ব্লগ নিয়ে কিছু কথা

‘ব্লগ’ এবং ‘ব্লগার’ শব্দ দুটি আমরা আজকাল হরহামেসা শুনছি৷ কিন্তু এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারনা আমাদের অনেকেরই নেই৷ ‘ব্লগ’ ও ‘ব্লগিং’ বলতে ওয়েবসাইটের শুধুমাত্র লেখালেখি-ই বোঝায় না৷ আর ওয়েব পেজ এ কিছু লিখলেই ‘ব্লগার’ হওয়া যাবে তাও নিশ্চিত নয়৷

‘ব্লগ’ শব্দটি খুব বেশি দিনের পুরোনো নয়৷ ১৯৯৭ সালে জর্ন বার্গার ‘ওয়েবলগ’ শব্দের উদ্ভাবন করেন৷ পরবতর্ীতে এপ্রিল-মে, ১৯৯৯ সালে পিটার মারহোলজ্ কৌতুক ছলে “ওয়েবলগ” শব্দটি ভেঙ্গে একে “উই ব্লগ” এ রুপান্তরিত করেন (যা এক প্রকার বাগধার) এবং তার পিটার ডটকম সাইটের সাইড বার এ সনি্নবেশ করেন৷ এরপর ইভান উইলিয়ামস তার ‘পায়রা ল্যাবস’ এ ব্লগ শব্দটিকে (নাম ও ক্রিয়াবচক হিসেবে) ব্যবহার করে পায়রা ল্যাবস এর পণ্যের ধারনা ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেন৷ তবে এরও আগে ১৯৯৪ সালে অনলাইন ডায়রী ‘জেরী পোরনিলি’্ল প্রকাশের মধ্য দিয়ে জাস্টিন হল নামে যুক্তরাষ্ট্রের সোয়ার্থমোর কলেজে অধ্যায়নরত এক ছাত্র সর্বপ্রথম একজন ব্লগারের স্বীকৃতি লাভ করে৷ এরপর ধীর গতিতে ব্লগিং জনপ্রিয়তা পায় এবং ১৯৯৯ পরবতর্ী ইন্টারনেটে “হোস্টেড ব্লগ টুল” আসার পর এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে৷ প্রযুক্তিগত উন্নতির কারনে অক্টোবর ১৯৯৮ সালে ব্রুস এবলেসন এর ‘ওপেন ডায়রী’, মার্চ ১৯৯৯ সালে ব্র্যাড ফিটত্‍জপ্যাট্রিক এর ‘লাইভ জার্নাল’, জুলাই-১৯৯৯ সালে এন্ড্রু স্মেল তৈরীকৃত পিটার ডট কম এর ‘নিউজ পেজ’ এবং অগাস্ট ১৯৯৯ সালে ইভান ইউলিয়ামস ও মেগ হাউরিহান এর ‘ব্লগারস ডট কম’ (২০০৩ সালে গুগল কতর্ৃক ক্রয় কৃত) ওয়েবসাইটে “ব্লগিং” এর ভিন্নতা ও নতুন মাত্রা যোগ করে৷ পরবতর্ীতে ‘ব্লগিং’ এর জনপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, ২০১১ সালে অবধি ১৫৬ মিলিয়ন পাবলিক ব্লগ, ২০১২ পর্যন্ত ৭৭ মিলিয়ন টাম্বলার এবং ৫৬.৬ মিলিয়ন ওয়ার্ড প্রেস ব্লগ তৈরী হয়৷

বর্তমানে ইন্টারনেটে পাবলিক ব্লগ সংখ্যা টাম্বলার ১০১.৭ মিলিয়ন ব্লগস (৪৪.৬ বিলিয়ন পোস্ট সহ), ওয়ার্ডপ্রেস কম ৬৩ মিলিয়ন ব্লগস, লাইভ জার্নাল ৬২.৬ মিলিয়ন, উইবলি ১২ মিলিয়নের বেশি এবং ব্লগস্টার এর ৫৮২৭৫৪ টি ব্লগস রয়েছে এবং প্রতিদিনই এ সংখ্যা গুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে৷

