সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমার জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলের’ কাছে রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দফায় দফায় বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দ শোনা গেছে। এর মধ্যে অন্তত চারটি বিস্ফোরণ খুবই শক্তিশালী। এদিকে, অভিযানের ব্যাপারে বিকেল পাঁচটার দিকে পাঠানপাড়া জামে মসজিদের কাছে ব্রিফিং করা হয়। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকার ‘আতিয়া মহল’ এর জঙ্গি আস্তানায় ক্লোরোফর্ম গ্যাস ছুড়ছে যৌথ বাহিনী। বাড়িটির ভেতরে থাকা জঙ্গিদের অজ্ঞান করে গ্রেফতার করতে এ কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে অভিযান পরিচালনাকারীদের সূত্র। রোববার (২৬ মার্চ) বিকেল সোয়া চারটায় গ্যাস ছুড়তে শুরু করেন পুলিশের সোয়াট ও সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোরা।

অভিযানস্থলের বাইরে ৩০০ গজ উত্তরের রাস্তায় শনিবার দু’দফা ওই বিস্ফোরণে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন, আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন সাংবাদিক, পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যসহ ৩২ জন।নিহতদের মধ্যে আছেন- জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও আদালত পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়সার। তারা দু’জনই পুলিশের বোমা নিস্ক্রিয়কারী দলের সদস্য ছিলেন বলে জানান জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন। অপর নিহতরা হলেন- দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাত্রলীগের উপ পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল ফাহিম, মহানগর ছাত্রলীগ নেতা ওয়াহিদুল ইসলাম অপু, নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা ডেকোরেটর ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম ও খাদিম শাহ।

ধারনা করা হচ্ছে এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হতে যাচ্ছে আতিয়ামহলে জঙ্গি বিরোধী অভিযান। যৌথবাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিদের গুলি বিনিময়ের শব্দ সবশেষ শোনা যায় বিকেল সোয়া ৪টায়। এরপরই বাড়িটিতে ক্লোরোফর্ম গ্যাস ব্যবহারের সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়। অপারেশন টোয়ালাইট শনিবার সকালে শুরু হয়েছে। যা এই ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে সমাপ্ত হতে পারে বলেও ধারনা করা হয়েছে।শনিবার সকালে অভিযান শুরু করে বিকেল নাগাদ ওই বাড়িতে জিম্মি হয়ে থাকা ২৮ পরিবারের ৭৮জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় সেনাবাহিনী। নিহত হয় ৬ জন । পরে শুরু হয় গুলি বিনিময়। যা রাতেও চলতে থাকে। রোববার সকাল থেকেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বেশ কয়েক দফায় থেমে থেমে গুলি বিনিময় চলে জঙ্গিদের। জঙ্গিরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়তে থাকে। ভোর থেকে সকাল সোয়া ৮টা পর্যন্ত থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। সে সময় থেকে এবং পরে কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে সকাল ১০টায় ওই ভবনের ভেতর থেকে বোমা ছোড়ে জঙ্গিরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওই ভবনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। বেশ কিছুক্ষণ চলে জঙ্গিদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি বিনিময়।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সকাল নয়টা ৫৭ মিনিট, সকাল ১০টা ৭ মিনিট, বেলা ১১টা ৪৩ মিনিট ও বেলা দুইটা ৪১ মিনিটে শক্তিশালী চারটি বোমার বিস্ফোরণ হয় আতিয়া মহল ও আশপাশে; এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ বিস্ফোরণটি ছিল খুবই শক্তিশালী। বিস্ফোরণের পর গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিকেল ৩টা ১৫ মিনিট থেকে অনেকগুলো গুলির শব্দ শোনা যায়।১১টা ৪৩ মিনিটের বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলের কাছাকাছি এলাকায় থাকা পুলিশের এক সদস্য বলেন, বিস্ফোরণের পর আতিয়া মহলের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে ভবনটি কিছুটা হেলে পড়েছে। শনিবার রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত দক্ষিণ সুরমার হুমায়ূন রশীদ চত্বর, সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক, পাড়াইরচক থেকে পীর হবিবুর রহমান চত্বর পর্যন্ত সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও দলবদ্ধভাবে চলাফেরা না করার আদেশ জারি করা হয়েছে।সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুসা জানান, উদ্ধার করা ৭৮ জনকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।অভিযানের বিষয়ে ব্রিফিং করার তথ্য নিশ্চিত করেছেন জেদান আল মুসা। ১২টা ২৭ থেকে গোলাগুলি বন্ধ ছিল, পরে ১টা ১৫ মিনিটে একটি হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর ২টা ১০ মিনিটে আবারও গুলিবর্ষণ শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী। এ সময় ফের বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়।এভাবে গুলি বিনিময় ও বোমা বিস্ফোরণ চলার পর বিকেল সোয়া চারটায় থেমে যায়। সে সময় থেকে আতিয়া মহলের ভেতরে ক্লোরোফর্ম গ্যাস ছুড়ছেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা।শুক্রবার (২৪ মার্চ) ভোরে অভিযান শুরুর পর থেকে অভিযানস্থল এবং এর আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। বিস্ফোরণস্থল পুরোপুরি কর্ডন করে রেখেছেন সেনাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। শনিবার (২৫ মার্চ) রাতের বোমা বিস্ফোরণস্থল ফিতা টানিয়ে সুরক্ষিত করে রেখেছে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। ওই বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, গুরুতর আহত ২ জনকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।আহতদের মধ্যে রয়েছেন- স্থানীয় একটি দৈনিকের সাংবাদিক আজমল হোসেন (৩০), দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি হারুনুর রশিদ এবং উৎসুক জনতার মধ্যে রিমন, নাজিম, রাসেল, ওহেদুল, ইসলাম আহমেদ, নুরুল আলম, বিপ্লব, হোসেন আবদুর রহিম, ফখরউদ্দিন, মামুন, রহীম, মোস্তাক, ফারুক মিয়া, সালাহউদ্দীনসহ ও কয়েকজন পথচারী।

বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) গভীর রাতে দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে ওই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর তা ঘিরে ফেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর প্রায় ৩০ ঘণ্টা সেখানে পাহারা বসিয়ে শনিবার সকাল ৮টা ২৮ মিনিটে লে. কর্নেল ইমরুল কায়েসের নেতৃত্বে পুলিশ ও সোয়াট বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান শুরু করেন সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোরা। বাড়িটিতে জিম্মি দশায় থাকা ৭৮ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদে রাখা হয়েছে।১৭ পদাতিক ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান শনিবার সন্ধ্যায় ব্রিফিংয়ে জানান, তারা ভালো আছেন, সুস্থ আছেন।পুলিশের ধারণা, মর্জিনা নামে কোড ব্যবহার করে ওই বাড়িটিতে অবস্থান নিয়েছেন জঙ্গিরা। ভেতরে নব্য জেএমবি নেতা মুছা থাকতে পারেন বলেও ধারণা করছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।