ওটা পরে বলেন। কিন্তু এটা করতে হবে। আমার বয়স ৭০ বছর হয়ে গেছে। এটাও মনে রাখতে হবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তাকে দলীয় প্রধান নির্বাচিত করা হয়। ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন তিনি।এরপর গত ৩৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুযারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

বঙ্গবন্ধু বড় মেয়ে বলেন, এই আওয়ামী লীগই আমার পরিবার। আওয়ামী লীগই আমার আপনজন। আওয়ামী লীগকে আমি সবচেয়ে বেশি সময় দেই। আমি নিজের ছেলে-মেয়েকেও এত সময় দেইনি।… আমার বাচ্চাদের আমি স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছি। আপনাদের বেশি সময় দিয়েছি।এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুনভাবে নেতা নির্বাচিত করার’ তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, আমি যেখানে যেভাবে থাকি আওয়ামী লীগ থেকে তো বাইরে থাকব না। আছি আওয়ামী লীগই তো থাকব। কিন্তু আওয়ামী লীগকে আরও সুসংগঠিত করতে হবে। শেখ হাসিনা এ সময় বলেন, জয় সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় আছে। আমার অ্যাডভাইজার।প্রারম্ভিক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা তার নিজের এবং বঙ্গবন্ধুর আরেক মেয়ে শেখ রেহানার ছেলেমেয়েদের কথা তুলে ধরে বলেন, আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের শিখিয়েছি। আমি, রেহানা- আমাদের পাঁচটা ছেলেমেয়ে; আমরা তাদের একটা কথা বলেছি, তোমাদের একটা সম্পদের পিছনে ছুটতে হবে, সেটা হল শিক্ষা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের ছেলে-মেয়েরা কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, পড়ালেখার মধ্েয চাকরিও করেছে। অনেকের সহযোগিতাও তারা পেয়েছে।আরেকটা কথা ওদের বলেছি- তোমরা বঙ্গবন্ধুর নাতি। তোমাদের নিয়ে কখনো কোনোদিন কেউ যেন কিছু বলতে না পারে।… তাদের নিয়ে কখনো কিছু শুনতে হয়নি। তারা দেশের কাজ করছে।

তিন দফা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনা বলেন, তিনি ও তার পরিবার দুর্নীতি করে ভাগ্য গড়ার চেষ্টা করেননি। ছেলেমেয়েরা বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করতে পারায় নিজের স্বস্তির কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “একটা বিষয় আমি নিশ্চিত, তাদের জন্য ধন সম্পদ রেখে যেতে হবে না। তাদের যে বিদ্যা আছে তারা কিছু করে খেতে পারবে।