রাজশাহীতে জেলে সম্প্রদায়ের তিন শতাধিক মহিলার অর্থনৈতিক সাফল্য

রাজশাহী মহানগরীর রাজারহাতা এলাকার জেলে সম্প্রদায়ের তিন শতাধিক দরিদ্র এবং হতদরিদ্র মহিলা পেপার ব্যাগ বানিয়ে তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রেখেছে। কাগজের ব্যাগের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কাজের চাপও অনেকখানি বেড়ে গেছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে জেলে সম্প্রদায়ের মাছ ধরা পেশা আজ অনেকটা হুমকির সম্মুখীন। তাই বাড়ির মহিলারা এই কাজটিকে গ্রহণ করেছে অনেকটা বেঁচে থাকার তাগিদে।

বর্তমানে এমন কোনো সেবা প্রদানকারী কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই যারা এই কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করছেন না। বিশেষ করে ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ওষুধের দোকানসহ কাপড়ের, কনফেকশনারী, মনোহারী ও টেইলারিং ছাড়াও নানা ধরনের দোকানে কাগজের ব্যাগের ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে গেছে। আর এই চাহিদার অনেকখানি পূরণ করছে এই জেলেপাড়ার দরিদ্য মহিলারা। চাহিদামাফিক মোটা, মাঝারি, পাতলা কাগজের ছোট-বড় রকমারী সাইজের ব্যাগ তৈরী করে তা তুলে দেন অর্ডার প্রদানকারীদের হাতে। কাজের মাঝে পরিপাটির কোনো ঘাটতি নেই। এর মাধ্যমে তারা যে শুধু নিজেদের আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করছে তাই নয়, সাথে সাথে সামাজিক চাহিদাও পূরণ করছে অনেকখানি।

রাজশাহী মহানগরীতে ১১ ক্লাস্টারের আওতায় ১৭২টি কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট কমিটি (সিডিসি)’র মাধ্যমে প্রায় তিন লাখ দরিদ্র ্র জনগোষ্ঠীর জীবন ও তাদের জীবনযাত্রার উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ’নগর অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প (ইউপিপিআর)’ নামক একটি উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে জেলেপাড়া একটি সিডিসি। এই কর্মসূচী কর্তৃক পরিচালিত এক জরীপে দেখা গেছে, এই জেলোপাড়ায় বর্তমানে ১৬৮ পরিবারের বাস। তাদের বর্তমান জনসংখ্যার পরিমাণ ৩৫৩ জন মহিলা এবং ২১০ শিশুসহ মোট ৯৮৫ জন।

সিডিসি’র সাধারণ সম্পাদক অনিতা রানী হালদার জানান, এই ১৬৮ পরিবারের মধ্যে খুব বেশী হলে ৪০ পরিবার আছে যাদের পুরুষরা অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও মাছধরা পেশাকে আকড়ে ধরে আছে এবং বাকীরা অন্য পেশায় চলে গেছে। অন্যদিকে, মোট পরিবারের প্রায় ১৪০টির তিন শতাধিক মহিলা এবং দুই শতাধিক শিশু কাগজের ব্যাগসহ নানান ধরনের ঠোঙ্গা বানানোর কাজে জড়িত আছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন উৎসব তথা ঈদ, পূজা ইত্যাদিতে যখন বাজারে কেনাকাটার পরিমাণ বেড়ে যায় তখন তাদের কাজের চাহিদাও অনেকখানি বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে মহিলারা ব্যাগ বানানোর কাজটি করে থাকে এবং ছেলে বুড়ো অন্যরাও তাদেরকে সহায়তা করে থাকে। তার মতে, একসময়ে এই জেলেপাড়ার মানুষ শুধুমাত্র মাছ ধরার কাজে জড়িত থাকলেও কালের বিবর্তনে আজ তাদের অনেকেই পূর্বপুরুষদের পেশা ত্যাগ করতে কেবল বাধ্য হননি, অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। দেখা যায়, তাদের পুরাতন এবং ভাঙ্গাচোরা বাড়িগুলোকে ক্রমেই কোণঠাসা করে দিনে দিনে গড়ে উঠছে অনেক বহুতল ভবন। শুধুমাত্র এই জনগোষ্ঠীর লোকেরাই বাস করছে সরু গলি, ঘনবসতি, ছোট ছোট বাড়িতে। অনেক লোকের গাদাগাদি অবস্থান, ঘিঞ্চি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং সর্বত্রই একটি দরিদ্র ও হতদরিদ্রের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারো কারো বাড়িতে খাট-টেলিভিশন থাকলেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অনেক কিছু থেকেই তারা বঞ্চিত।

এরপরও আশাব্যঞ্জক যে, বর্তমানে তারা ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করানোর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে, আগে যেখানে খোলা পরিবেশে মলত্যাগ করতো আজ তারা স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাল্যবিয়ে কিছুটা কমলেও যৌতুককে ‘না’ বলতে পারছেনা তাদের অনেকেই। বিধবা বাসন্তি হলদার (৫২) জানান, তার দুই মেয়ের সহায়তায় দিনে প্রায় ৩শ’ ব্যাগ বানাতে পারে, তাতে আয় হয় ৬০ টাকা। পাশাপাশি বাসাবাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
রেনু বালা (৪৭) নিজে ব্যাগ বানান এবং ৪ হাজার ৫শ’ টাকার অনুদান পেয়েছিলেন প্রকল্প থেকে তা দিয়ে কেনা একটি পুরাতন রিকশা বর্তমানে তার ছেলে চালিয়ে সংসারের খরচ চালাচ্ছে। বসতি উন্নয়ন তহবিলের আওতায় সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য দুটি নলকূপ বসানো হয়েছে। পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি কমিউনিটি ল্যাট্রিন স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য। তার মধ্যে কোনো কোনোটি ৪-৫ টি পরিবার যৌথভাবে ব্যবহার করে থাকে।

আর্থ-সামাজিক তহবিলের আওতায় ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য ২৫ জন মহিলাকে এবং শিক্ষা সহায়তার জন্য ১৫ জন শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে দেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৫শ’ টাকা করে আর্থিক সহায়তা। এছাড়াও নগর খাদ্য উৎপাদন কর্মসূচীর আওতায় ২৫ সদস্যের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে দুটি করে ছাগলসহ প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ। এখানকার আরেক বাসিন্দা সুপলা হালদার জানান, এক ছেলে সিটি সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছে, তার মেয়েটি পড়ছে স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে।
জেলেপাড়ার প্রধান ব্যক্তি সমর হালদার জানান, আমাদের বাপ-দাদাদের অনেকেই প্রভাবশালীদের প্ররোচণায় নিজেদের ভিটেমাটি এমনকি দামী দামী পুকুর তুলনামূলকভাবে অনেক কমদামে বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছে। আর এ ধরনের প্ররোচণা যে বর্তমানে থেমে গেছে, তা কিন্তু নয়। তবে বিভিন্ন আয়-রোজগারের ফলে মানুষ বর্তমানে অনেকটা সচেতন হয়েছে। তাই এই প্রবণতা অনেকখানি কমে গেছে।

ড. আইনুল হক – বাসস