সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্যের কোনো কূলকিনারা হয়নি দুই বছরেও। নিহতদের পরিবার ও স্বজনরা বলছেন, এ হত্যা মামলায় কার্যকর কেনো তদন্তই হয়নি। হত্যাকাণ্ডের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনি গ্রেপ্তার করার ঘোষণা দেয়া হলেও বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে পার করা হয়েছে দু’বছর। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা কখনো গ্রিলকাটা চোরের পেছনে ছুটেছেন। তারা আবার বলেছেন, রুনির মোবাইল ফোনের যোগাযোগেই হত্যার রহস্য আছে। ডিএনএ (বংশগতির ধারক) পরীক্ষায় প্রতিবেদের সূত্রেও খুনি শনাক্তের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তদন্তকারীরা। আজ মঙ্গলবার দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টিকারী এ জোড়া খুনের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। তবে এখন তদন্তকারীরা বলছেন, তদন্তে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতিই হয়নি।

এদিকে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের দু’বছর পূর্তি উপলক্ষে সাংবাদিক মহল ও নিহতের স্বজনরা দোয়া মিলাদসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, দু’বছরের তদন্তে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাব সাগর-রুনির ফ্ল্যাটে কে কারা ঢুকেছে, তা-ই নিশ্চিত হতে পারেনি। তদন্তের শুরু থেকেই রুনির পরিবার, বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনকে সন্দেহের আওতায় রেখে তদন্তকাজকে স্থমিত করা হয়। একপর্যায় গ্রিলকাটা চোর, দারোয়ান ও রুনির বন্ধুকে ঘিরে তদন্তের গতি বাড়ানো হয়। গ্রেপ্তার করা হয় সন্দেহভাজন আটজনকে। তবে তাদের কাছ থেকে হত্যার মোটিভ উদ্ধার হয়নি। এখন ডিএনএ পরীক্ষায় রহস্যভেদ না হওয়ায় তদন্তেরর গতি আবারও স্থমিত করেছে র‌্যাব।

জানা গেছে, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের পর রুনির ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের কললিস্ট ধরে তদন্ত শুরু করে ডিবি পুলিশ। এ সময় রুনির মোবাইল ফোন থেকে ঘটনার দিন সকাল ৭টা ২৫ মিনিট থেকে সাড়ে ৬ মিনিট আলাপনকে ঘিরে রহস্য দেখা দেয়। তবে নিহত দম্পতির শিশু সন্তান মেঘ ও স্বজনদের বর্ণনায় এ রহস্যের অবসান হয়। তারা জানায়, মেঘই তার মায়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে মায়ের মোবাইল ফোন থেকে নানী নুরুন্নার মির্জাকে ফোন করে।

তদন্তের সময় রুনির মোবাইল ও ফেসবুকে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়েও মুখরোচক গল্প প্রকাশিত হয় দায়িত্বহীন গণমাধ্যমে। তবে এর ফলশ্রুতিতে তদন্তে কোনোই অগ্রগতি হয়নি। এ সময় ডিবির তদন্তদল গ্রিল তত্ত্বেও মনোনিবেশ করে। সাগর-রুনির ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের ছোট একটি গ্রিল বাকানো ছিল। আর সেই গ্রিল দিয়ে চোর ঢুকে দুইজনকে খুন করতে পারে কি না এর মহড়াও দিয়েছে ডিবি। পাঁচ বছরের শিশুর পক্ষে ঢোকা সম্ভব নয় এমন গ্রিলের ফাঁকে পেশাদার এক চোরকে ঢোকানোর চেষ্টা করে দেখেছে ডিবির দল।

এরপর হত্যাকাণ্ডের ৬২ দিনের মাথায় হাইকোর্টে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ডিবি। আদালতের নির্দেশে তদন্তভার গ্রহণ করে র‌্যাব। ২০১২ সালের ২৬ এপ্রিল কবর থেকে নিহত দম্পতির লাশ উত্তোলন করে সংগ্রহ করা হয় ভিসেরা ও ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা। এরপর দুই দফায় নমুনাগুলোর ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে।

সূত্র জানায়, সাগর-রুনির রক্তমাখা জামাকাপড়, বঁটি, ছুরি, মোজা ব্যবহার করা হয় ডিএনএ’র আলামত হিসেবে। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি ডিএনএ রিপোর্টে রুনির কাপড় থেকে তৃতীয় এক ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। তবে অন্তত ১১৬ জনের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে মিলেনি সেই ডিএনএ প্রোফাইল। বিভিন্ন সময় এসব ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে র‌্যাব। তদন্তের সময় সাগর ও রুনির ছেলে মেঘের সঙ্গে কয়েক দফায় কথা বলে তারা। চিকিৎসকের পরামর্শে কাউন্সিলিং করা হয় মেঘের। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মেঘের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্যই মিলেনি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের কাছে আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে অগ্রগতির কথা জানান। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় সাতজনকে। তাদের মধ্যে আছেন- রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর রহমান। গ্রেপ্তার দেখানো হয় ২০১২ সালের আগস্টে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ আসামি রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণকে। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় সাগর-রুনির বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পালকে।

ওই সময় ঘোষণা দেয়া হয় বাসার আরেক নিরাপত্তাকর্মী হুমায়ুন কবীর ওরফে এনামুলকে ধরিয়ে দিলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। গত বছর র‌্যাব এনামুলকেও গ্রেপ্তার করে। যদিও দুই নিরাপত্তা কর্মীকেই আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দিয়েছিল ডিবি। এ আট আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তাদের ডিএনএ নমূনাও পরীক্ষা করা হয়। তবে র‌্যাবের এ প্রচেষ্টায়ও কোনো সফলতা আসেনি।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, কয়েকটি ডিএনএ প্রোফাইল মিলিয়ে কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। এখনো কিছু পরীক্ষা বাকি আছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা আলামত অনেক পরে পরীক্ষা করার কারণে প্রমাণ হারিয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জানতে চাইলে র‌্যাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, সিনিয়র এএসপি জাফরুল্লাহ খান  বলেন, ‘তদন্তাধীন এ মামলার ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না।’

তবে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্নেল জিয়াউল আহসান  বলেন, ‘উল্লেখ করার মতো কিছু পাইনি। ডিএনএ-এর অনেকগুলো রিপোর্টই এসেছে। সেখান থেকে খুনি শনাক্তের মতো কিছু পাওয়া যায়নি।’

সেই ফ্ল্যাটে এখনো তালা:
রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাড়ি ৫৮/এ/২-শাহজালাল রশিদ লজ। এই বাড়িরই চতুর্থ তলায় এ/৪ নম্বর ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হন সাগর-রুনি। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ফ্ল্যাটটির ফটকে এখনো তালা ঝুলছে। ভবনটির ফ্ল্যাট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘তদন্ত হচ্ছে। র‌্যাব মাঝে-মধ্যে আসছে। তবে কী যে অগ্রগতি বা কী আমরা সেটা বলতে পারবো না।’