MAL20150512181005

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২২ মে: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মানবপাচারের জমজমাট ব্যবসার’ খবর যখন বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, ঠিক তখন থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে আধুনিক এই দাস ব্যবসার সঙ্গে প্রায় পুরো থাই সমাজের জড়িয়ে থাকার রোমহর্ষক তথ্য তুলে এনেছেন বিবিসির এক সাংবাদিক।গত মাসের শেষ দিকে আন্দামান সাগরে থাইল্যান্ডের একটি দ্বীপে পাচারের শিকার মানুষের গণকবরের সন্ধান পাওয়ার খবর যখন বাতাসে ভাসছে, তখন একদল থাই স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে ওই এলাকায় যান বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিবেদক জোনাথন হেড।পাচারকারীরা কীভাবে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, ভাগ্য বদলের আশায় কাঠের নৌকায় সাগরে ভাসা মানুষকে জিম্মি করে কীভাবে তারা মুক্তিপণ আদায় করছে, এবং থাই প্রশাসন কীভাবে তাতে সহযোগিতা দিচ্ছে তার বিস্তারিত উঠে এসেছে শুক্রবার বিবিসিতে প্রকাশিত হেডের প্রতিবেদনে।থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের ওই দ্বীপে পৌঁছানোর আগেই জায়গাটি মানবপাচারের আস্তানা হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার খবর হেডের কানে আসে। আর যে জায়গায় গণকবর পাওয়া গেছে, সে স্থানটি পাচারকারীরা ব্যবহার করছিল অবৈধ অভিবাসীদের সাময়িকভাবে রাখার ক্যাম্প হিসাবে। সময় সুযোগ মতো সেখান থেকে তাদের পাঠানো হত দক্ষিণে, মালয়েশিয়ার সীমান্তের দিকে।

হেডের সঙ্গে থাকা স্বেচ্ছাসেবীরা জলাকাদার মধ্যে গভীর করে মাটি খুঁড়ে প্রথমে এক টুকরো হাড়ের সন্ধান পান। এরপর পাওয়া যায় ভেজা কাপড়, যার মধ্যে পাওয়া যায় হলদে হয়ে আসা এক নারীর কঙ্কাল। হেড লিখেছেন, তিনি কে ছিলেন, কীভাবে তার মৃত্যু হল তা আমরা হয়তো আর জানতে পারব না। তবে এটা প্রায় নিশ্চিত, তিনি পাচারের শিকার হাজারো মানুষের একজন ছিলেন।সাগরপথে কঠিন এক যাত্রার পর তিনি হয়তো বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে এসে পৌঁছেছিলেন। মালয়েশিয়ায় একটু ভাল জীবন পাওয়ার আশায় তার পরের পথটুকু হয়তো আরও অনেক বেশি দুর্বিষহ হত। হেড লিখেছেন, গত অক্টোবরে ঠিক প্রায় ওই এলাকাতেই ছিলেন তিনি।তাকুয়া পা জেলার কর্মকর্তারা এক দল অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে শুনে আমরা ব্যাংকক থেকে ছুটে গিয়েছিলাম। স্থানীয় কমিউনিটি হলে আমরা মারাত্মক বিপর্যস্ত ৮১ জন পুরুষকে পেলাম; তারা কাঁদছিলেন এবং প্রার্থনা করছিলেন।মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পালিয়ে সেখানে যাচ্ছে- এমন খবর প্রচলিত থাকলেও জোনাথন হেড যাদের দেখা পেলেন তারা ছিলেন বাংলাদেশি।তারা আমাদের বলেন, তাদেরকে জোর করে নৌকায় তুলে এখানে আনা হয়েছে।

