01দৈনিকবার্তা ডেস্ক ২০ ডিসেম্বর শনিবার: নিজের বক্তব্যকে ‘ঐতিহাসিক’ সত্য দাবি করে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই কথাবার্তায় শালীন হওয়ার পরামর্শ দিলেন তারেক রহমান। শনিবার বিএনপির লন্ডন প্রবাসী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক দীর্ঘ বিবৃতিতে এ পরামর্শ দেন। উল্লেখ্য, সম্প্রতি লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে তারেক রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজাকার’ বলে অভিহিত করেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ‘জানোয়ার’ বলে সম্বোধন করেন। একই সঙ্গে তারেককে সামলানোর জন্য খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।

তারেক রহমানের বিবৃতিটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:

আমি ২০১৪ সালে আমার বেশ কয়েকটি বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইপত্র এবং দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও জার্নালের রেফারেন্স তুলে ধরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভূমিকা তুলে ধরেছিলাম। সেইসব বক্তৃতায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ভূমিকাও আমার বক্তৃতায় উঠে এসেছে। তবে আমি যা বলেছি, এর কোন কথাই আমার মনগড়া কিংবা বানোয়াট ছিল না। পাশাপাশি আমি আমার প্রতিটি বক্তব্যেই বলেছিলাম, আমার কোন বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হলে এবং এর বিপরীতে দলিল প্রমাণসহ প্রকৃত তথ্য উপস্থাপিত হলে আমি আমার বক্তব্য শুধরে নিতে কোন দ্বিধা করবো না।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, আমার বক্তব্যের কোন অংশটি ভুল কিংবা অপ্রাসঙ্গিক এসবের কোন যুক্তিসংঙ্গত ব্যাখ্যা না দিয়েই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দলের কতিপয় নেতা আমার উপর অশালীন বাক্যবাণে হামলে পড়েছে।

আমার বিরুদ্ধে ক্রমাগত অশ্লীল ও অশোভন উক্তি করেছে। এরপরও কারো বিরুদ্ধে কোন কটূক্তি না করে আমি এক বক্তব্যে হযরত আলী (রা.) এর একটি বাণী উদ্ধৃত করে বলেছিলাম, ‘যুক্তিবুদ্ধিহীনরাই অশ্লীল কথা বলে’।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দীর্ঘসময় রাষ্ট্রপরিচালনা করেছে। বাংলাদেশের জনগণ সাক্ষী, বিএনপি কখনোই কোন প্রতিহিংসার আশ্রয় নেয়নি। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়নি। ক্ষমতায় গিয়ে নিজেরমত ইতিহাস বিনির্মাণের চেষ্টা করেনি। এমনকি আদালতের আশ্রয় নিয়ে ইতিহাসের সত্য মিথ্যা নিরূপণেরও চেষ্টা করেনি। কিন্তু এর বিপরীতে আমরা দেখেছি এবং দেখছি, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তারা ইতিহাস পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আদালতের আশ্রয় নিয়ে জনগণের উপর ইতিহাস চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে।

এমনকি আমরা দেখেছি, স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট
জিয়াউর রহমানের নাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ মাওলানা ভাসানীর নাম। আপনারা জানেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো সিটি প্রশাসন ‘জিয়াউর রহমান ওয়ে’ নামে একটি সড়কের নামকরণ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জিয়াউর রহমানের নামে নামকরণ মেনে নিতে পারছে না বলে মনে হয়। এই নামকরণ বাতিলের জন্য এখন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আপনারা পত্রপত্রিকায় দেখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসকেও এই অপতৎপরতার সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। আমি মনে করি, প্রশাসনকে ব্যবহার করে এই ধরনের প্রতিহিংসামূলক অপতৎপরতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এটি দেশ ও জনগণের জন্য কোন সম্মান বয়ে আনতে পারে না। এটি রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার ও সংস্কৃতি বিরোধী বলেও আমি মনে করি।

আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই আমার পিতা বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সম্পর্কে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়। যদিও ওইসব জঘন্য অপপ্রচারের কোনটির সমর্থনে কখনোই তারা কোন দলিল প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইপত্র, দলিল দস্তাবেজ এবং দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার উদ্ধৃতি তুলে ধরে ১৯৭১ সাল এবং এর আগে ও পরে শেখ মুজিবের ভূমিকা সম্পর্কে ইতিহাসের কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছিলাম। আমার প্রতিটি বক্তব্য মন্তব্যের সমর্থনে আমি যথাযথ প্রমাণও হাজির করেছিলাম। কিন্তু যুক্তি ও তথ্যপ্রমাণসহ আমার উপস্থাপিত সব তথ্যই আওয়ামী লীগের চোখে ‘অপপ্রচার’ বলে গণ্য হচ্ছে।

