7দৈনিক বার্তা :  এই লেখাটি যখন লেখা হচ্ছে, ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে অন্তত ১২ জন অপহরণ হয়েছেন,গোটা দেশ জুড়ে এখন একটি ভয়-আতংকের সংস্কৃতি তৈরি হয়ে আছে। এই ভয়-আতংক মূলত: অদৃশ্য এক শক্তির কারনে। ১৯৭১ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত এই ভয়ের সংস্কৃতি তাড়া করে ফিরছে সাধারন মানুষকে। রাজনীতির রক্তাক্ত পথ পরিক্রমায় ভয় তাড়ানোর নামে ভয় বাড়ানোর সংস্কৃতিই আতংকিত করে রেখেছে মানুষকে। এই ভয় থেকেই গড়ে ওঠা অন্ধকার জগতের সীমাহীন নিকষ কালো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের। এই সংস্কৃতিতেই বেড়ে উঠছে সব রকমের সন্ত্রাস, মৌলবাদ আর চরমপন্থা। ঘন অন্ধকারে সুযোগ নিচ্ছে ডান-বাম-মৌলবাদ আর ধর্মীয় গোষ্ঠিগুলো। অপহরন, গুম, খুন হয়ে যাচ্ছে একের এক মানুষ। বিপন্ন হয়ে পড়ছে গণতান্ত্রিক সকল সংস্কৃতি। যে কোন গণতান্ত্রিক রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হচ্ছে, অন্ধকারের এইসব প্রাণী’রা। এরা সক্রিয় হয়ে উঠলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিপন্ন হয়। এই বিপথ থেকে প্রায় কেউ রক্ষা পায় না। সবার আগে চরম বিপদ নেমে আসে সাধারনের ওপর। ভয়-অন্ধকারের হাত ধরে জন্ম নেয় অগণতান্ত্রিকতা। অস্ত্র আর পেশী শক্তি অন্ধকার রাজ্যের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। সরকার তখন জনগনের পাশে দাঁড়ানোর বদলে অনেকটা মেরুদন্ডহীন হয়ে সবকিছুকে আড়াল করতে চায়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বর্তমান সরকার সেই ভয় আর অন্ধকার নিয়ে খেলতে গিয়ে গোটা জনগোষ্ঠিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

নিরাপত্তা নেই জনজীবনে। আতংকের জনপদে সর্বত্রই অস্থিরতা। বড় ভয়-আতংক, কে কখন হারিয়ে যায়, নিখোঁজ হয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষ এর প্রত্যক্ষদর্শী ৪৩ বছর ধরে। দশম সংসদ নির্বাচনের ভয়ের ভোট এমন এক একক জয় এনে দিয়েছে ক্ষমতাসীনদের, যা তাদের ভয় দুর করলেও জনগনের ভীতি দুর করতে পারেনি। বরং ক্রমশ নিরাপত্তা ঝুঁকি দিনকে দিন বাড়ছে। রাষ্ট্র-সরকার এখন জনগনের নিরাপত্তার প্রশ্নটি ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার দিকে। ভয় আর ক্ষমতার মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক লক্ষ্য করছে জনগন। সরকার বদলে দিচ্ছে রাষ্ট্রের চরিত্র। ভয় তাড়ানোর উপকরন দৃশ্যত কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক বাতাবরনে একটি গোষ্ঠিতান্ত্রিক চেহারা দেবার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ভয়-আতংককে বিকাশমুখী করে এটি দুর করার প্রক্রিয়াগুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য করে দেয়া হচ্ছে। শাসকশ্রেনীর আচরন বদলে গিয়ে শোসকের আচরনে রূপান্তরিত হচ্ছে। মূলত: এই প্রবনতাই সকল ভয় এবং আতংকের উৎস হয়ে উঠছে। জন্ম নিচ্ছে অন্ধকার জগতের প্রাণীরা, বেড়ে উঠছে বহাল তবিয়তে। ফলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত একাকার হয়ে যাচ্ছে এবং দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সাধারন মানুষের স্বার্থের বিপক্ষে।