জঙ্গলের যে জায়গাটায় নারীর কঙ্কাল পাওয়া যায়, তার কাছাকাছি ওই জায়গায় হেডকে নিয়ে যান জেলার প্রধান মনিত পিয়ানথং। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ওই মানুষদের মারধর করা হয় এবং বেশ কয়েকদিন ধরে তারা অভুক্ত রয়েছে। জোনাথন হেড বলেন, মনিত আমাদের বলেন, নৌকা থেকে অভিবাসীদের ট্রাকে স্থানান্তরের জায়গা হিসেবে তার জেলাটিকে দীর্ঘদিন ধরে পাচারকারীরা ব্যবহার করছে। তিনি এটাকে বন্ধ করতে চাইলেও কেন্দ্রীয় সরকার বা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে তেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন না। বেশ কয়েকদিন ধরে আমি দেখলাম, তিনি ক্ষুব্ধ সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের ফোন ধরায় ব্যস্ত ছিলেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার জন্য তারা তাকে ধমকাচ্ছিল। একইসঙ্গে মনিত বাংলাদেশিদের অভিবাসন হেফাজত কেন্দ্রে পাঠাচ্ছে দাবি করে তাকে বকছিল।এখানে পাঠানো অভিবাসীদের অনেককেই যে পাচারকারীদের কাছে বেচে দেওয়া হয়- তা মোটমুটি ‘ওপেন সিক্রেট’।অস্থায়ী ওই ক্যাম্পগুলির সন্ধানে মনিত নিজের কর্মীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ব্যবহার করতেন। ট্রাকবোঝাই অভিবাসীদের থামাতে তিনি দক্ষিণমুখী প্রধান সড়কে ২৪ ঘণ্টা পাহারা বসান। এমনকি, জেলেদেরও তিনি বলে রাখেন, যাতে তারা কোনো নৌকা আসতে দেখলেই তাকে খবর দেন।বিবিসির এই সাংবাদিকের পর্যবেক্ষণ, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাড়তে থাকা বাংলাদেশিদের আগমন প্রমাণ করে যে আদম ব্যবসা বিস্তৃত হচ্ছে এবং আশ্চর্যের কিছু নেই যে, এটা অত্যন্ত মুনাফাযোগ্য ব্যবসা।

জোনাথন হেড লিখেছেন, রাবার গাছগুলোর নিচে ছিল হাঁস ফাঁস করা গরম। পাহাড়ে উঠতে আমার যখন দম ফুরিয়ে আসছিল, তখন উজ্জ্বল কমলা রঙয়ের শার্ট পরা এক যুবক আমার সামনে চলে এল। সামনে দৃশ্যমান কোনো পথ ছিল না। যুবকটি থেমে তাড়াতাড়ি কথা বলতে শুরু করলো।ওই যুবক বললো, ছয় মাস আগে আরো ৬০০ জনের সঙ্গে তাকেও সেখানে আনা হয়। ছাদবিহীন অবস্থায় কীভাবে ঘুমাতো- তা বুঝাতে সে ঝরা পাতা ও পোকামাকড়ের উপর শুয়ে পড়লো।সখানে একটা তাবুতে তাদের এনে রাখে পাচারকারীরা। অর্থের জন্য তাদের বাবা-মার কাছে ফোন করতে বাধ্য করে তারা। টাকা দিতে না পারলে তাদের পেটানো হয়।কিছু দূরে ইঙ্গিত করে যুবকটি দেখালো, ওখানে এক নারীকে ধর্ষণ করতে দেখেছে তারা। পাচারের শিকার এসব মানুষের মৃত্যু হলে ট্রাকে করে তাদের লাশ সরিয়ে নেওয়া হতো।

