নিষিদ্ধ হচ্ছে আনসার আল ইসলাম

গত একযুগে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছে ৬ টি সংগঠন ।এবার সেই তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে আনসার আল ইসলাম। শিগগিরই এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধেও সুপারিশ করতে যাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু এর আগে যেসব সংগঠন নিষিদ্ধ হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই গোপনে বিস্তার ঘটিয়েছে সিংস্র থাবায় । ঘটিয়েছে গুলশান ও শোলাকিয়ার মতো নৃসংশ ঘটনা। লেখক ব্লগার হত্যা করে দায় স্বীকার করেছে আড়াল থেকে। তাহলে কি কেবল নিষিদ্ধ করেই দায় সারছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট বলছে নিষিদ্ধ সংগটনের কার্যক্রম কঠোর ভাবে নজরদারী করা হবে। ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এক ভিডিও বার্তায় ভারতে শাখা বিস্তারের ঘোষণা দেন,আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের আল কায়েদার প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরি। ৫৫ মিনিটের সেই বার্তায় বাংলাদেশ মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একই ছাতার নিচে আনার ঘোষণা দেয়া হয় ।এর পরপরই বাংলাদেশে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় আনসারুল্লাহ বাংলাটিম। ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এক ভিডিও বার্তায় ভারতে শাখা বিস্তারের ঘোষণা দেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের আল-কায়েদার প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরি। ৫৫ মিনিটের সেই বার্তায় বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একই ছাতার নিচে আনার ঘোষণাও দেয়া হয়। এর পরপরই বাংলাদেশে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।

জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) নিষিদ্ধ হওয়ার আগেই এ সংগঠনের মতাদর্শীরা আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) কথিত সমর্থিত সংগঠন আনসার আল ইসলাম গঠন করে। ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি একটি ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নিয়ে ভারতে তাঁর সংগঠনের শাখা স্থাপনের ঘোষণা দেন। ওই সেপ্টেম্বর মাসেই এবিটির খোলস থেকে বেরিয়ে আনসার আল ইসলাম নামে সংগঠন গড়ে তোলে উগ্রপন্থীরা। এর আগে এবিটি ছিল মূলত ব্লগ ও অনলাইননির্ভর সংগঠন। আনসার আল ইসলাম একজন সমন্বয়কের অধীনে সংগঠনটি যাত্রা করে। এই সংগঠনে নাম লেখানো উগ্রপন্থীরা তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করে। এগুলো হলোÑদাওয়া, আশকারি এবং মিডিয়া ও আইটি বিভাগ। গত দুই বছরে ব্লগারসহ কয়েকটি হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমনই তথ্য পেয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা। সেই এবিটির পর এবার আনসার আল ইসলামকে নিষিদ্ধ করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করতে যাচ্ছে পুলিশের এই বিশেষায়িত ইউনিট। সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান, অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, ভিন্ন মতাদর্শীদের হত্যার মিশনে নামা আনসার আল ইসলামের সদস্য কারা, সংগঠনটির ধরন, নেতৃত্ব, অস্ত্র, হত্যা মিশনসহ বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন তাঁরা। এসব তথ্যের ভিত্তিতে সিটিটিসি মনে করছে, আনসার আল ইসলাম সরাসরি জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত। এ সংগঠনের নেতৃত্বের নির্দেশে অসংখ্য হত্যাকান্ডও ঘটেছে। ফলে শিগগিরই সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের পর আনসার আল ইসলাম, ৩, ৬, ৭, ৮, ১১ ও ১৩ নামে দায় স্বীকার করে। ব্লগার, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামও তালিকাভুক্ত করে তাঁদের হত্যার হুমকি সংবলিত চিঠি দেওয়া হয় এই সংগঠনের নাম ব্যবহার করে। তবে আনসার আল ইসলাম বা একিউআইএসের বাংলাদেশে ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছিল না পুলিশ ও গোয়েন্দারা। অবশেষে খুনের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক রূপরেখা পেয়েছে সিটিটিসি।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি একটি ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দেন, ভারতে তাঁর সংগঠনের শাখা স্থাপন করা হবে। ৫৫ মিনিটের নতুন ভিডিও বার্তায় আরবি ও উর্দু ভাষার মিশ্রণে জাওয়াহিরি বলেন, এই পদক্ষেপ ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী আইনের প্রসার ও জিহাদের পতাকা সমুন্নত রাখবে। এটা বাংলাদেশ, মিয়ানমার, আসাম, গুজরাট, আহমেদাবাদ ও কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য আনন্দের খবর। এই ভিডিও বার্তা প্রচারিত হলে বাংলাদেশেও তোলপাড় শুরু হয়। তখন থেকেই তথ্য ও বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে বলা হয়, এই ঘোষণার কারণে বাংলাদেশে স্থানীয় জঙ্গিদের নিয়ে ভয় আছে। বাংলাদেশে আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী আল-কায়েদা। দেশের কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে আল-কায়েদার ভাবাদর্শগত মিলও আছে। এর মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম অন্যতম। জঙ্গিবিষয়ক কর্মকা- তদন্তে অভিজ্ঞ মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাওয়াহিরির বক্তব্যের পরই আনসার আল ইসলাম সাংগঠনিক রূপ নেয়। এর আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানীসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর সংগঠনের নেতাকর্মীরা খোলস বদল করে। গত দুই বছরে একের এর এক গুপ্তহত্যার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে আনসার আল ইসলামের নাম উঠে এসেছে। তিনি আরো বলেন, আনসার আল ইসলামকে নিষিদ্ধ করতে শিগগিরই পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর একটি প্রতিবেদন পাঠানো হবে। আমাদের অভিযানের কারণে সংগঠনটি অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। একই সঙ্গে এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মনোবলেও চিড় ধরবে। এ ছাড়া তাদের নতুন করে সদস্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া আটকানো সহজ হবে এবং এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে লোকজন বিরত থাকবে।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন থাকে। তবে জঙ্গিবাদী দলের এমন কোনো নিবন্ধন নেই। তাদের সাংগঠনিক রূপরেখা আমরা পেয়েছি। এর ভিত্তিতে নিষিদ্ধ করার জন্য আবেদন করা হবে।মনিরুল ইসলাম আরো জানান, ভিন্ন মতাদর্শীদের হত্যা করলেও গুলশানে জঙ্গি হামলায় নিরপরাধ মানুষকে হত্যার বিরোধিতা করে নিজেদের অনলাইন সাইটে বার্তা দেয় আনসার আল ইসলাম। ফলে ওই ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।সিটিটিসি সূত্র জানায়, ব্লগার আহমেদ হায়দার রাজীবসহ কয়েকটি হত্যাকান্ডে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মতাদর্শীরা জড়িত বলে প্রমাণ মিললে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত বছরের ২৫ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়Ñসন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) আইনের ১৮(২) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার কারণে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আগে আরো ছয়টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