গত দুই দশকে এসবই ঘটছে গণতান্ত্রিক শাসনের নামে, সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির বাতাবরনে। বিভিন্ন জেলায়-উপজেলায় দুর্বৃত্ত পরিবারতন্ত্রের উদ্ভব ঘটছে, যারা ক্ষমতার নামে নিয়ন্ত্রন করছে সব, সহায়তা দিচ্ছে অন্ধকার জগতের প্রাণীদের। ভয়ের সংস্কৃতি চালু রাখতে অতীতের মত খুন, গুম, অপহরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। এর ফলে অতীতের ধারাবাহিকতাটি অব্যাহত থাকছে। অতীতে কখনও সামরিক শাসনের নামে, কখনও একদলীয় শাসনের নামে ভয়ের এই প্রবনতা অব্যাহত ছিল। আমরা স্মরণ করতে পারি, এই স্বাধীন বাংলাদেশে দু’জন রাষ্ট্রপতিকে খুন করা হয়েছে। খুন হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডাররা, নিখোঁজ হয়ে গেছে অনেক সামরিক-বেসামরিক মানুষ। গ্রেনেড হামলায় বিরোধী দলীয় নেতাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে। পিলখানা ট্রাজেডিতে সেনাবহিনীর অনেক কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। ভয়াল অন্ধকারের এই ঘটনাগুলো কখনও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনে, কখনও রাষ্ট্রের ভেতরে প্যারালাল কোন শক্তির মাধ্যমে ঘটেছে। এসব ঘটনা ভয়-আতংক আর অন্ধকারের সংস্কৃতিকে পুষ্ট করে তুলছে দিনকে দিন।

এই লেখাটি যখন লেখা হচ্ছে, ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে অন্তত ১২ জন অপহরণ হয়েছেন। তার অব্যবহিত পূর্বে নারায়নগঞ্জে আরো পাঁচটি অপহরনের ঘটনা ঘটেছে। সারাদেশ আজ আতংকিত, শংকিত। আর নারায়নগঞ্জ হয়ে উঠেছে খুন, গুম, অপহরনের উপত্যকা। একটি বিশেষ পরিবারের নিয়ন্ত্রনে নারায়নগঞ্জের অন্ধকার জগত নিয়ন্ত্রিত হয়। ত্বকী হত্যার পরে পুলিশের চার্জশীটে তাদের দিকে অঙ্গুলী উত্তোলিত হলেও রাষ্ট্র-সরকার নিরুত্তাপ। ফলে, রাষ্ট্র-সরকার এবং তার বাহিনীগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও প্রমান জনগনের সামনে উপস্থাপন না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগনের ভয়-আতংক কমবে না। গুজব ছড়াতে থাকবে যে, যাদের ওপরে রক্ষকের দায়িত্ব তারাই ভক্ষক সেজে বসে আছে কিনা? কারন, সরকার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনীহা দেখালে, ঘটনাকে অস্বীকার করলে, গোঁজামিল দিলে মানুষের মধ্যে কেবল রহস্য আর প্রশ্নের জন্ম হতে থাকবে। অপহরন, গুম ও বিচার বহির্ভূত খুনের যে সংস্কৃতি গড়ে তোলা হচ্ছে, সেটি কি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনে ঘটছে? রাষ্ট্র কি কার্যকর রয়েছে নাকি রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য অন্ধকারের শক্তিরা এগুলি ঘটিয়ে চলেছে? এ সকল প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর রাষ্ট্র-সরকার দিতে না পারলে সকল দায়ভারই তাদের বহন করতে হবে।
সাধারনত কোন দুর্ঘটনার দায় সরকার নিতে চায় না। অন্তত বাংলাদেশে তো নয়ই। তবে সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এরকম নজির প্রচুর রয়েছে। এরকম একটি নজির স্থাপন করেছেন দক্ষিণ কোরিয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী চ্যাং হং-উন। ফেরিডুবি রোধে ব্যর্থতায় প্রানহানি ও উদ্ধার তৎপরতায় ধীরগতির দায় মাথা পেতে নিয়ে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে এটি একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। পদত্যাগের সময় তিনি যে কথাগুলো বলেছেন সেটি আরো প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ফেরিডুবির পর ১০ দিনেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, কিন্তু যারা এখনও তাদের হারানো স্বজনদের খুঁজে পাননি, তাদের কান্নায় রাতে আমি ঘুমোতে পারি না। কতোটা গণতন্ত্রমনা হলে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে তার দেশের জনগনের পাশে দাঁড়াতে পারেন-আমাদের দেশের দিকে তাকালে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়।
গেল বছর উত্তর ইউরোপের দেশ লাটভিয়া এরকম একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। রাজধানী রিগাতে একটি সুপার মার্কেটের বিপনী বিতান ধ্বসে ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনার দায়ভার মাথায় নিয়ে ঐ বছর ২৭ নভেম্বর পদত্যাগ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভ­াদিমির দমব্রভস্কি। শুধু তাই নয়, তিনি মন্ত্রীসভাও ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। পদত্যাগের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিপর্যয় এবং সার্বিক পরিস্থিতিতে এখন একটি নতুন সরকার প্রয়োজন, যার প্রতি পার্লামেন্টের পূর্ন সমর্থন রয়েছে। দেশের প্রেসিডেন্ট এ দুর্ঘটনাকে হত্যাকান্ড বলে অভিহিত করেছিলেন। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে বিপনী বিতানটির নকশা ঠিকভাবে করা হয়নি এবং নির্মানে মানসম্মত উপকরনও ব্যবহৃত হয়নি।
বাংলাদেশে রানা প্লাজা ‘গণহত্যার’ ঘটনায় আমাদের সাবেক আমলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ঝাঁকুনি তত্বটি’ আিবষ্কার করে ফেলেছিলেন। এই বিশাল ভবন ধ্বসে যখন হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, আরো হাজার হাজার চাপা পড়ে মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে সে সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতির সংগে এই ভয়ংকর তামাশাটি করেছিলেন। তার মতে, হরতালকারীরা রানা প্লাজার পিলার ধরে নড়াচড়া করায় ভবনটি ধ্বসে পড়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল এই ব্যক্তিটির এ রকম ভয়ংকর তত্ত্বে সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেছিলেন, না হলে এ ধরনের বক্তব্যের পরে নিজে পদত্যাগ না করলেও অন্তত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পদত্যোগের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের কিছুটা হলেও মুখ রক্ষা করতে পারতেন। রানা প্লাজার নৃশংসতার পরে উদ্ধারকার্য সম্পর্কে ফি বছর আর কিছুই বলার নেই। তবে, ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর পূনর্বাসন নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন একাধিকবার হুমকি দিয়েছে। সরকার অবশ্য গোটা বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটচাল হিসেবে দেখতে চেয়েছে।

লাটভিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রীরা পদত্যাগ করলেন কেন? একটি বিপনী বিতান ধ্বসে ৫৪ জনের মৃত্যু অথবা ফেরিডুবিতে শত শত মানুষের নিহত হওয়ার ঘটনার পর নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করে তারা পদত্যাগ করলেন। প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, এ মৃত্যুর ঘটনাগুলির সাথে প্রধানমন্ত্রীদের সরাসরি কোন যোগ নেই। তবু তারা পদত্যাগ করলেন কেন? এখানেই রাজনীতির সাথে নীতি ও নৈতিকতার বিষয়টি বড় হয়ে ওঠে। একজন প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান নির্বাহী, মূল ব্যক্তি। সুতরাং দেশের ভেতর যদি কোন অনিয়ম বা অবহেলার কারনে একটি মানুষেরও মৃত্যু ঘটে, তাতে প্রধানমন্ত্রী বা তার সরকারের নৈতিক দায়িত্ব থাকে। সে কারনেই নৈতিকতার সকল দায় মাথা পেতে নিয়ে একজন দম্রভস্কি কিংবা একজন চ্যাং হং-উন পদত্যাগ করেন। এটি গণতন্ত্রের, সুশাসনজনিত রাষ্ট্রাচারের নমুনা। প্রধানমন্ত্রীর কোন সম্পৃক্ততা নেই, অথচ তিনি এর দায়-দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে নিয়ে প্রমান করলেন, রাজনীতিতে, রাষ্ট্রাচারে এটিই হচ্ছে নৈতিকতা। এটিই হচ্ছে সুনিয়ম, যা গোটা জাতিকে গণতন্ত্র চর্চায় উজ্জীবিত করে, সুশাসনের প্রকৃত সুবাস জনগনের কাছে পৌঁছে দেয়।

প্রতিবেশি দেশ ভারতেও রেল দুর্ঘটনার দায় নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা আমাদের জানা রয়েছে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ঘটনাটি ঠিক তার উল্টো। দেশে যতই মানুষ মরুক, মানুষের জীবনের আদৌ নিরাপত্তা না থাকুক-রাজনীতিবিদদের তাতে কোন নৈতিক দায় নেই। তারা ব্যর্থতার কোন দায়ভার স্বীকার করেন না। রাষ্ট্রাচার বিবেচনায় নেন না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতা এবং যে কোন প্রকারে ক্ষমতায় টিকে থাকা। জনগনের রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার মসনদে বসতে চান অথবা আঁকড়ে ধরে থাকেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে অচলাবস্থা তার মূল কারন হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিবিদদের অনৈতিক ও দুর্বার ক্ষমতালিপ্সা। আর এ জন্য তারা কখনও দোহাই দেন সংবিধানের, কখনও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার কিংবা নিয়ম রক্ষার। এই দুর্বল, হীন, অনৈতিক, জিঘাংসাপ্রবন রাজনীতির জন্য কোন শিক্ষাই কি বয়ে নিয়ে আসবে না লাটভিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের এই রাষ্ট্রাচার ও নৈতিকতা? উত্তর হচ্ছে, না, আপাতত: মোটেই না