হেড বলেন, এটাই ছিল বিজনেস মডেল। থাই পাচারকারী চক্র অভিবাসীদের নৌকায় বোঝাই করে আনতো। থাই পুলিশসহ বেশ কয়েকটি সূত্র আমাদের বলেছে, ৩০০ মানুষের একটা নৌকার জন্য তারা ২০ হাজার ডলার বা তার বেশি অর্থ আদায় করে। পরিবারের কাছ থেকে এই মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অভিবাসীদের জঙ্গলে আটকে রাখা হয়।মালয়েশিয়াতে স্বল্প মজুরির কাজের জন্য এসব মানুষের কাছ থেকে তারা জনপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার ডলার করে আদায় করে।থাইল্যান্ডের গ্রামবাসীর সামনে পাচারকারীরা কীভাবে এই ব্যবসা চালাচ্ছে তারও অনুসন্ধান চালিয়েছেন জোনাথন হেড।আমি যে ক্যাম্পটি দেখলাম তার থেকে হাত ইয়াই শহর গাড়িতে মাত্র ৩০ মিনিটের পথ। তারা স্থানীয় লোকদেরও এই পাচার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করেছে।ওই ক্যাম্পের কাছেই একটি গ্রামের লোকরা কীভাবে পাচার ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, বয় নামে গ্রামের এক মুসলিম যুবকের কথায় তাও তুলে ধরেছেন হেড। ছেলেটি বলল, কয়েক বছর আগে পাখি শিকার করতে এসে এই ক্যাম্প অতিক্রম করার সময় সে দেখে, শিশুসহ অভিবাসীদের পেটানো হচ্ছে। এর পর থেকে সে একাই পলাতক অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়া শুরু করে।বয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে হেড বলেন, পুরো গ্রামবাসী এর সঙ্গে যুক্ত; শুধু অর্থের জন্য। পাচারকারীরা সবাইকে ভাড়া করে। ক্যাম্পের উপর নজরদারির জন্য ও রোহিঙ্গাদের খাবার সরবাহের জন্য তারা লোক ভাড়া করে। লোক ভাড়া করতে তারা গ্রামের সব ঘরে ঘরে যেতো।

ওই অঞ্চলের প্রধান উৎপাদিত পণ্য রাবারের দাম পড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনের মোক্ষম বিকল্প হিসেবে গ্রামবাসীরা এই কাজ বেছে নেয়। ছেলেটি আমাকে বলেছে, প্রণোদনা হিসেবে যুবকদের মধ্যে মাদকও সরবরাহ করা হতো। অভিবাসীরা পালালেও সহজেই ধরা পড়তো এবং ক্যাম্পের প্রহরীরা তাদের নৃশংসভাবে পেটাতো।বিবিসির সাংবাদিক লিখেছেন, থাই কর্মকর্তাদের সায় না থাকলে এই ঘটনাগুলি অসম্ভব হলেও এর সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের সম্পৃক্ততা কতটুকু- তা পরিষ্কার নয়। তবে এখানে অবশ্যই অনেক উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তার হাত রয়েছে।গত বছরের শেষ দিকে, আদম ব্যবসা সম্পর্কে ভাল জানে এরকম একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে ‘ব্রিফিং’ করে। মালয়েশিয়ার সীমান্তে হাজারখানেক মানুষকে রাখা যায় এরকম একটা বড় ক্যাম্পের কথা তিনি আমাকে জানান। ওটা বন্ধ করা হয়নি কেন- হেডের এই টওশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা হেসে বলেছিল, তুমি জান, সীমান্ত হলো সামরিক এলাকা। সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আমার করার কিছুই নেই।ওটা বন্ধ করার অনুমতি কখনোই পাননি ওই পুলিশ কর্মকর্তা।তাহলে মানবপাচার বন্ধের প্রতিশ্র“তি দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গত বছর ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল প্রায়োথ চান-ওচার কাছে যাননি কেন? উত্তরে পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য, আমি যদি চেষ্টা করতাম, দেখা যেত আমি তার সঙ্গে দেখা করার আগেই পাচারকারীরা জেনে ফেলে দ্রুত ক্যাম্প সরিয়ে ফেলতো।

