হাওরে বন্যার অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মিল মালিকরা। মজুদ পর্যাপ্ত থাকলেও দুর্যোগের কথা বলে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করছে তারা। ফলে খুচরা বাজারে কেজিতে বেড়েছে ৫-৭ টাকা।সম্প্রতি দেশের হাওরাঞ্চলে অসময়ের বন্যায় ডুবে যায় কয়েক লাখ হেক্টর জমির বোরো ধান। এই বিপর্যয়ে পোয়াবারো চাল ব্যবসায়ীদের। গুদামে চালের তেমন ঘাটতি না থাকলেও সৃষ্টি করছে কৃত্রিম সংকট।রাজধানীর পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। খুচরা বাজারে তা আরও বেশি।ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ কমের অজুহাতে বেশি দাম নিচ্ছে মিল মালিকরা।উত্তরাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গুমামে চাল আটকে রেখে নেয়া হচ্ছে বাড়তি দাম।তবে অভিযোগ অস্বীকার করছেন চালকল মালিকরা।সারা দেশে মোটা চালের বড় অংশ যোগান দেয় হাওরাঞ্চল। আর মাঝারি ও চিকন চাল আসে উত্তরাঞ্চল থেকে।চালের দাম আরেক দফা বেড়েছে। এখন বাজারে গেলে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেশি দিতে হবে। ফলে বেড়ে গেছে নিত্যদিনের বাজার খরচ, কষ্টে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

রাজধানীর খুচরা বাজারে এখন মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪২-৪৩ টাকা। কিছুদিন আগেও যা কেজিতে দুই টাকা কম ছিল। মাঝারি মানের চালের দামও উঠেছে ৪৬-৪৮ টাকায়। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে। এ দুই ধরনের চালের দাম কেজিতে তিন টাকা বেড়েছে।ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছরের এ সময়ে নতুন বোরো মৌসুমের চালের সরবরাহ শুরু হয়। তবে এ বছর শীত বিলম্বিত হওয়া এবং চলতি মাসে হঠাৎ অতিবৃষ্টির কারণে ধান উঠতে দেরি হচ্ছে। এ ছাড়া ভারতীয় চালের আমদানি প্রায় বন্ধ। আবার হাওর এলাকায় ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে আগামী দিনে চালের সরবরাহ কিছু কম হওয়ার তথ্যের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও বাজারে পড়েছে। সব মিলিয়ে চালের বাজারে টান পড়েছে বলেই দাম এত চড়ে গেছে । মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এক বস্তা চাল কিনে রিকশায় ওঠাচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। তিনি বললেন, এক বস্তা মিনিকেট চালে এখন বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে ৩০০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের দোকানগুলো কিছুদিন আগেও চালের বস্তায় ভরা ছিল। এখন বেশির ভাগ দোকানই ফাঁকা। কারণ হিসেবে আল্লাহর দান স্টোরের নাজের আহমেদ তালুকদার বলেন, চালের বাজারে টান পড়েছে। দাম বেড়ে গেছে। তাই দোকান ফাঁকা।পুরান ঢাকার বাবুবাজার-বাদামতলীর চালের আড়তের শিল্পী রাইস এজেন্সির মালিক কাওসার রহমান দীর্ঘদিন ধরে চালের ব্যবসা করেন। পুরো পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখেন। তিনি বললেন, এপ্রিলের শেষ দিকে ২৫ শতাংশ চালের সরবরাহ আসে নতুন মৌসুমের চাল থেকে। এ বছর সেটা আসছে না। কারণ, বৃষ্টি। তিনি বলেন, এ বছর চালের বাজারে টান ছিল। হাওরে যে পরিমাণ ধান নষ্ট হলো, তাতে সরবরাহ অফুরন্ত থাকবে না।এবার বোরো মৌসুমে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এ থেকে ১ কোটি ৯১ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে হাওর তলিয়ে যাওয়ায় তা কিছুটা কম হওয়ার আশঙ্কা আছে। হাওরের ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছিল, সেখান থেকে প্রায় ৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের আশা করেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। তবে সেখানকার বড় অংশের ধানই নষ্ট হয়ে যাবে।তবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম মনে করেন, চালের কোনো ঘাটতি হবে না। গত রাতে ফোন করা হলে বুধবার এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যকেই তিনি উদ্ধৃত করতে বলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, হাওরে ধান নষ্ট হলেও চালের কোনো সংকট হবে না। বাংলাদেশে বছরে ১৫-২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। হাওরে ছয় লাখ টন কম উৎপাদন হলেও কোনো ঘাটতি হবে না।অবশ্য গত কয়েক দিনে চালের মূল্যবৃদ্ধির হার দিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বোঝা যাবে না। মূলত, গত বোরো মৌসুম শেষ হওয়ার পর থেকেই চালের দাম বাড়ছিল। ওই সময় মোটা চালের দর ছিল কেজিতে ৩২ আর সরু চাল ৪৪ টাকা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, গত এক বছরে মোটা চালের দাম ২৪ শতাংশ বেড়েছে।সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, আমরা যে সহনীয় মূল্যস্ফীতির কথা বলছি, সেখানে একটা ধাক্কা দেবে চালের দাম। দরিদ্র মানুষের বড় চিন্তা তো মোটা চালের দাম নিয়ে, সেখানেও একটা ধাক্কা লাগবে। তিনি বলেন, চালের প্রাপ্তিতে একটা ঘাটতি তৈরি হতে যাচ্ছে, সেটা দৃশ্যমান। এটা মোকাবিলায় সরকারকে নানা কর্মসূচি নিতে হবে। গতানুগতিক উপায় নয়, একটা উদ্যোগী মনোভাব থাকতে হবে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে; যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, চলতি অর্থবছরের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত আট মাসে প্রায় দুই লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন। অর্থাৎ, আমদানির পরিমাণ কম। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চালের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার পর আমদানি কমে যায়।চালের চড়া দামের কারণে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা জানা যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খাদ্য অধিদপ্তরের খোলাবাজারে চাল বিক্রি কর্মসূচির (ওএমএস) ট্রাকের সামনে গেলে। এসব জায়গায় ব্যাগ হাতে নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড় বেড়েছে। সেখানে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করছে সরকার।বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর শেওড়াপাড়ার আকরাম উদ্দিন নামের খাদ্য অধিদপ্তরের একজন পরিবেশকের ট্রাকের সামনে গিয়ে দেখা গেল, চাল নয়, ১৭ টাকা কেজি দরে আটা বিক্রি হচ্ছে। জানতে চাইলে আকরাম উদ্দিন বললেন, সরকার এক হাজার কেজি করে চাল বরাদ্দ দিয়েছে, যা সকাল নয়টায় শুরু করার পর বিক্রি হয়ে গেছে।আকরাম উদ্দিনের ট্রাক যেখানে রাখা, সেখান থেকে কিছু দূরেই শেওড়াপাড়া কাঁচাবাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে আটাশ নামের মাঝারি মানের চাল ৪৮ টাকা এবং রশিদ, এরফান, মোজাম্মেলসহ বিভিন্ন মিলের মিনিকেট চাল প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট চাল খোলা কিনলে দাম পড়ছে ৫৬ থেকে ৫৭ টাকা। রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ে বিজ্ঞান জাদুঘরের সামনে খাদ্য অধিদপ্তরের ট্রাকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুরাইয়া বেগম। কাঁচাবাজারে পানি সরবরাহের কাজ করেন তিনি। তাঁর পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৮। প্রতি মাসে প্রায় ৬০ কেজি চাল লাগে।সুরাইয়া বেগম বলেন, কিছুদিন আগেও এক বস্তা চাল কিনতে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৭০০ টাকা। এখন সেটা ২ হাজার টাকা চাচ্ছে। তার মানে, কেজিতে দাম বেড়েছে প্রায় ছয় টাকা। এই প্রথম তিনি ট্রাক থেকে চাল কিনতে গেছেন বলে জানালেন। চালের দাম বাড়ায় তাঁর সংসারে খরচ বেড়েছে প্রায় ৩৬০ টাকা।