5301c047e6cae-03
মনে করেছি, আর বাঁচব না: মৃদুল

আমি জীবনে কারও কোনো ক্ষতি করিনি। মনে করেছি আর বাঁচব না। ভগবান আমাকে বাঁচিয়ে এনেছেন।’
উদ্ধার পাওয়ার পর আবেগাপ্লুত কণ্ঠে এ অনুভূতি প্রকাশ করেন চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরী। অপহূত হওয়ার ছয় দিন পর আজ সোমবার ভোরে কুমিল্লা থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। পরে তিনি তাঁর অপহরণ, শারীরিক নির্যাতন ও মুক্তি পাওয়ার ঘটনার ব্যাপারে বলেছেন।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কংশনগর থেকে মৃদুল চৌধুরীকে উদ্ধার করেন বুড়িচং থানার দেবপুর পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করছিলেন। সকাল ১০টার দিকে দেবপুর পুলিশ ফাঁড়িতে মৃদুল চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, তাঁর ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। মৃদুল চৌধুরীর ভাষ্য, ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রামের নিজ বাসার কিছু দূর থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাঁকে কালো রঙের একটি নোয়া মাইক্রোবাসে তোলা হয়। এর আধা ঘণ্টা পর অন্য আরেকটি গাড়িতে তোলা হয়। এ সময় তাঁকে মুখোশ পরিয়ে দেওয়া হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে তাঁকে লাঠি দিয়ে বেদম পেটানো হয়। শুধু খাবারের সময় তাঁর মুখোশ খুলে দেওয়া হতো। এই ছয় দিন তাঁকে বিভিন্ন স্থানে রাখা হয়েছে। কিন্তু স্থানগুলো সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা নেই। আজ ভোররাত পৌনে চারটার দিকে তাঁকে একটি জিপের পেছনের সিটে তোলা হয়। এ সময় তাঁর দুই পাশে দুজন লোক ছিল। সামনের সিটে ছিল আরও দুজন। কংশনগর বাজারের অদূরে আসার পর তাঁর পাশে থাকা দুজন পরস্পরকে বলে, ‘সামনে পুলিশের গাড়ি আছে। তাঁকে নামিয়ে দিই।’ এ সময়ও তাঁর মুখে মুখোশ ছিল। হাত ছিল গামছা-বাঁধা। মুখোশ খুলে ওই ব্যক্তিরা তাঁর মুখে ঝটপট মলম লাগিয়ে দেয়। সেখানে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। ওই সময় বৃষ্টি হচ্ছিল। আধা ঘণ্টা পর তাঁর জ্ঞান ফেরে। কংশনগর বাজারের উত্তরে পশ্চিম শিং গ্রামে মহাসড়কের পূর্ব পাশের ধানখেত থেকে নৈশপ্রহরী হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া মৃদুল চৌধুরীকে উদ্ধার করেন। নৈশপ্রহরীর মুঠোফোন দিয়ে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে দেবপুর পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার করেন। উদ্ধার হওয়ার খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মৃদুল চৌধুরীর ছোট ভাই শিমুল চৌধুরী ও ফুপাতো ভাই টিটু বণিক কুমিল্লায় পৌঁছান। দেবপুর পুলিশ ফাঁড়িতে বসে মৃদুল চৌধুরী  বলেন, ‘আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। কারও সঙ্গে আমার দ্বন্দ্বও নেই। যাঁরা আমাকে তুলে নিয়েছে, নির্যাতন করেছে, তাদের কাছে আমার অপরাধের বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তারাও কিছু বলতে পারেনি।’

১১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম শহরের পুরোনো টেলিগ্রাফ রোডের বাসা থেকে দোকানে যাওয়ার সময় র‌্যাব ও ডিবি পুলিশ পরিচয়ে মৃদুল চৌধুরীকে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ পরিবারের। এর পর থেকে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ঘটনায় অপহূতের ভাই শিমুল চৌধুরী বাদী হয়ে ওই দিন রাতে নগরের কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে একটি অপহরণ মামলা করেন। অপহরণের সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশ জড়িত বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে র‌্যাব ও পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অপহূত ব্যবসায়ীর ভাই শিমুল চৌধুরীর অভিযোগ, ‘গত বছরের ৩ অক্টোবর র‌্যাব-২-এর মেজর রকিবুল আমিন আমার ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের ৮০ ভরি সোনা কেড়ে নেন। এ ঘটনায় তিনি রকিবুল আমিন, র‌্যাবের সোর্স ফাহাদ চৌধুরী ও গাড়িচালক বাবুল পালের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করেন। মামলা করার কারণে র‌্যাব আমার ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে বলে ধারণা করছি।’

গণমাধ্যমকর্মীর কাছে নির্যাতনের বিবরণ দিচ্ছেন মৃদুল চৌধুরী। ছবি: এম সাদেক, কুমিল্লামেজর রকিবুল আমিন এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। টেলিফোনে তিনি   বলেন, ‘মৃদুল চৌধুরী নামের কোনো স্বর্ণ ব্যবসায়ীর লোকজনের কাছ থেকে ৮০ ভরি স্বর্ণ আমি বা র‌্যাবের কেউ নিইনি। আমি ওনাকে চিনিও না।’

ডিবি পুলিশও মৃদুল চৌধুরী নামের কোনো ব্যবসায়ীকে আটক করেনি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার। মৃদুলের গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীর মিরেরখিল গ্রামে। পরিবার নিয়ে তিনি চট্টগ্রাম শহরে ভাড়া থাকেন। চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের দোতলায় একটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান আছে তাঁর। এ ছাড়া শহরের হাজারী লেনেও তাঁর একটি পাইকারি সোনার দোকান আছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে গলানো সোনা গয়না তৈরির জন্য ঢাকার তাঁতীবাজারে পাঠানো হয়। গত বছরের ৩ অক্টোবর এ রকম ৮০ ভরি গলানো সোনা বেহাত হয়ে যায়। মৃদুল চৌধুরী নিজে বাদী হয়ে এ ঘটনায় ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন। তিনি মামলায় বলেন, গলানো সোনা ট্রেনে করে তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী ও গাড়িচালক বাবুল পালকে দিয়ে ঢাকায় পাঠান। কমলাপুর রেলস্টেশনে এস আলম কাউন্টারে আসার পর র‌্যাব-২-এর মেজর রকিবুল আমিন ও তাঁর সোর্স ফাহাদ চৌধুরী জোর করে বাবুলকে গাড়িতে তোলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর বাবুল পালকে নামিয়ে দিয়ে সোনা নিয়ে চলে যান রকিবুল। তিনি এ কথা জানার পর ফোনে মেজর রকিবুল আমিনের কাছ থেকে সোনা ফেরত চান। রকিব তাঁকে বলেন, যাচাই-বাছাই করে সোনাগুলো ফেরত দেওয়া হবে। এরপর তিনি আর সেগুলো ফেরত দেননি। সর্বশেষ ৩ ডিসেম্বর রকিবুল আমিন তাঁকে ফোনে বলেন, ভবিষ্যতে সোনাগুলো ফেরত চাইলে বিপদ হবে। মামলায় গাড়িচালক বাবুলের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেন ব্যবসায়ী।

আদালত সূত্র জানায়, মুখ্য মহানগর হাকিম এ ঘটনা তদন্ত করার জন্য সিআইডি পুলিশকে নির্দেশ দেন। সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর তদন্ত করছেন। গত ১২ জানুয়ারি সিআইডি পুলিশ র‌্যাবের মেজর রকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বিজয় কৃষ্ণ কর  বলেন, সিআইডি ঘটনার তদন্ত করছে।