মোহাম্মদ ওমর কোমলমতি বালক থেকে বোমা বিশেষজ্ঞ
অন্য আট-দশজন কিশোরের মতোই স্বাভাবিক দিনমান যাচ্ছিল গ্রেড-১০ এর শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ওমরের। একেবারে অল্প বয়স থেকেই নিজের রাজধানীর উত্তরার বাসার কাছে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতে থাকে সে। কিন্তু এক বয়স্ক মানুষের সংস্পর্শে পাল্টে গেল তার সব কিছু। নামাজ আদায়কালে অন্যদের চেয়ে ওই বয়স্ক লোকটি অনেক বেশি সময় মসজিদে থাকতেন। তিনি ওমরের সঙ্গে পরিচিত হলেন। তারপর বালক ওমরকে ইসলামের কিছু ‘শিক্ষা’ দিতে থাকলেন। এভাবে হতে থাকলেন ওমরের ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর।

একদিন সেই বয়স্ক লোকটি ওমরকে ‘জিহাদ’ সম্পর্কে বলতে শুরু করলো। এভাবে ২০০৫ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় একবছর তার মগজে ঢোকাতে থাকলেন মৌলবাদী চিন্তাভাবনা। ওই বয়স্ক লোকের ‘দীক্ষা’ পেয়ে ওমর এক পর্যায়ে ‘ইসলামের জন্য’ নিজের জীবন দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। কিন্তু কেউ বলার ছিলো না, ধর্ম সম্পর্কে কী ভুল শিক্ষাটা দেওয়া হলো তাকে। কোমলমতি নামাজি বালক থেকে ওমর হয়ে গেল নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদের (হুজি) বোমা বিশেষজ্ঞ। তারপর ২০১৪ সালের অক্টোবরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গ্রেফতার হয়ে যায় সে।

গ্রেফতারের পর জানা যায়, ফয়জুল ও রবি ছদ্মনামে ফতুল্লায় হুজির বোমা তৈরির কারখানার প্রধান হিসেবে কাজ করছিলো ওমর। গুড়িয়ে দেওয়া হয় সে কারখানা। ওই সময় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হুজি সদস্য রফিক আহমেদ ওরফে সাজিদ, নাদিম আহমেদ ওরফে সুমন এবং সালাহউদ্দিন আহমেদ নামে তিনজনকে ঢাকার উত্তরা ও টিকাটুলি এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সময় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি বিভাগে স্নাতকোত্তর করছিলেন ২৫ বছর বয়সী ওমর। সেসময় ওই তিন হুজি সদস্যসহ তাকে সংবাদ সম্মেলনে আনা হলে ‍তার ফাঁকে একটি সংবাদমাধ্যমকে ওমর জানান বিস্তারিত। তুলে ধরেন, কীভাবে তার মগজে মৌলবাদী চিন্তাভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

ওমর বলেন, মসজিদে ওই বয়স্ক লোকের দীক্ষায় আমি জিহাদে আগ্রহী হই। একসময় আমি ইসলামের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত হয়ে যাই। ওমরের মগজে কথিত জিহাদের সেই চিন্তাভাবনা ঢোকান হুজির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অন্যতম মাওলানা আবু সায়ীদ ওরফে ডা. জাফর। পরে তদন্তে উঠে আসে এই জাফর হুজির আরেক শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের সঙ্গে মিলে ২০০৪ সালের ২১ আগসট আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলা, তার আগে ২০০১ সালে রমনার বটমূলে, ২০০১ সালে পল্টনে সিপিবির সমাবেশ এবং ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানোর মূল ছক কষেন।

ওমর জানান, ২০০৬ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের সেই মসজিদে তার মগজধোলাই করতে থাকেন জাফর। কিন্তু তিনি গ্রেফতার হলে কী হবে? দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দি ‘ধর্মীয় নেতা’ জাফরের সঙ্গে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে দেখা করতে থাকেন ওমর।