পত্রপত্রিকায় দেখেছি, আওয়ামী লীগ তাদের ভাষায় এই ‘অপপ্রচার’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। আমার আহ্বান, আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, এইসব বন্ধ হওয়া দরকার। তাহলে অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার বন্ধের কাজটি আওয়ামী লীগেরই শুরু করা দরকার। কারন তারাই অপপ্রচারের কাজটি আগে শুরু করেছিল। আমরাতো আওয়ামী লীগের অপপ্রচারের জবাবে ইতিহাসের কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছিলাম মাত্র।

আরেকটি কথা বলতে চাই, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সবসময়ই আমার মা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যিনি বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, তিন তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তার সম্পর্কে প্রায়শই অশোভন মন্তব্য করেন। নানারকম কটূক্তি করেন। একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা যখন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে পাকিস্তানী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তখন আমরা ছোট্ট দুইভাই মায়ের আশ্রয়ে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে। কিন্তু আমরা দেখছি, খোদ শেখ হাসিনা এবং তার দলের কতিপয় নেতারা এ সম্পর্কে নির্দ্বিধায় অশালীন অরুচিকর মন্তব্য করে।

তবে আমি কিংবা আমার দলের নেতাকর্মীরা কখনো কি প্রশ্ন করেছি, ওই সময়টিতে শেখ হাসিনা কোথায় ছিলেন? কাদের আশ্রয়ে ছিলেন? মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এত নিরাপদে কেমন করে তার সন্তানের জন্ম হয়েছিল? মুক্তিযোদ্ধাদের যখন পাকিস্তানী হায়েনারা নির্মমভাবে হত্যা করছিল তখন শেখ হাসিনাকে তারা কেন এত সহায়তা করেছিল? কারা করেছিল? কেন করেছিল? আমার দলের কোন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কখনোই এইসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু শেখ হাসিনা এবং তার দলের কতিপয় নেতারা কি এর মর্যাদা রেখেছেন?

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় সময়ই বেফাঁস মন্তব্য করেন। আমার সম্পর্কে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক মন্তব্য কোন সুস্থতার পরিচয় বহন করে না। আমার জীবন যাপন সম্পর্কে শেখ হাসিনা না জেনেই বিভিন্ন সময় নানারকম মন্তব্য করেন। এটি তার স্বভাবজাত ভেবে আমার মা কিংবা আমাদের পরিবার সবসময়ই তার এইসব নোংরামীর জবাব দেয়া থেকে সচেতনভাবেই বিরত থেকেছি। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আমার দলের নেতাকর্মীরা যদি বিদেশে শেখ হাসিনার সন্তানের যাবতীয় অনৈতিক জীবনাচার এবং অপকর্মের তথ্য প্রমাণ হাজির করে এবং শেখ হাসিনা যেইসব শব্দ ব্যবহার করেন যেমন ‘জানোয়ার’ ‘শকুন’, তার পুত্র সম্পর্কেও যদি এইসব ভাষা প্রয়োগ করা হয়, তখন তার কাছে কি ভালো লাগবে?

আমি বিশ্বাস করি, রাজনীতি হওয়া উচিৎ দেশ এবং জনগণের উন্নয়নের জন্য। কিন্তু দেখা যায়, শেখ হাসিনা সেটি না করে বরাবরই তার রাজনৈতিক শক্তি ও সমর্থনকে ব্যক্তিগত রেষারেষি এবং প্রতিহিংসায় পরিণত করতে চান।

পরিশেষে শেখ হাসিনার প্রতি আমি আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, ইতিহাসকে আপন গতিতে চলতে দিন। নিজের স্বার্থে সেটিকে বাধাগ্রস্ত করবেন না। ইতিহাসকে আদালতের কাঠগগড়ায় তুলবেন না। আমরা মনে করি, ইতিহাসবিদদের নির্মোহ তথ্য উপাত্তে কালের পরিক্রমায় প্রকৃত সত্য নিয়ে ইতিহাস আপন আলোয় উদ্ভাসিত হবে।

আমি আশা করি, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ভাষা ব্যবহারে যত্নশীল থাকবেন এবং নিজ দলের নেতাদেরকেও অপপ্রচার থেকে বিরত রাখবেন। তাহলে আর কাউকে শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের নেতাদের অপপ্রচারের জবাব দিতে হবে না।