আসছে বাজেটে সব ধরনের কোম্পানির করপোরেট কর হার কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা করার সুপারিশ করেছেন তাঁরা।রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এফবিসিসিআইয়ের যৌথ পরামর্শক সভায় এসব সুপারিশ জানান তাঁরা।সভায় শুধু মূল্য সংযোজনের ওপরেই কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই। এ ছাড়া বেশ কিছু খাতে রেয়াতি হারে মূসক আরোপের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। আবার যাঁরা নতুন আইনে উপকরণ রেয়াত নিতে পারবেন না; তাঁদের ওপর সাড়ে ৪ শতাংশ হারে মূসক আরোপ করার সুপারিশ করা হয়েছে। ৩৬ লাখ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার লেনদেন পর্যন্ত ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার কর আরোপের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।তবে এ সময় মূসক নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বাহাস হয়।

যৌথ পরামর্শক সভায় উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সভাপতি আবু মোতালেব। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বলেন, ভ্যাট নিয়ে এনবিআর ও এফবিসিসিআই কাজ করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ভ্যাট নিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। শুধু লোক দেখানো প্রশিক্ষণ হয়েছে। প্রশিক্ষণ না দিলে চকবাজারের ব্যবসায়ী কীভাবে জানবে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার কী?। তিনি আরও বলেন, ‘ভ্যাট নিয়ে এফবিসিসিআই যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা আশা করি মেনে নেবেন। তা মানা না হলে আমরা আন্দোলন করব।এ সময় আবু মোতালেবের বক্তব্য থামিয়ে দিয়ে বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী।অর্থমন্ত্রী বলেন, আট লাখ নিবন্ধিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ভ্যাট দেয় ৩২ হাজার। মোতালেবের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কতজন ভ্যাট দেন? আপনারা খামাখা আন্দোলন করছেন। যদি আপনারা আন্দোলন করেন, তবে আমরা তা দমন করব।এ সময় অন্য ব্যবসায়ীরা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে হইচই শুরু করে দেন। অনেকে আন্দোলন দমনের হুমকি দেবেন নাÑএমন কথাও উচ্চকণ্ঠে বলতে থাকেন।সম্মেলনকক্ষে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীদের শান্ত করতে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আশা করি ব্যবসায়ীদের ন্যায্য দাবি মেনে নেবেন। আপনারা ধৈর্য ধরেন। এখনো আমরা বাজেট দেখিনি। জানি না বাজেটে কী আছে।এরপর এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, এই ধরনের পরামর্শক সভায় আন্দোলনের হুমকি দেবেন না। এ ধরনের ফোরামের একটি আলাদা ভাষা আছে।

এরপর পরিস্থিতি শান্ত হয়। এরপর আবারও আলোচনা শুরু হয়। করপোরেট করের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পরামর্শ দেয় এফবিসিসিআই। করপোরেট করের ক্ষেত্রে এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাব হলো, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর হার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ; শেয়ারবাজারে তালিকাবহির্ভূত অন্য উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ (মূসক নিবন্ধনের শর্ত থাকবে) ; অন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩২ শতাংশ কর আরোপ। এ ছাড়া যেসব ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত, তাদের কর হার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর হার কমিয়ে ৪০ শতাংশ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের কর হার ৩৫ শতাংশ করার সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।