ওই কর্মকর্তা বলেন, নীরবে দেখে যাওয়া ছাড়া তার কিছুই করার নেই। ছয় মাস পর ওই ক্যাম্পে ২৬টি মৃতদেহের প্রথম একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পরও তিনি নির্বিকারভাবে পর্যবেক্ষণ করেই যাচ্ছিলেন।হেড বলেন, কে যে জড়িত এবং কে নয় তা বের করা কঠিন কাজ।এই ব্যবসা বন্ধে স্থানীয় এক পুলিশ প্রধান নিজের প্রচেষ্টার কথা শোনালেন আমাদের । আরও ঘুরে দেখার জন্য তিনি তার নৌকাটা আমাদের দিতে চেয়েছিলেন। পরদিন আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া সামরিক বাহিনীর দলটি জানালো, ওই পুলিশ কর্মকর্তাই নাকি পাচারের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত।কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওই সেনা কর্মকর্তাদের নিয়েও সন্দেহ তৈরি হলো। অভিবাসীদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে মনে হয় এমন একটি গ্রামের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে তারা আমাদের নামতে দিল না।

পাচারের সঙ্গে জড়িত বহুল পরিচিত রাজ্য রানোংয়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিষয়ে তদন্তের কাগজপত্রও একজন কর্মকর্তা তাদের দেখিয়েছেন বলেন জানান হেড।তার কাছে চক্রের সঙ্গে যুক্তদের নাম, ফোন নম্বর ও প্রমাণ ছিল। তিনি বলেন, এসব তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। তা থেকে পরিষ্কার ইঙ্গিত মেলে যে, সরকার এ বিষয়ে কিছুই করেনি। ওই কর্মকর্তাকেও বদলি করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন বলেন, দেখ, সেখানে ওই ক্যাম্পগুলি যে রয়েছে তা সবাই জানে। ব্যাপারটা এটা নয় যে ওই সব ক্যাম্পের আশপাশের এলাকার গ্রামবাসীরাই কাজ করছে বা নজরদারি চালাচ্ছে।

এগুলো থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার সীমান্ত এলাকা, যেগুলো সামরিক এলাকার আওতাভুক্ত। আর সেসব এলাকায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী আছে। ‘প্যাকেটের’ বিনিময়ে অনুমতি নেওয়া ছাড়া কারও পক্ষে এই রকম আকারের ক্যাম্পগুলি পরিচালনা করা সম্ভবই না।দক্ষিণ থাইল্যান্ডে পাচারকারীদের কর্মকাণ্ডের স্থানগুলোর প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি। তাকুয়া পা জেলায় অভিবাসী হিসেবে মনে করা হচ্ছে এমন এক নারীর কঙ্কাল যেখানে পাওয়া গেছে, তার অদূরেই একটি জায়গা থেকে একদল বাংলাদেশি অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে থাইল্যান্ড সরকার।

গত ১৪ মে মালয়েশীয় দ্বীপ কো লিপের কাছে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের জলসীমায় আটকা পড়া নৌযানের হদিস পায় বিবিসি, যার খবর দেয় স্থানীয় জেলেরা। পরে ওই নৌযানটি ইন্দোনেশিয়ায় ভিড়ে।হাত ইয়াই শহর থেকে আধঘণ্টার দূরত্বে স্থানীয়দের সহায়তায় পাচারকারীদের ব্যবহৃত আরেকটি ক্যাম্পের হদিস পায় বিবিসি।হেড লিখেছেন, “অন্য একটি সরকারি হলে দুদিন আগে উদ্ধারকৃত একদল রোহিঙ্গাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। তাদের প্রহরীদের পাশেই থানার সেলের মধ্যে আটক রাখা হয়েছে। তাদের হোতাদের বের করতে পুলিশ প্রধান তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন এবং তাদের মোবাইল ফোনগুলো তল্লাশি চালাচ্ছিলেন। হেড জানান, পরিবারের পক্ষ থেকে দালালদের মুক্তিপণ দিতে পারার বিষয়ে চিন্তিত কিনা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার কাছে তিনি জানতে চাইলে তাদের প্রায় সবাই নিজেদের হাত তুলে ‘হ্যাঁ’সূচক জবাব দেন।ফিল রবার্টসন বলেন, আমাদের বিশ্বাস, এই চক্রের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে আরও শীর্ষ পর্যায়ের মানুষরা এখনো আড়ালে রয়েছে। তাদের সামনে আনতে হবে। এখনও আরও অনেক কিছু করার আছে, আরো অনেক কিছু উন্মোচনের বাকি আছে।