ব্লগ কি? এর উত্তরে বলা যায়, ব্লগ হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবসাইটে যে কোন বিষয়ের উপর আলোচনা কিংবা তথ্য সম্পর্কিত লেখা লিপিবদ্ধ করা যা বিপরীত কালানুক্রমে বিন্যস্ত থাকে ও প্রকাশিত হয়৷ অর্থাত্‍ সামপ্রতিক লেখাগুলো প্রথমদিকে এবং পূর্বের লেখাগুলো পিছন দিকে বিন্যস্ত থাকে৷ উদাহরন হিসেবে প্রথমতঃ অনলাইন জার্নাল কিংবা অনলাইন ডায়রীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে৷ এসব লেখা একজন ব্লগার নিয়মিতভাবে আপডেট করতে পারেন৷ এফটিপি’র মাধ্যমে ওয়েব সাইট আপলোড করে তাতে ম্যানুয়ালি হাতে লেখা পোস্ট করে ব্লগ তৈরী ও প্রকাশ করা যায়৷ সিএমএস (কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) সফটওয়ার এর মাধ্যমেও ব্লগিং করা সম্ভব৷ ২০০৯ সাল অবধি ব্লগিং সাধারনত একক বা ব্যক্তি পর্যায়ে কিংবা ছোট ছোট গ্রুপ ভিত্তিক একটি মাত্র কোন বিষয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল৷ কিন্তু সামপ্রতিক কালে লেখা পোস্টিং এর ক্ষেত্রে ‘মাল্টি অথর ব্লগস’ এর উন্মেষ ঘটে এবং এতে একই ওয়েবসাইটে বহু সংখ্যক লেখকের লেখা ও মত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়৷ যেমন সংবাদপত্র ও অন্যান্য মিডিয়া, ফেসবুক, টুইটার, মাইক্রোব্লগিং ইত্যাদি সাইটগুলো সামাজিক তথ্য আদান প্রদানের কাজে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ ব্লগ সাইট গুলোতে মন্তব্য প্রকাশ এবং এর মাধ্যমে মেসেজ আদান প্রদানের সুযোগ থাকায় ব্লগার এবং পাঠকদের এমনকি অন্যান্য সাইটের সাথে লিংক, সম্পর্ক এবং সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে৷

ব্লগার কে? এর উত্তর সহয়ে বলা যায়, যে বা যারা ব্লগ লিখেন কিংবা ব্লগের জন্য লিখেন তারা-ই ব্লগার৷ তবে ব্লগ সাইটে ক্রিয়েটিভ রাইটার হিসেবে লেখার সুযোগের পূর্ব শর্ত হিসেবে ইন্টারনেট এ নিজস্ব ব্লগিং সাইট, ব্যাকরন ভূল মুক্ত ইংরেজী দক্ষতা এবং অনেক ক্ষেত্রে নমুনা যাচাই ও কখনও কখনও কাঙ্খিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়৷ বিশেষতঃ ফ্রিল্যান্সার, ওডেস্ক ইত্যাদি সাইটে ফিকশন গেস্ট, ক্রিয়েটিভ, কপি রাইটিং, টাইপিং ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে বিড করে ব্লগারদের অর্থ উপার্জনের সুযোগ রয়েছে৷ এছাড়াও স্কুইডো, আর্টিক্যাল টেইলার, ইহাহু কনট্রি বিউটির নেটওয়ার্ক, ব্লগিং ডট অর্গ, ডিজিটাল জার্নাল, এবাউট কম ইত্যাদি সাইটে ব্লগিং ও এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব৷

ব্লগ কত প্রকার ?
০১৷ পার্সোনাল ব্লগিং (পরিবার, ভ্রমন, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, সংগীত)
০২৷ বিজনেস (যে কোন প্রকার ব্যবসা-বানিজ্য, শিল্প)
০৩৷ স্কুল (স্কুল, কলেজ, বিশবিদ্যালয়, ছাত্র-শিক্ষক, লেখাপড়া)
০৪৷ নন-প্রফিট (ফাউন্ডেশন, চ্যারিটি, মানবাধিকার গ্রুপ, শিক্ষা, চিকিত্‍সা, গণিত, শিল্প, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, গবেষনা)৷
০৫৷ পলিটিক্যাল (রাজনৈতিক দল, সরকারী প্রতিষ্ঠান, এক্টিভিস্ট)৷
০৬৷ মিলিটারী (সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত)৷
০৭৷ প্রাইভেট (ব্যক্তিগত লেখা, তথ্য, ছবি, পারিবার বা অন্য কিছু সম্পর্কিত)৷
০৮৷ স্পোর্টস (সব ধরনের খেলাধুলা, দল, ফ্যানস)৷
০৯৷ হাউ-টু, টিপস এন্ড রিভিউ (বিভিন্ন অজানা বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহায়তা, রান্না, গান, বই, মুভি)

বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশীদের কিছু ব্লগ সাইট বিশ্বজুড়ে পরিচিতি এবং বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে৷ এর মধ্যে সালমান খান এর ‘খান একাডেমি’ (বিল গেটস যেটি প্রায়শঃই ভিজিট করেন) বিশ্বনন্দিত৷ এছাড়া ‘সামহোয়ার ইন ব্লগ’ বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য লেখালেখির এক বিশাল প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে৷

বর্তমান বিশ্বে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবসাইটে ব্লগ বা ব্লগিং সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের পরিচিতির জন্য এক বিশাল বিসতৃত এবং সহজতর মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে৷ ব্লগিং মানুষের চিন্তা ভাবনা, কথা, মতামত, সাহিত্য,গবেষণা ইত্যাদি প্রকাশের এক অভাবনীয় স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, যা আজ সর্বজন স্বীকৃত৷

মোঃ সামছুল আলম খান- www.windowbangla.com