ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের অভিযোগে কাঠগড়ায় উইকিলিকস

ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলোর গোপন তথ্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে দুনিয়াজুড়ে আধিপত্যবিরোধী মানুষদের প্রতিকী কণ্ঠস্বরে পরিণত হওয়া উইকিলিকস-এর বিরুদ্ধে এবার ঢালাওভাবে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপির এক অনুসন্ধানে উইকিলিকস-এর ঢালাও ব্যক্তিগত তথ্যফাঁসের বিষয়টি উঠে এসেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি, ডেমোক্রেটিক পার্টি ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন নথি প্রকাশ করে আলোড়ন তুলেছে উইকিলিকস। বুধবার রাতে আবারও অ্যাসাঞ্জ হুমকি দিয়েছেন হিলারি ক্লিনটনের এমন কিছু গোপন মেইল তারা প্রকাশ করবেন, যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে অ্যাসাঞ্জ যখন হিলারির ভূমিকা উন্মোচন করতে যাচ্ছেন তখন তিনি নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্নবিদ্ধ তার উইকিলিকস। তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি (দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস)। তাদের অনুসন্ধানে দাবি করা হয়েছে, সম্প্রতি যে গোপন নথিগুলো ঢালাওভাবে উইকিলিকস ফাঁস করেছে, তাতে শত শত মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যও রয়েছে। ব্যক্তিগত এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে অসুস্থ শিশু, ধর্ষণের শিকার নারী ও মানসিক রোগীরা।

উইকিলিকস ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ভূমিকা উন্মোচনের কথা বলে। পাশাপাশি তারা সেই দর্শনের সমান্তরালে একটি প্রতিশ্রুতি হাজির করে বিশ্ববাসীর সামনে। সেটা হলো, রাষ্ট্রীয় কিংবা বহুজাতিক বাণিজ্যের নজরদারির বিপরীতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার প্রশ্ন। তবে নিজেদের ওয়েবসাইটে নিজেদেরকে গোপনীয়তার শীর্ষে অবস্থানকারীদের অন্যতত দাবিকারী এই প্রতিষ্ঠান কী করে সৌদি আরবের নারী-শিশু-মানসিক রোগীর তথ্য জনপরিসরে তুলে ধরল, তা নিয়ে হতাশ ভুক্তভোগীরা। যাদের তথ্য ফাঁস করা হয়েছে তারা এপিকে জানিয়েছেন তাদের দুর্দশার কথা। মানবাধিকারের পক্ষে সরব মানুষেরাও হতাশ। অস্বস্তিতে ফেলেছে উইকিলিকসের বন্ধু-স্বজনদের।

খোদ অ্যাসাঞ্জের কাছে থেকে ক্ষমতাশালীদের ভূমিকা উন্মোচনে দীক্ষা নেওয়া সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন একে ভয়াবহ কাজ হিসেবে দেখছেন। একজন লৈঙ্গিক সমতার পক্ষের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একজন অ্যাকটিভিস্ট বলছেন, নজরদারির বিরুদ্ধে লড়াই নয়, অ্যাসাঞ্জরা আসলে নজরদারিকে বৈধতা দিচ্ছেন। তবে মিডিয়া ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, আসলে তাদের বাছাইপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা ও অসতর্কতার কারণেই এমন ঘটেছে।

এদিকে এপি বলছে, অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে অভিযুক্ত উইকিলিকস-এর প্রধান সম্পাদক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে কয়েক মাস ধরে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েও যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। এপির লিখিত প্রশ্নেরও কোনও উত্তর দেওয়া হয়নি। তবে নিজেদের টুইটারে দেওয়া এক পোস্টে উইকিলিকস অভিযোগটি অস্বীকার করেছে। তারা গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছে এবং দাবি করেছে এসব ‘বানানো সংবাদ’ এবং ‘শিরোনাম হওয়ার মতোও গুরুত্বপূর্ণ নয়’।

জর্ডানের আম্মানভিত্তিক কনসালটেন্ট ড. নায়েল আল-ফায়েজ নিশ্চিত করেছেন, উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যে তার একজন ব্রেন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ তথ্যের সঙ্গে রাজনীতি বা দুর্নীতির কোনও সম্পর্ক নেই। জর্ডানের আরেক অবসরপ্রাপ্ত প্র্যাক্টিশনার ড. আদনান সালহাবও নিশ্চিত করেছেন তার একজন রোগীর তথ্য রয়েছে নথিগুলোতে। টেলিফোনে ক্ষোভ প্রকাশ করে সালহাব বলেন, ‘যা ঘটেছে তা বেআইনি। এটা বেআইনি।’

এপির অনুসন্ধানে এরকম ২৩ জনের কথা জানা গেছে, যাদের পরিচয় প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছে ওই মার্কিন বার্তা সংস্থা। এদের বেশিরভাগই সৌদি আরবের নাগরিক। এদের অনেকে আবার জানেন না যে তাদের পরিচয় তথ্য ফাঁস করা হয়েছে। কয়েকজন এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকে বীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। তাদের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী নারী আছেন, যিনি গোপনে এক অসুস্থ রোগীকে সহযোগিতার জন্য ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও তিনি বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। টেলিফোনে এপিকে তিনি বলেন, এটা একটা বিপর্যয়। যদি আমার ভাই, প্রতিবেশী ও আমার পরিচিতরা বিষয়টি জানে তাহলে কী হবে? এমনকি জানি না তারা এটা দেখেছে কিনা। আমরা কথা প্রকাশ করে কী লাভ?

মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের সবচেয়ে গোপনীয় বিবেচনা করা হয় মেডিক্যাল রেকর্ডকে। কিন্তু এপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উইকিলিকস নিয়মিত মানুষের পরিচয়ের তথ্য, ফোন নম্বর ও অন্যান্য তথ্য যা অপরাধীরা কাজে লাগাতে পারে, তা প্রকাশ করছে।

গত মাসে ডেমোক্রেটিক পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশনের ফাঁস করা তথ্যে দুই ডজনেরও বেশি মানুষের সোশ্যাল সিকিউরিটি ও ক্রেডিট কার্ডের নম্বর প্রকাশ করা হয়েছে। এপির গবেষণালব্ধ তথ্যের সহযোগিতায় এ তথ্য জানিয়েছে হ্যাম্পশায়ার ভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনাকারী সংস্থা ডাটাগ্র্যাভিটি। এ তালিকায় থাকা দুই ব্যক্তি এপিকে জানিয়েছেন, তাদের তথ্য ফাঁসের পর পরিচয় চোরদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক। তিনি জানিয়েছেন, একের পর এক হুমকির মুখে তিনি তার নম্বর পরিবর্তনের চিন্তা করছেন।

উইিকলিকস-এর বিরুদ্ধে ওঠা ওমন অভিযোগে হতাশ সারা বিশ্বের সচেতন মানুষেরা। এমনকি অ্যাসাঞ্জের সবচেয়ে কাছের লোকেরাই অস্বস্তিতে পড়েছেন। সাংবাদিক জগতে উইকিলিকসের সবচেয়ে বড় মিত্র সাংবাদিক গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড প্রকাশের কৌশল নিয়ে মতবিরোধে দূরত্ব বজায় রাখছেন। অ্যাসাঞ্জের ভাবশিষ্য খ্যাত স্নোডেন এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, তথ্যের গণতন্ত্রায়নের প্রয়োজনীয়তা কী, উইকিলিকস-এর ভূমিকার কারণেই তা বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে। তবে তাদের এই কাজকে (ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস) নিয়ে খুব বিনয়ী হয়েও যদি বলি, তারপরও বলতে হয় তারা ভুল করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এলজিবিটি অ্যাক্টিভিস্ট স্কট লং বলছেন, ‘আপনারা (উইকিলিকস) তাদের নজরদারীকে বৈধতা দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন না।’ তবে একে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করছেন না বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। ড্রিউ ইউনিভার্সিটির মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনস বিষয়ের শিক্ষক লিসা লিঞ্চ কয়েক বছর ধরেই উইকিলিকসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করছেন। তিনি মনে করেন, অ্যাসাঞ্জের হয়ত প্রকাশ করা তথ্যগুলো যাচাই করার পর্যাপ্ত কর্মী ও সামর্থ্য নেই। অথবা তিনি নিজের কাজ দ্রুত করার কথা ভাবছেন গোপনীয়তার বিষয় বাদ দিয়ে।

বুলগেরিয়ার ন্যাশনলা ল্যাবরেটরি অব কম্পিউটার ভাইরোলজি বিভাগের এক গবেষক ভেসেলিন বন্টচেভের মন্তব্য, উইকিলিকসের তথ্যে কয়েক ক্ষতিকর সফটওয়্যার (ম্যালওয়ার) পেয়ে তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি মনে করেন, প্রকাশিত তথ্য ভাইরাসমুক্ত করার সাধারণ পদক্ষেপের ব্যবস্থা নেই উইকিলিকসের। বলেন, তারা (উইকিলিকস) সাংবাদিকতা বলতে মনে করে গুরুত্বপূর্ণ একটা নথি পেয়ে তা আবর্জনার বাক্সে ফেলে রাখা এবং পরে সেই বাক্স আপনার বাসার দরজার সামনে রেখে দেওয়া।’

ডিয়েত্রিচ নামের আরেক অ্যাক্টিভিস্ট জানান, নীতিগতভাবে উইকিলিকসকে তিনি এখনও সমর্থন করেন কিন্তু অ্যাসাঞ্জ ও তার সহকর্মীদের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। বলেন, ‘তারা নিজেদের অ্যান্টি প্রাইভেসি অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে রাজি নন। কিন্তু এর বাইরে বাঁচতে হলে, এ ধরনের কাজ কখনও করা উচিত না।’

উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সাড়া জাগানো বিকল্প সংবাদমাধ্যম উইকিলিকস বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয় ২০১০ সালে। মার্কিন কূটনৈতিক নথি ফাঁসের মধ্য দিয়ে উইকিলিকস উন্মোচন করেন মার্কিন সাম্রাজ্যের নগ্নতাকে। দুনিয়াজুড়ে আলোচনায় আসেন ওই সংবাদমাধ্যমের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলোর গোপন তথ্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে দুনিয়াব্যাপী আধিপত্যবাদবিরোধী মানুষদের প্রতিকী কণ্ঠস্বরে পরিণত হন তিনি। তবে সাম্প্রতিক ব্যক্তিগত তথ্যফাঁসের অভিযোগের পর উইকিলিকস এবং অ্যাসাঞ্জের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।