1দৈনিক বার্তা: বান্দরবানের সর্বত্রই অবাধে তামাক চাষ হয়েছে চলতি মৌসুমেও। কেবল লামা ও আলীকদম উপজেলাতেই আবাদকৃত তামাক পাতা শুকানো বা প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে তৈরি করা হয়েছে কমপক্ষে ৩ হাজার চুল্লি। এসব চুল্লিতে অবাধে ব্যবহার হচ্ছে প্রতিদিনই শত শত মণ অবৈধ জ্বালানি কাঠ।

জেলার লামা ও আলীকদম উপজেলার মাতামুহুরী, নদীর চর, তীর, খাল-বিল এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর জমিও রক্ষা পায়নি তামাক চাষ থেকে এ মৌসুমে। মাঝারি উঁচু, মাঝারি নিচু এবং নিচু ভুমির সর্বত্রই অবাধে তামাক পাতার আবাদ হওয়ায় শাক-সবজির আবাদ ২ শতাংশ জমিতেও নেই বলে জানা গেছে।
তামাক কোম্পানী গুলোর আগাম দাদন প্রদান এবং লোভনীয় বিকিকিনির আশ্বাসবাণীর কারণেই ফি বছর বান্দরবান জেলার লামা আলীকদম উপজেলার ব্যাপক জমিতে ক্রমশ তামাকচাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ ২টি উপজেলার মোট ফসলি জমির ৯৮ শতাংশই তামাক চাষে ভরে গেছে। মাত্র ২ শতাংশ জমিতে শাক-সবজির আবাদ হয়েছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবে দেড়শতাংশ জমিতে চাষ হয়েছে সবজি ও মসলাজাতীয় কৃষিপণ্যের। জেলায় সাকুল্যে প্রায় ১৮ হাজার একরের জমিতে এবারও তামাক চাষ হয়েছে বলে  বিভিন্ন উপজেলা থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে।
লামা ও আলীকদম উপজেলায় ১৯৮০ সাল থেকেই মুলত তামাক চাষের আগ্রসন শুরু হয়। চলতি মৌসুমে এ ২টি উপজেলায় প্রায় ৯৮ শতাংশ জমিতে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৭০ শতাংশ জমিতে, বান্দরবান সদর এবং রোয়াংছড়ি উপজেলায় ৬০ শতাংশ জমিতে, রুমা এবং থানছি উপজেলার প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে এবারও তামাক চাষ হয়েছে বলে চাষীদের দাবি। রুমা ও থানছি উপজেলায় কৃষি জমির পরিমাণ গড়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশ। এর ওপর রয়েছে তামাক চাষের আগ্রাসন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, জেলার ৭টি উপজেলায় জুম আউশ, রোপা আমন, বোরো এবং রোপা আউশ চাষের জমির পরিমাণ ২৯ হাজারন ৭৭৩ হেক্টর। এর মধ্যে তিন ফসলি জমি ৩১৭২ হেক্টর, দুই ফসলি জমি, ১৫ হাজার ৪৭৮ হেক্টর এবং এক ফসলি জমির পরিমাণ ২৮ হাজার ৯৩০ হেক্টর। নীটফসলি জমির পরিমাণ ৪৭ হাজার ৫৮০ হেক্টর বলে জানানো হয়েছে।  তবে তামাক পাতার চাষের তথ্য না থাকলেও কৃষি বিভাগের আনুমানিক হিসেব মতে প্রতিবছরই শুস্ক মৌসুমে গড়ে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাক চাষীদের তথ্য মতে ফিবছরই জেলায় তামাক চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৬বছরে এ জেলায় কমপক্ষে ৫ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। লামা উপজেলা প্রশাসন, থানা প্রশাসন চত্বর,সেনা ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নাকের ডগাতেই বিপুল জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কতিপয় কর্তা কোন কোন এলাকায় প্রতিমৌসুমে তামাকচাষের জন্য চাষীদের কাছে জমি ইজারা প্রদান করে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বৃটিশ-আমেরিকা টোবাক্যো কোম্পানী লি, ঢাকা টোবাক্যো এবং আবুল খায়ের টোব্যাকোসহ ১২টি তামাক কোম্পানীর ছত্রছায়ায় জেলায় অবাধে তামাক চাষ হচ্ছে।
জেলার জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন শ্রেণীর নেতৃবৃন্দ এবং আদিবাসী সমাজ নেতারা বলছেন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত মাসিক আইনশৃংখলা কমিটি এবং সমন্বয় কমিটির সভাগুলোতে বহুবার আলোচনা হয়েছে- বিকল্প কৃষি পণ্যের আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাক চাষ কমিয়ে আনার বিষয়ে। দুই বছর আগে জেলা জজ আদালতের এক রায়ে জেলায় তামাক চাষ সীমিতকরণ এবং তামাক চাষের বিকল্প কৃষি চাষ বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের  প্রতি নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্ত বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে তামাক চাষ সীমিতকরণ তো হয়নি, বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও স্থানীয়রা অভিযোগ জানিয়েছেন।
বিভিন্ন সুত্র জানায়, জেলার ইটভাটাগুলোতে লাকড়ি বা কাঠ পোড়ানোর ওপর সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলেও তামাক প্রসেসিংয়ের জন্য নির্মিত প্রায় ৬ হাজার তামাক চুল্লিতে অবাধে কাঠ ও লাকড়ি পোড়ানো হয়। তা বন্ধে সরকারি তরফ থেকে কোন নির্দেশ না নেই। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফিবছরই সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের কয়েক কোটি মণ জ্বালানি লাকড়ি বা কাঠ পোড়ানো হয় ওইসব তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ চুল্লিতে। এসব চুল্লিও বন্ধ করা হয় না পরিবেশ বিনাশী হলেও।
সদর উপজেলার হেডম্যানপাড়া এলাকার তামাকচাষী মংচা মংমা মার্মা বলেন, আগাম টাকা পাওয়ায় তারা তামাক চাষে বেশি ঝূঁকেছেন। কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে যে টাকা মেলে তা লাভজনক নয়।
লামা উপজেলার মেরাখোলা গ্রামের শৈহ্লা মং মার্মা, মধুঝিরি গ্রামের আলী আকবর, রফিক উদ্দন এবং কামাল হোসেন বলেন, তারা বিগত দুইযুগ ধরেই তামাক চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তবে তারা কৃষি পণ্য চাষের জন্য আগ্রহী হবেন যদি সুবিধাজনক ও চাহিদা মতে কৃষি উপকরণসহ প্রয়োজনীয় অর্থযোগান পায়।
জেলা ৃকষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক আবুল কালাম বলেন, মাঠ পর্যায়ে চাষীদের উদ্বুদ্ধকরণসহ প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, জেলায় আগের চেয়ে কম চাষ হচ্ছে তামাক পাতার। কৃষি উপকরণ ও বিজ প্রদান ছাড়াও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে চাষীদের।