আলোচনার এক পর্যায়ে ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের সেক্রেটারি এফবিসিসিআই পরিচালক আবু মোতালেব অভিযোগ করেন, সরকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ না দিয়েই ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে চাইছে।২০১২ সালের এই মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন’কার্যকর করার কথা ছিল গত বছরের ১ জুলাই থেকে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে তা পিছিয়ে দেয় সরকার। তখন বিদ্যমান প্যাকেজ ভ্যাটের হার বাড়িয়ে বলা হয়, ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেওয়া হবে। ব্যবসায়ীরা তা আরও পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে এলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি ওই তারিখ থেকেই নতুন আইন কার্যকরের সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা জানান। আবু মোতালেব বলেন, নতুন ভ্যাট আইনের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের জানাতে এফবিসিসিআই ও এনবিআর কিছু কাজ করলেও তার ফলাফল শূন্য।তারা কিছু লোক দেখানো প্রশিক্ষণ দিয়েছিলৃ চকবাজারের ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ না দিলে তারা কীভাবে জানবে ইলকেট্রনিক ক্যাশ রেজিষ্ট্রার কী?ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের এ নেতা বলেন, এমন অবস্থায় ভ্যাট আইন বস্তবায়নের বিরোধিতা করছি আমরা। এফবিসিসিআই যে প্রস্তাব দিয়েছে তা মানা না হলে হলে আমরা আন্দোলন করব।

অর্থমন্ত্রী ও এনবিআর চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতেই মোতালেব বলেন, “আমাদের স্কুলছাত্রদের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করতে বাধ্য করবেন না। আমাদের দাবি না মানলে আমরা তাই করব।পাঁচ কোটি টাকার কম টার্নওভারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট আইনের আওতায় আনা হলেও আন্দোলনের হুমকি দেন তিনি।এ সময় অর্থমন্ত্রী তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজের মাইক অন করে বলেন, দেশে আট লাখ নিবন্ধিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলেও ভ্যাট দেয় মাত্র ৩২ হাজার।আপনারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা কতজন ভ্যাট দেন? আবার আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন। আপনারা আন্দোলন করলে আমরা তা দমন করব।অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর উপস্থিত ব্যবসায়ী নেতারা উচ্চকন্ঠে প্রতিবাদ শুরু করেন। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, আন্দোলন দমনের হুমকি দেবেন না।এমন পরিস্থিতে এফবিসিসিআইয়ের সহ সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ব্যবসায়ীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন।তিনি বলেন, আপনারা ধৈর্য ধরেন। আশা করি সরকার আমাদের দাবি মেনে নেবে। বাজেটে কী আছে জানি না। এখনো আমরা বাজেট দেখিনি।ব্যবসায়ীদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানও ব্যবসায়ীদের হুমকি না দিয়ে এ ধরনের সভার যথাযথ ভাষা প্রয়োগের আহ্বান জানান।পরে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওই প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আবু মোতালেব, উনি অত্যন্ত বড় বড় থ্রেট দিয়েছেন। একেবারে থ্রেট। দেশটা বন্ধ করে দেবেন- এরকমই বলেছেন।আবার আমারও উত্তেজিত হওয়াটা ঠিক হয় নাই। অতিরিক্ত হয়েছে। এটা আপনারা একটু চিন্তা করবেন। তার থ্রেটটা উইথড্র করা উচিত।

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানের সঞ্চালনায় সভার মূল প্রবন্ধে এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ বলেন, আমরা ভ্যাট আইনের বিপক্ষে নই। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন ভ্যাট আইন সংশোধন করা না হলে তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে বলে আমরা মনে করি।এ সময় তিনি সকল উৎপাদন, ব্যবসা, সেবার ক্ষেত্রে ৩০ লাখ টাকার পরিবর্তে ৩৬ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার করমুক্ত করার প্রস্তাব করেন।এছাড়া ব্যবসায়ী পর্যায়ে বার্ষিক আয় ৩৬ লাখ টাকার বেশি হলে দুই শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের সুপারিশ করেন তিনি।মোবাইল অপারেটরটের সমিতি অ্যামটব এর সভাপতি নূরুল কবির মোবাইল সিম ও ইন্টারনেটের ওপর কর প্রত্যাহারের দাবি জানান।উইম্যান চেম্বারের সভাপতি সেলিমা আহমাদ সকল ধরনের কর সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে রাখার প্রস্তাব করেন। সেইসঙ্গে আগামী বাজেটেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার উদ্যোক্তা তহবিল বহাল রাখার সুপারিশ করেন।