এদিকে, মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড যাওয়ার প্রলোভনে পড়ে গত ১০ বছরে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর হাজারেরও বেশি মানুষ মানবপাচারের শিকার হয়েছে। দালালদের দাবি করা মুক্তিপণ দিয়েও স্বজনদের ফিরে পাননি অনেকে। পাচারকারীদের নির্যাতনে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। এদিকে, স্থানীয় ৩৪ জন দালালের তালিকা তৈরি করলেও এ পর্যন্ত মাত্র ৫ জনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ।আমাদের সংবাদদাতা জানিয়েছেন, ৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে ঘরের ছাদে উঠে শিশুসন্তান রবিউলকে কোলে নিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার আজমত ফকির। ২৪ বছর পর পাচারকারী চক্রের খপ্পরে সেই সন্তানকে হারিয়ে এখন অবিরাম চোখের পানি ফেলেন বাবা। রবিউলের মতো গত এক দশকে এ উপজেলার হাজারেরও বেশি মানুষকে এখান থেকে এভাবে পাচার করা হয়েছে। স্বচ্ছলতার স্বপ্ন আর বেশি বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দালালরা মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছে।পাচার হলেও প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা কেউ কেউ বলেন, মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ট্রলার ছাড়লেও কিছুদূর গিয়েই দালালরা তাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। সহায়-সম্বল বেঁচে দালালদের দাবি করা মুক্তিপণ শোধ করেন স্বজনরা। তারপরও ফিরে আসতে পারেন না অনেকে। দালালদের নির্যাতনে ট্রলারেই কারো কারো মৃত্যু হয়।মানবপাচারকারী এই দালালরা রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলেই উল্টো হুমিক দেয়।এ পর্যন্ত মানবপাচারের ৩টি মামলায় ৩৪ দালালের তালিকা করেছে পুলিশ। এরমধ্যে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করলেও অভিযুক্ত কারও নাম ঐ তালিকায় নেই। এদিকে, জড়িতরা প্রভাবশালী হলেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না দাবি করছে পুলিশ। মানবপাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপে থাকা মিয়ানমারের নৌবাহিনী সাগরে ভাসমান দুটি নৌকা থেকে ২০৮ জনকে উদ্ধারের খবর দিয়েছে।

দেশটির রাখাইন রাজ্যের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তিং মুয়াং সোয়ে দাবি করেছেন, নৌকা দুটির আরোহীদের মধ্যে প্রায় দুইশ ‘বাঙ্গালি’ রয়েছে।থাইল্যান্ডের পত্রিকা ব্যাংকক পোস্ট একটি সংবাদ মাধ্যমের বরাত দিয়ে শুক্রবার দুপুরে এ খবর দিয়েছে।সাগরপথে মানবপাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গত প্রায় এক মাস ধরে তুমুল আলোচনার প্রেক্ষাপটে এই প্রথম মিয়ানমার উপকূলে অবৈধ অভিবাসীদের উদ্ধারের কোনো ঘটনা ঘটল।ব্যাংকক পোস্ট লিখেছে, বৃহস্পতিবার নৌবাহিনীর একটি টহল জাহাজ সাগরে পাচারকারীদের নৌকাদুটির সন্ধান পায়। মিয়ানমারে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার রোহিঙ্গারা গত কয়েক বছর ধরে বাঁচার আশায় সাগর পাড়ি দিয়ে আশেপাশের দেশ, বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টায় আছেন। আর বাংলাদেশ থেকেও নৌকা বা মাছ ধরার ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টার ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।গতমাসের শেষে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাচারকারীদের পরিত্যক্ত এক ক্যাম্পে অভিবাসীদের গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।