গত এক বছরে পুলিশের বিশেষ ইউনিটের কর্মকর্তারা তথ্য পান, এবিটি নিষিদ্ধের আগে থেকেই মতাদর্শীরা একিউআইএসের আদর্শে সাংগঠনিক রূপরেখা তৈরি করতে থাকে। এর প্রধান একজন সমন্বয়ক, যিনি ঢাকার একটি মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। বুয়েটের ছাত্র দ্বীপ হত্যাকান্ডের পর তাঁর নাম জানতে পারেন তদন্তকারীরা। এর পর থেকে আত্মগোপনে চলে যান ওই মাদ্রাসা শিক্ষক। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক সমন্বয়কের পরবর্তী স্তরের ভূমিকা পালন করছেন। একই সঙ্গে তিনি সামরিক কমান্ডার।এবিটির গ্রেপ্তার হওয়া আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানী এই সংগঠিত অংশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। সূত্র জানায়, ২০১২ সালে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানী ও বর্তমান আনসার আল ইসলাম সমন্বয়কের হাত ধরেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেন। এর পর থেকেই তিনি সামরিক শাখার দায়িত্ব নিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করছে আনসার আল ইসলাম। এগুলো হলোÑদাওয়া, আশকারি, মিডিয়া ও আইটি। দাওয়া বিভাগ সদস্য সংগ্রহ ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে থাকে। আশকারি বিভাগ হচ্ছে সব হত্যার মিশনের প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন করে। আর মিডিয়া ও আইটি তথ্য সংগ্রহ করে এবং দেশে-বিদেশে তাদের কর্মকা- প্রচারে কাজ করে। সূত্র মতে, আনসার আল ইসলামের কর্মীরা তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম স্তরে হাদী থাকে, যারা নেতা বা কমান্ডার। দ্বিতীয় স্তরে মাসুল, যারা স্থানীয় কমান্ডার বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী। তৃতীয় স্তরে থাকে প্রশিক্ষক ও সরবরাহকারী দল। চতুর্থ স্তরে থাকে মামুর বা বাস্তবায়নকারী দল, যারা সরাসরি হত্যায় অংশ নেয়। সিটিটিসি সূত্র জানায়, কোনো টার্গেটের ওপর হামলা চালানোর আগে এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা নতুন একটি সেফ হাউসে ওঠে। জঙ্গিদের ভাষায় এই বাসাটিকে মার্কাজ বলা হয়ে থাকে। মাসুলের দায়িত্বে থাকা তরুণরা এই মার্কাজ ভাড়া নেওয়া থেকে শুরু করে অপারেশনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। কর্মকর্তারা বলেন, আনসার আল ইসলাম সর্বশেষ চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা ও সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন রূপবান সম্পাদক জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু তনয়কে খুন করে।এদিকে,২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পর পর্যায়ক্রমে মুফতি হান্নানসহ শীর্ষ পর্যায়ের বেশির ভাগ তাত্ত্বিক নেতা গ্রেপ্তার হলেও বিদেশি অর্থে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও উত্তরাঞ্চলে আবার মাথা তোলার চেষ্টা করছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম বাংলাদেশ (হুজি-বি)। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হুজি-বির ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মওলানা নাজিম উদ্দিনকে হেফাজতে নিয়ে (রিমান্ড) জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা জানতে পেরেছেন, হুজি-বিকে নতুন করে সক্রিয় করে তুলতে দুবাইসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। গত এক বছরে হুন্ডির মাধ্যমে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছে হুজি-বি।হুজি-বির মূল দলের পাশাপাশি তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর কাছেও বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ এসেছে।

নাজিম উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে গোয়েন্দারা বলছেন, গত কয়েক মাসে দুবাই থেকে দুই দফায় ছয় লাখ টাকা পেয়েছেন নাজিম উদ্দিন। সেই অর্থ দেশের উত্তরাঞ্চলের ৫১টি পরিবারকে দিয়েছেন তিনি। মাঠপর্যায়ে হুজি-বির সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই এ টাকা দেওয়া হয়েছে। সেই ৫১ পরিবারকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম।

দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতেই হুজি-বিকে বিদেশ থেকে অর্থ সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দেশের বাইরে থেকে বর্তমানে হুজি-বিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন মুফতি শহিদুল নামের এক ব্যক্তি। রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার ফাঁসিরনন্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি শফিকুর রহমান নামের আরেক নেতাও বর্তমানে হুজিকে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। তিনিই দুবাই থেকে হুজি-বিকে অর্থ পাঠিয়ে সহযোগিতা করছেন। এ ছাড়া আরো কয়েকজন হুজি-বিকে সংগঠিত করতে বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাচ্ছেন। বিশেষ করে হুজি-বির বর্তমান সামরিক কমান্ডার শহীদুলের ছেলে মোহাম্মদ তালহার কাছে বেশি অর্থ আসছে। মূলত তালহার নেতৃত্বেই দেশে অবস্থানকারী আঞ্চলিক নেতারা মাঠপর্যায়ে হুজি-বিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। আর বিদেশে আত্মগোপনে থেকে তালহার বাবা মুফতি শহিদুল ইসলাম হুজি-বিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।

