31-07-16-Jamalpur_Flood-1

বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় যশোর জেলার মনিরাপুর, অভয়নগর ও কেশবপুর তিন উপজেলার লাখ লাখ মানুষ গত দু সপ্তারও অধিকসময় চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে। ওই অঞ্চল থেকে দ্রুত পানি নিষ্কাশনে প্রকৃতির সঙ্গে এবং পাশাপাশি রাজ পথে নেমে আন্দোলন সংগ্রাম করছে জলাবদ্ধ মানুষ।বসতঘর, রান্নাঘর ও গোয়ালঘরে কোথাও বুক এবং কোথাও কোমর পানি। তলিয়ে গেছে মৎস্য ঘেরসহ ফসলের ক্ষেত। নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোনসেন্টার। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। স্কুল, কলেজের শ্রেণীকক্ষে কোমর পানি। পানিবন্দি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অনেক আগে এলাকা ছেড়ে দূরে আতœীয়ের বাড়ীতে উঠেছে অনেকে। আর কেউ কেউ বাড়ী ছেড়ে বিভিন্ন আশ্রয়ক্যাম্প, বিদ্যালয় আর উচু রাস্তায় দু’ধারে টোঙ ঘর বেঁধে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু অনেক স্থানে আবার টোঙ ঘরেও পানি উঠছে। দেখা দিয়েছে পানি বাহিত বিভিন্ন রোগ। সুপেয় পানিসহ ভেঙ্গে পড়েছে সেন্টোরী ব্যবস্তা। নোংরা ও বিশাক্ত পরিবেশের মধ্যে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষের চোখের জলের সাথে বন্যার জল একাকার হয়ে গেছে। দুধ নেই উপবাসী মায়ের বুকে, তাইতো ক্ষুধায় ছটপট করছে শিশুরা। চলাচল করতে হচ্ছে ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায়। প্রধান প্রধান সড়ক গুলোর উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় অনেক স্থানে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে গাড়ী চালকরা। পানিতে ভেসে বেড়াছে বিষধর সাপসহ কৃটপতঙ্গ। ইতোমধ্যো জলাবদ্ধাঞ্চলে সর্প দংশনে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সস্তায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ঘরে সংরক্ষিত ধান ও গৃহপালিত হাঁস-মুরগিসহ গরু-বাছুর। সরকারি ভাবে ও বিভিন্ন এজিও প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত যা সাহায্য সহোযোগীতা পেয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। গো খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। মৎস্য খামার, ঘের ও পুকুর ভেসে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে মৎসচাষীদের। মনিরামপুর উপজেলার কামিনীডাঙ্গা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরিচাঁদ রায় বলেন, মানুষের ঘরে যে খাদ্য আছে তাতে তারা আরও কয়েক দিন চলতে পারবে। এইমুহুতে আমাদের ত্রাণ দরকার নেই, পানি সরিয়ে প্রাণ বাঁচার ব্যবস্থা করা হোক।অভয়নগর উপজেলা ডুমুরতলা নামকস্থানে রাস্তার উপর গত এক সপ্তাহ টোঙ ঘর বেধে বসবাস করছে প্রদ্যুৎ বাওয়ালী বললেন, এ এলাকার শতাধিক গ্রামে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে প্রায় ৪০ হাজার মাছের ঘের। হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল এখন পানির তলে। দুই হাজার মানুষের ঘরের মধ্যে পানি প্রবেশ করায় এলাকার মানুষ মানবেতর জীবন-জাপন করছে।রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া কেশবপুর উপজেলার চিনাটোলা গ্রামের রোকেয়া বলেন, বাড়িতে বুক সমান পানি। বাড়িতে টিকতে না পেরে পরিবারসমেত রাস্তায় আশ্রয় নিইছি।

সড়কে আশ্রয় নেওয়া খাদিজা নামে আরেক বয়োবৃদ্ধা বলেন, ছেলে, বউ, নাতি-পুতিসহ ১৮ জনকে নিয়ে রাস্তায় উঠিছি। অভয়নগর উপজেলার বেতভিটা গ্রামের দিপঙ্কর সরকার বলেন, ফসলের মাঠ ও মৎস্য ঘের তলিয়ে আমরা নিঃশেষ প্রায়।

এরআগে কখনো এমন পরিস্থিতি হয়েছে কি-না জানতে চাইলে মনিরামপুর উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপিসদস্য সুধাণ্য বিশ্বাস জানান, ১৯৮৮ সাল ও ২০০৪ সালসহ এই নিয়ে তিনবার তাদের বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। তিনি আরও জানান আমার ইউনিয়নে প্রায় ৫০০শতাধিক পরিবার বিভিন্ন আশ্রয়ক্যাম্প ও রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে কষ্টে থাকলেও সম্মানের দিকে তাকিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিতে পারছেন না।

এত দূঃখ দুর্দশার ভবদহের চারপাশের জলাবদ্ধ মানুষের আঁকুতি, ত্রাণ নয়, পানি সরাও প্রাণ বাঁচাও। এ অঞ্চলকে দূর্গত এলাকা ঘোষণা দিতে জোর দাবী উঠেছে।

উল্লেখ্য, ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০০৬ সালে ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকায় জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের অধীনে নেওয়া হয়েছিল জোয়ারাধার (টিআরএম) প্রকল্প।বর্তমানে কোনো বিলে জোয়ারাধার কার্যকর নেই।বিল কপালিয়ায় প্রস্তাবিত জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।গত বছরের ২৯ জুলাই পরিকল্পনা কমিশন চিঠি দিয়ে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জমে নদীগুলো গতি হারিয়েছে। ভবদহের জলাবদ্ধতা নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিলো, তারপরও এই অবস্থা কেন? এলাকাবাসী বলছে, সরকার আন্তরিক থাকলেও মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির কারণে কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। ফলে আবারও ভবদহে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার একটা বড় অংশ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। এ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী। কিন্তু পলি পড়ে এই নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। নদী দিয়ে বর্ষার পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না।