বীর প্রতীক রহমত উল্ল্যাহ আর নেইখুলনার বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. গাজী মোহাম্মদ রহমত উল্ল্যাহ দাদু (অব.) বীর প্রতীক আর নেই (ইন্নালিল্লাহি… রাজেউন)। বুধবার (১০ আগস্ট) রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে তিনি খুলনার শেখপাড়ার নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় খুলনার সার্কিট হাউজে তিনিই প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি স্ত্রী, ৩ ছেলে,১ ছেলে, ৬ ভাই ও ১ বোনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

রহমত উল্ল্যাহ দাদুর ছোট ভাই খুলনা ক্লাবের সভাপতি গাজী ঈসা মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জানান, বৃহস্পতিবার বাদ জোহর নগরীর শহীদ হাদিস পার্কে মরহুমের নামাজে জানাজা হবে। পরে গ্রামের বাড়ি পাইকগাছার গড়ইখালীর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। গাজী ঈসা বলেন, গাজী রহমাতুল্লাহ দাদু দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ও পিত্তথলিতে পাথরজনিত রোগে ভুগছিলেন। এছাড়া ২০০০ সালে তার ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে নগরীর শেখপাড়া ২২, বি কে রায় রোডের মৌসুমী ভিলায় তিনি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

এদিকে, তার মৃত্যুর খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের খুলনা জেলা ও মহানগর নেতারা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা শেখপাড়ার বাড়িতে যান এবং মরহুমের শোকসন্ত্বপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। শহীদ হাদিস পার্কে মরহুমের গার্ড অব অনার দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা।

গাজী রহমাতুল্ল্যাহ দাদুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন দৈনিক পূর্বাঞ্চল সম্পাদক বেগম ফেরদৌসী আলী, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ খুলনা মহানগর কমান্ডার অধ্যাপক আলমগীর কবির, জেলা কমান্ডার সরদার মাহবুবার রহমান, খুলনা মহানগর আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগের সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মনি, সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহিন আজাদ, মহানগর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এম. নূরুল ইসলাম দাদু ভাই, মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি প্রমুখ।

লে. গাজী মোহাম্মদ রহমাতুল্ল্যাহ দাদু ১৯৩৭ সালের ১১ নভেম্বর পাইকগাছার গড়ইখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। স্বাধীনতার যুদ্ধে তার নেতৃত্বে নৌ কমান্ডো সফলতার কারনে ৭৫ ভাগ অগ্রসারিত হয়। তারা ১৩২টি জাহাজ ধ্বংস করার কারণে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নৌপথ এবং সামুদ্রিক পথে সব কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হয়েছিল।

তিনি একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় খুলনায় প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৭১ সালে ২৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার সম্মেলনে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর এবং ১০ নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। তারই নেতৃত্বে নৌ বাহিনী গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত নৌ-বাহিনীর অফিসার ও নাবিকদের বাংলাদেশে অবস্থানের সব ব্যবস্থা তিনিই করেন। তিনি নৌ বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কাজ করেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের দিন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি ঢাকা বিমান বন্দরে নৌ কন্টিজেন্টের গার্ড অব অনার প্রদান করেন। দেশে তিনিই প্রথম আধা নিবিড় বাগদা চাষ শুরু করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশে বাগদার পোনা হ্যাচারি স্থাপন করেন। খুলনা বিভাগীয় চিংড়ি চাষি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি খুলনা বিভাগীয় সেক্টর ফোরামের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। তার প্রচেষ্টায় নৌ-বাহিনীর সমস্ত স্থাপনায় মসজিদ, স্কুল, কলেজ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও বরিশাল, রাজশাহীতে স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাইকগাছা উপজেলার গড়ইখালি ডিগ্রি কলেজ মসজিদ, মন্দির, স্কুল ও বহু রাস্তাঘাট তার অবদান রয়েছে। মরহুমের ১০ ভাইয়ের মধ্যে ৭ জনই মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত হন।