washikur-babu

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০২এপ্রিল: রাজধানী ঢাকার তেজগাঁওয়ে ধারালো অস্ত্রধারীদের আক্রমণে নিহত ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বিভিন্ন নামে একাধিক ব্লগ সাইটে এবং তার ফেসবুক প্রোফাইলে সমকালীন নানা বিষয়ে তার মতামত লিখতেন। তার লেখালিখির অন্যতম একটি বিষয় ছিলো ইসলাম ধর্মের সমালোচনামূলক প্রসঙ্গ। মুক্তচিন্তা, সাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞান, ধর্মীয় কুসংস্কার বা গোঁড়ামি – ইত্যাদি নানা বিষয়েও লিখতেন। ফেসবুক ও অন্যান্য কিছু বাংলা ব্লগসাইটে তার বিভিন্ন মন্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অন্য আরো অনেকের মধ্যে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হতো।

২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে যুদ্ধাপরাধ, মৌলবাদ, দেশ, রাজনীতি নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেন। লেখাটি দৈনিকবার্তা পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

ওয়াশিকুর রহমান: ২০ নভেম্বর, ২০১৪
না, আর লিখবো না যুদ্ধাপরাধ, মৌলবাদ, দেশ, রাজনীতি নিয়ে৷ এমনিতেও লিখলে কিছুই হয় না শুধু মনের ঝালটা মিটাই৷ কিন্তু তাতেও নাকি অনুভূতি আহত হয়, ‘শান্তি’ বিনষ্ট হয়, উন্নয়ন ব্যাহত হয়৷ তাই এমন কিছু নিয়ে লিখতে হবে যাতে কারওরই সমস্যা না হয়৷

আচ্ছা গাছ-পালা নিয়ে লেখা যাক৷ আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় গাছের পরিমান অনেক কম৷ বিভিন্ন কারণে নিয়মিত বৃক্ষনিধন তো হচ্ছেই৷ গত বছর হেফাজত-শিবির আন্দোলনের নামে প্রচুর গাছ কেটেছিলো৷ সম্ভবত মরুভূমি তাদের পছন্দ বলেই গাছের প্রতি ক্ষোভ৷ তার উপর রামপালে বিদ্যুত; কেন্দ্র নির্মাণ করলে সুন্দরবনের ঝুঁকি……

একি, এসব কী লিখছি! না না এ লেখা চলবে না৷ শান্তি বিনষ্ট হবে, উন্নয়ন ব্যাহত হবে৷ অন্য কিছু নিয়ে লিখতে হবে…

…হুম শিক্ষা নিয়ে লেখা যায়৷ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড৷ প্রতি বছর পাশের হার বাড়ছে কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার কী অবস্থা! ব্যাপক ভাবে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে৷ যেনতেন ভাবে পাশ করাকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মেধা মূল্যায়নের বালাই নেই। দেশে ত্রি-স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত…

…দূর, এ নিয়েও লেখা ঠিক হবে না৷ শিক্ষার হার তর তর করে বাড়ছে। এই অবস্থায় এমন লেখা মানে শিক্ষার উপর আঘাত…

…বরং ভ্রমণ কাহিনি লিখি৷ কয়েক বছর আগে সীতাকুন্ডু গিয়েছিলাম৷ সেখান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো দেখা যায়৷ দেশের আদিবাসীদের উল্লেখযোগ্য অংশই সেখানে বাস করে৷ যদিও সেটেলার আর সেনাবাহিনীর আগ্রাসনে তারা বিপর্যস্ত৷ এ ছাড়াও অনেক আগে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সময় বিশাল এলাকা তলিয়ে গিয়েছিল…

…সর্বনাশ, এ সব লিখলে নির্ঘাত বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রদোহী হয়ে যাব! থাকুক আদিবাসীরা তাদের মতো৷ আমি নিরাপদ কিছু…

…পেয়েছি চলচ্চিত্র৷ আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থা খুবই বেহাল৷ যদিও গুটিকয় মানুষ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তারেক মাসুদ৷ দুর্ভাগ্যবশত তাঁকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি৷ দেশের একটা শ্রেণি তাঁকে পছন্দ করে না৷ কারণ তাঁর চলচ্চিত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি, জঙ্গিবাদ স্থান পেয়েছিল৷ তাঁর পরিচালিত মাটির ময়না ‘কান চলচ্চিত্র উৎসবে’ পুরস্কৃত হলেও তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার প্রথমে মুক্তি দিতে চায়নি ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে৷ পরে…

…অসম্ভব! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে লিখব? বরং…

…প্রেম, হ্যাঁ প্রেম-ভালোবাসা সবচেয়ে নিরাপদ বিষয়৷ কে না আছে জীবনে একবার হলেও প্রেম করে! অনেক ছেলে আছে যারা একের পর এক প্রেম করে৷ কিন্তু প্রতিবারই বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার পরই সম্পর্ক ভেঙে দেয়৷ অনেকে আবার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিয়ো করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়৷ এ সব ক্ষেত্রে শুধু মেয়েদেরই দোষারোপ করা হয়৷ ওই ছেলেগুলো ঠিকই বিয়ের ক্ষেত্রে অক্ষতযোনির মেয়ে খোঁজে৷ কিন্তু ওই মেয়েরা পরবর্তীতে খুব কমই স্বাভাবিক জীবন

…নাহ; নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা এ সব নিয়ে টুঁ শব্দও করা যাবে না৷ সমাজ নষ্ট হয়ে যাবে, ছেলে-মেয়েরা সব উচ্ছন্নে যাবে৷ সমাজ ঠিক থাক আমি…

…নিজেকে নিয়েই কিছু লেখা যাক৷ আমার জন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে৷ মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য সুবিধাবাদিতা, দোদুল্যমানতা, স্বার্থপরতা সবই আমার মধ্যে আছে৷ তবু ভালো নিম্নবিত্ত বা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণিতে জন্মাইনি৷ কৃষকরা পায় না ফসলের ন্যায্য মূল্য, শ্রমিকরা পায় না ন্যায্য মজুরী৷ সবচেয়ে বৃহৎ শিল্প খাত গারমেন্টস শ্রমিকদের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাও নেই৷ কখনও ভবন ধসে, কখনও আগুন লেগে তারা গণহারে মারা যায়৷ তার পর লোক দেখানো উদ্ধার তত্পরতা, নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি, ক্ষতিপূরণের ভুয়ো আশ্বাস, বিচারের নামে অভিযুক্তকে আড়াল করা এগুলো…

…উফ, আমার দ্বারা আসলে লেখা সম্ভব না৷ কি সুন্দর করে তরতর করে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে৷ আর আমি কি না বাগড়া দিতে বসেছি! এ সব তো লেখে ষড়যন্ত্রকারীরা যারা দেশের শিল্প খাত ধ্বংস করতে চায়, কৃষি উন্নয়ন নস্যাৎ করতে চায়৷ বাস্তবতা ছেড়ে না হয়…

…গল্প লিখি৷ এক যে ছিল রাজা৷ এখন তো আর রাজার যুগ নেই৷ সর্বশেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলা মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত ও নির্মম ভাবে নিহত হয়েছিলেন৷ অবশ্য মীরজাফর তার কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করেছিলো অচিরেই৷ কিন্তু মীরজাফরের চেয়ে শতগুণ ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধীরা অনেক বছর এ দেশে শান্তিতে বসবাস করেছে৷ ক্ষমতার স্বাদও নিয়েছে৷ বর্তমানে যদিও তাদের বিচার চলছে কিন্তু ধীর গতির ট্রাইব্যুনাল, যে কোন দিন রায়, সরকারের সাথে আঁতাঁতের অভিযোগ, শাহবাগ আন্দোলন…

…মাথা খারাপ! এসব নিয়ে লিখলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যাহত হবে৷ স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকারের দোসর তিলক পড়বে!

তা হলে কী নিয়ে লিখব আমি! কেউ কি বলতে পারবেন কী নিয়ে লিখতে সরকার, রাজনৈতিক দল, মৌলবাদী, জনগণ, স্বাধীনতা পক্ষ-বিপক্ষ সব গোষ্ঠী শান্ত থাকবে? আছেন কি কেউ বুদ্ধি দেওয়ার মতো?

হ্যালো…