এরই মধ্যে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচারকারীদের কয়েকটি নৌকা থেকে তিন হাজারের বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ উদ্বেগ জানালে এই বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাগর থেকে উদ্ধার করে আপাতত আশ্রয় ও নিজেদের দেশের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সম্মত হয় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ ও তাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য মিয়ানমারের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চাপ থাকলেও সাম্প্রতিক মানবপাচারের ঘটনায় রোহিঙ্গা সঙ্কট নতুন মাত্রা পায়। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পাচারের শিকার মানুষদের সাহায্য করতে রাজি হওয়ায় মিয়ানমার সরকারও সুর বদলাতে থাকে। তবে দেশটির দাবি, পাচারের শিকার হয়ে যারা নৌকায় করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছেছে, তারা রোহিঙ্গা নয়। মিয়ানমারের জেনারেল মিন অং হ্লিং বৃহস্পতিবার বলেন, এই অবৈধ অভিবাসীদের অনেকেই বাংলাদেশি। জাতিসংঘের সাহায্য পাওয়ার আশায় তারা নিজেদের মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বলে দাবি করেছে।তবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, মানবপাচারের শিকার হয়ে এখন আন্দামান সাগরে আটকেপড়া মানুষদের অধিকাংশই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা।তিনি বলেন, আমাদের দেশের ইয়ং ছেলেপেলেরা কাজের জন্য ভাগ্যান্বেষণে যেতে পারে, কিন্তু এই যে মহিলা ও বাচ্চা-বৃদ্ধরা গিয়েছে, তাদের বেশভূষা দেখবেন, তা দেখলে স্পষ্ট হয় বেশিরভাগ রোহিঙ্গা।পাচারের শিকার হয়ে আন্দামান সাগরে ভাসমান প্রায় ৭ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের নির্দেশে নৌবাহিনীর ৪টি জাহাজ পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া। সাগরে ভাসমান হাজার হাজার অভিবাসন প্রত্যাশীদের উদ্ধারের প্রথম আনুষ্ঠানিক তৎপরতা এটি।এদিকে, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে বৈঠকে মানবপাচার রোধে জলসীমায় টহল জোরদার করার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার। সেইসঙ্গে ২৯ মে ব্যাংককে থাই সরকারের ডাকা বৈঠকে যোগ দিতেও রাজি হয়েছে দেশটি।সাগরে তল্লাশি চালিয়ে আশ্রয় প্রত্যাশীদের খুঁজে বের করা এবং উদ্ধারে সহযোগিতার ব্যাপারে এরইমধ্যে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর প্রধানের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

সমুদ্রপথে মানবপাচার বন্ধে মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিদোতে বৃহস্পতিবার বৈঠক করেন ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।পরে এক বিবৃতিতে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মানবপাচার রোধে জলসীমায় টহল জোরদার করবে মিয়ানমার। সেইসঙ্গে সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার আচেহ-তে উদ্ধার হওয়া মিয়ানমারের অভিবাসীদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে জাকার্তায় নিযুক্ত দেশটির দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পাঠানো হবে।সমুদ্রপথে মানবপাচার ঠেকাতে আগামী ২৯ মে ব্যাংককে থাই সরকারের ডাকা বৈঠকে যোগ দিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। অভিবাসন সঙ্কটের দায় নিতে এর আগে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল দেশটির সরকার।এদিকে,রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বৃহস্পতিবার এক প্রস্তাবে, মানবপাচারকারীদের চিহ্নিত করতে থাইল্যান্ড সরকারকে তদন্তের আহ্বানও জানান ইইউ নেতারা।

অন্যদিকে, নিজ জলসীমায় মালয়েশিয়াগামী ২ শতাধিক অভিবাসন প্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে মিয়ানমার। বৃহস্পতিবার দেশটির নৌবাহিনীর জাহাজ তাদের উদ্ধার করে।উদ্ধার হওয়া সবাই বাংলাদেশি বলে দাবি করছে মিয়ানমার। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার নৌবাহিনীর জাহাজ সাগর পরিদর্শনের সময় দু’টি নৌযান দেখতে পায়। এর একটিতে প্রায় ২০০ জন অভিবাসন প্রত্যাশী ছিল।এদিকে, একইদিন ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে বৈঠকে মানবপাচার রোধে জলসীমায় টহল জোরদার করার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার।