jessore pic-6 shaiful islam 16.02.14_43916
শোকে পাথর ছোটআঁচড়া গ্রাম

বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সবচে’ মেধাবী শিক্ষার্থী সুরাইয়া আফরিন। পঞ্চম শ্রেণীতে তার রোল নম্বর ১। ছোট বোন মাসুরা আক্তার জেবা একই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাদের মা মনোয়ারা খাতুন দুই বছর আগে মৃতু্যবরণ করেন। এ শোক সামলাতে না পেরে তাদের পিতা সৈয়দ আলী পাগলের মতো হয়ে যান। সেই থেকে বেনাপোলের ছোটআঁচড়া গ্রামে নানা মোমরেজ হাজী সরদারের কাছে থেকেই পড়াশুনা করতো দুই বোন।

স্কুল থেকে বন্ধুরা সবাই পিকনিকে যাচ্ছে। যেতে চেয়েছিল দুই বোনও। মা-মরা মেয়ে দু’টোর বায়না হয়তো ফেলতে পারেনি নানা বাড়ির স্বজনেরা। আসলে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্যই যে দুই বোন বায়না ধরেছিল, কেউ বোঝেনি তখনও। গতকাল রাত ৮টার দিকে চৌগাছা মহেশপুর সড়কের ঝাউতলায় পিকনিকের গাড়ি খালে পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তাদের। একই দুর্ঘটনায় মারা যায় সুরাইয়ার সহপাঠি মিথিলা খাতুন, আখি খাতুন, আশরাফুজ্জামান শান্ত, চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র সাব্বির হোসেন ও রুনা আক্তার। আহত হয় অন্তত ৪০ জন।

নিহতদের মধ্যে সুরাইয়া, জেবা, মিথিলা, শান্ত ও রুনার বাড়ি বেনাপোলের ছোটআঁচড়া গ্রামে। আর সাব্বিরের বাড়ি গাজিপুর ও আখি খাতুনের বাড়ি নমাজ গ্রামে।

আজ সকালে ছোটআঁচড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায় হাজার হাজার মানুষের ঢল। একই পাড়ায় ৪টি বাড়িতে ৫টি শিশুর মৃত্যু। পুরো এলাকায় শোকের মাতম। সুরাইয়া-জেবাদের বাড়ির সামনে মুদি দোকানী আলী হোসেন (৭৫)। চোখের সামনে মেয়ে দুটোকে বেড়ে উঠতে দেখেছেন। মা-মরা মেয়েদুটোর এমন পরিণতির কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে ওঠে তার। একই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র নিজের নাতি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলেন, পিকনিকে যাওয়ার জন্য সেও বায়না ধরেছিল। যেতে দেয়নি।

৭০ বছরের বৃদ্ধ মন্টু মোড়ল বলেন, দুর্ঘটনায় তার পোতা তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ইয়ানুর আহত হয়। মাগরিবের নামাজের পর খবর পান। সাথে সাথে চেৌগাছা হাসপতাল, যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে যশোর সিএমএইচে খুঁজে পান তাকে। সারারাত ছোটাছুটিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন মন্টু মোড়ল। তারপরও নিহতদের স্বজনদের খোঁজ খবর নিতে সকালেই বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। একই পাড়ার মধ্যে সবাই সবার সাথে কোন না কোন আত্মীয়তার সূত্রে গাঁথা। সেই সূত্রেই কাঁদছে পুরো ছোটআঁচড়া গ্রাম।

খবর পেয়ে বেনাপোলের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা সকাল থেকেই দলে দলে ছুটতে থাকেন ছোটআঁচড়া গ্রামের দিকে, নিহতের স্বজনদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে। বেলা ১১টার দিকে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় কবরস্থানের নিরবতা। সুরাইয়া, জেবা, মিথিলা, শান্ত, আখি, সাব্বির, রুনাদের ক্লাসগুলো তালাবদ্ধ। জাতীয় পতাকার নীচে শোকের জানান দিচ্ছে কালো পতাকা। স্কুলের অফিস কক্ষে কথা হয় সহকারী শিক্ষক নার্গিস আক্তারের সাথে। তিনি পিকনিকে যাননি। অধিক শোকে পাথরের মতো বসে আছেন। কি করবেন, কি করা উচিত্, কিছুই বুঝতে পারছেন না। দিনের পর দিন এসব ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছেন, চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখেছেন। এখনও চোখের সামনে ভাসছে সোনামুখগুলো। ওরা তো তারই সন্তান।