জঙ্গি নেতা জাফরের সঙ্গে দেখা করতে কোনো সমস্যা হতো কিনা- জানতে চাইলে ওমর হেসে উঠে বলেন, ‘এটা কোনো ব্যাপারই না। জেলের স্টাফদের ৫০০ থেকে ১০০০ ‍টাকা দিলেই তারা যে কারও সঙ্গে একঘণ্টার জন্য আপনাকে দেখা করতে দেবে।’ জাফর কারাগার থেকেও ওমরকে ফোন করতেন। কীভাবে জাফর কারাগারে ফোন পেলেন, জানতে চাইলে ওমর আবারও হেসে দিয়ে বলেন, ‘টাকা দিলে কারারক্ষীরাই হাতে ফোন তুলে দেবে।’ ‘অবশ্য কখনো এটা অর্থের ব্যাপার থাকে না। কিছু কারা কর্মকর্তা হয়তো জাফরের সংস্পর্শে এসে জঙ্গিদের মতাদর্শে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।’

২০১৩ সালের ৬ মে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উচ্ছেদ করে দিলে ওমরকে বিস্ফোরক বানানোর নির্দেশ দেন জাফর। কারাগার থেকেই তাকে জাফর জানান, নারায়ণগঞ্জের রফিক আহমেদ ওরফে সাজিদ বোমা বানাতে তাকে জায়গা করে দেবেন এবং কেমিক্যালের যোগান দেবেন। রফিক ছিলেন উত্তরার একটি মাদরাসার শিক্ষার্থী। ওই মাদরাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন জাফর। তার নির্দেশনা মতোই ওমরকে সব রকম সহযোগিতা করলেন রফিক। ওমর বলেন, নির্দেশনা মতো আমি বোমা বানাতে শুরু করলাম। প্রক্রিয়াটি আমি ইউটিউব থেকে শিখতে থাকলাম। এর খরচ ছিলো দেড় থেকে ২ লাখ টাকা। আর এর অর্থ যোগান দিয়েছেন রফিক।

ওই অর্থের উৎস জানতে চাইলে কিছু বলতে পারেননি ওমর। পরে দু’জনের সঙ্গে কথা বললে জানা যায় কীভাবে ভয়াবহ আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো হুজি। ওমর বলেন, আমি বোমা বানাচ্ছিলাম গণজাগরণ মঞ্চে বিস্ফোরণ ঘট‍ানোর জন্য। ওই মঞ্চ গড়ে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ দণ্ড দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা সর্বস্তরের জনতাকে সঙ্গে নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু মঞ্চের সংগঠকদের সেসময় নাস্তিক আখ্যা দিয়ে অপপ্রচার চালানো হতে থাকে। এ কারণে কওমী মাদরাসা-ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে রাস্তায়ও নামে।

ওমর বলেন, প্রত্যেকটা বোমা ৬-৮ মিটার রেডিয়াসের মধ্যে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম ছিলো। আর রফিক জানান, ২০১৩-১৪ সময়ে চার হুজি সদস্য পাকিস্তানে গিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ওপর এক মাসের প্রশিক্ষণ নেয়। তবে তাদের নাম জানেন না বলে দাবি করেন তিনি। এমনকি কারা তাদের প্রশিক্ষণ দেয় এবং কোথা থেকে তাদের পাকিস্তান যাতায়াতের খরচ আসে তাও বলতে পারেন না বলে জানান রফিক। তদন্ত অনুযায়ী, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়্যবা, হিজবুল মুজাহিদিন ও হরকাতুল মুজাহিদিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো জাফরের। কেবল তা-ই নয়, একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, তার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার এক দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থারও কিছুটা যোগাযোগ রয়েছে।

ওমরের তথ্য মতে, আফগান যুদ্ধফেরত ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি ডা. জাফর কারাগারে থেকেই তার অনুসারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একটি বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার সন্তান ওমর গ্রেফতার হওয়ার পর দাবি করেন, তিনি বুঝতে পেরেছেন যা তাকে শেখানো হয়েছিল তা ভুল ছিল, সে কারণেই তিনি এসব তথ্য সবার সামনে বলছেন। ওমর বলেন, কারাগারেও বদলায় না জঙ্গিরা। সেজন্য মাদকাসক্তদের জন্য যেমন পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে, তেমনি জঙ্গিদের জন্যও পুনর্বাসন কেন্দ্র দরকার বলে পরামর্শ দেন তিনি।