র‌্যাব ও ডিবির গোয়েন্দা সূত্র মতে, ২০০৫ সালের অক্টোবরে হুজি-বি নিষিদ্ধ হওয়ার পর তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। এরপর ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত হুজি-বি নানা কৌশলে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। এর মধ্যে হুজি-বি একবার সংবাদ সম্মেলনের চেষ্টা চালিয়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতেও আসার চেষ্টা করে। সে সময় তিন ভাগে বিভক্ত হওয়া হুজি-বির একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন মুফতি হান্নান।আরেক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন মুফতি আবদুর রউফ। অন্য অংশের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুস সালাম, মুফতি শফিকুল ইসলাম, শেখ ফরিদ, আবদুল হাই ও হাফেজ ইয়াহিয়া। তাঁরা বর্তমানে কারাগারে। তাদের মধ্যে আব্দুস সালামকে জিজ্ঞাসাবাদে হুজি-বির তিন ধারায় বিভক্ত হওয়ার তথ্য জানতে পেরে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার ঘটনায় পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের পক্ষ নেওয়া দেশি-বিদেশি অপশক্তি ইন্ধন দিচ্ছে। তাদের মাধ্যমেই হুজি-বিসহ অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীদের হামলার টার্গেটে কেপিআই (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা), দূতাবাস, বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ভিআইপিরা রয়েছেন। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে। তবে জোটবদ্ধ হয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো যাতে কোনোভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখছেন গায়েন্দারা। দেশব্যাপী গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সারা দেশে ব্যাপক অভিযানের ফলে নতুন নামে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলো তৎপর হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

হুজি-বির ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মওলানা নাজিম উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, দুবাইসহ বেশ কয়েকটি দেশে হুজির সাংগঠনিক কর্মকান্ড রয়েছে। সেসব দেশের নেতাদের সঙ্গে মিলে সেখানকার কিছু গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে আর্থিক সহযোগিতা করছে। তাদের সঙ্গে দেশে সরকারবিরোধী শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক দলের নেতাদের হাত রয়েছে। যেহেতু হুজি-বির শীর্ষ নেতারা জেলে, তাই মাঠপর্যায়ে অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গেও হুজি-বির যোগাযোগ রয়েছে। বর্তমানে হুজি-বি তার পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে চলমান সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে দলকে সংগঠিত করছে। তাই জেএমবি, আনসারুল্লাহর মতো তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের দলে টানার উদ্যোগ নিয়েছে।

নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ আনাস ও সাইদুজ্জামান। তাঁদেরও রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। ডিবি সূত্র জানায়, নাজিম উদ্দিন রাজধানীর মিরপুরের আকবর কমপ্লেক্সের একটি মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সহযোগী সাইদুজ্জামান কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন। তিনি নাজিমের মাধ্যমে হুজির দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশ নিতেন। আর আনাস মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।

ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় হুজি-বির শীর্ষ নেতাসহ বেশির ভাগ নেতা-কর্মী বর্তমানে জেলে রয়েছে। যেসব নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছে বা পলাতক জীবন যাপন করছে, তাদের প্রত্যেকের পরিবার ও সংসারের ভরণপোষণ দেওয়া হচ্ছে সংগঠন থেকে। নাজিম উদ্দিনের মাধ্যমে হুজি-বি নেতা-কর্মীদের বাসায় মাসে চার থেকে ১২ হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছিল। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ায় এখন অন্য নেতাদের মাধ্যমে সেই টাকা দেওয়া হচ্ছে।ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বিদেশে যারা যুদ্ধরত আছে বা নিহত হয়েছে তাদের পরিবারসহ ইতিমধ্যে ফাঁসিসহ বিভিন্ন দন্ড পাওয়া জঙ্গিদের ৫১ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে হুজি-বি। গ্রেপ্তার সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, এসব পরিবারের বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। তাদের অধিকাংশই দরিদ্র। আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রমাণ পেয়ে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, বর্তমানে তরুণদের টার্গেট করছেন সব জঙ্গি সংগঠনের নেতারা। নানা দুঃখ, কষ্ট, দুর্বলতা আছেÑএমন তরুণদের সঙ্গে ধর্মবিষয়ক কথাবার্তা বলে একপর্যায়ে জঙ্গিবাদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে।

ডিবির তথ্য মতে, গত ২৩ জুলাই পুরান ঢাকার বাংলাবাজার এলাকার একটি প্রকাশনা অফিস থেকে হুজি-বির সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্পর্কে বেশ কিছু নথি জব্দ করা হয়েছে। ওই অফিস থেকে একটি তালিকা জব্দ করে জানা গেছে, দুই বছর ধরে দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসছে। ডিবি সূত্র জানায়, নাজিম উদ্দিনসহ গ্রেপ্তার তিনজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাবাজারের প্রকাশনাটি হুজি-বির ঢাকা মহানগরীর সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ সাইফ্ল্লুাহ ওরফে সগির বিন এমদাদের। অভিযানে সেখান থেকে পাঁচ হাজার জিহাদি বই জব্দ করা হয়েছে। র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি মাদ্রাসায় হুজি-বির সদস্য রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে হুজি-বি মূল সংগঠন থেকে বের হয়ে আল আনসার’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠন গঠনের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছে। চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসার দুই শিক্ষার্থী আল আনসারের নেতা বলে জানা গেছে। সম্প্রতি রাজধানীর হাজারীবাগের ‘আল জমিয়াতুল উলুম মাদ্রাসা’র দক্ষিণ পাশের একটি বাড়ি থেকে আল আনসারের প্রধান সমন্বয়কারী হাফেজ মোহা. রাশিদুল আলমসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে বিপুলসংখ্যক জিহাদি বই ও প্রশিক্ষণসামগ্রী জব্দ করা হয়েছে।

র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, রাশিদুল আলমসহ অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, হুজি-বি ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে চট্টগ্রামের দুই মাদ্রাসা ছাত্রের মাধ্যমে। এর বাইরেও তাদের আরো অনেক নেতার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়াতে মূল দলের সদস্যরা নতুন নামে নতুন দল গঠন করে সংগঠতি হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এদের সব নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কোনোভাবে দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না।রাশিদুলসহ অন্যদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-২-এর পরিচালক লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, হুজি-বির সদস্যরা পুরনো সংগঠন থেকে বের হয়ে আল আনসার নামের একটি নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আটক ব্যক্তিদের সবাই পূর্ববর্তী হুজি-বির সক্রিয় সদস্য। ক্রমাগত অভিযানে হুজি-বির সদস্যরা গ্রেপ্তার হওয়ায় অন্যরা আল আনসার নামের নতুন সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। প্রসঙ্গত, হুজি বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে কার্যক্রম শুরু করে। সে সময় থেকে আফগান ফেরত মুজাহিদরা মিলে হুজির নামে সংগঠনের ব্যানারে তৎপর হতে শুরু করে। আজ জেএমবি, আনসারুল্লাহসহ নানা জঙ্গি সংগঠনের মাধ্যমে দেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের যে চেষ্টা চলছে তার নেপথ্যেও হুজি অন্যতম। ১৯৯৯ সালে কবি শামসুর রাহমানকে হত্যাচেষ্টা, ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলা এবং ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি। ২০০৫ সালে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করা হয়।