4দৈনিক বার্তা  :দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে ডিম সংগ্রহকারীদের হতাশ করে ডিম ছাড়ল কার্প জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছ। অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে মেঘের গর্জন ও প্রবল বর্ষনের ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে সৃষ্ট স্রোতে গত রবিবার (১১ মে) রাত ৩টায় ডিম ছেড়েছে মা-মাছ। ডিম সংগ্রহের পরিমাণ কম হওয়ার কারণে ডিম সংগ্রহকারীদের মাঝে হতাশার চিত্র পরিলক্ষিত হয়।

ডিম ছাড়ার স্থান সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গত রবিবার (১১ মে) রাত ৩টায় থেকে ভোর ৫ পর্যন্ত প্রায় দেড় সহস্রাধিক ডিম সংহকারীরা ৩০০-৩৭০  নৌকা ও জাল নিয়ে হালদার হাটহাজারী ও রাউজানের দুই অংশের সাত্তার ঘাট, নয়াহাট, মেখল কাটাখালীর টেক, গড়দুয়ারা পাতাইজ্যার টেক, আজিমার ঘাট, আমতোয়া, উত্তর মাদর্শা মাচুয়া ঘোনা, রহমত ঘোনার টেক, রামদাশ্যার হাট, দক্ষিণ মাদার্শা আমতলী ও রাউজানের কচুখাইন, সার্কদা,মোকামী পাড়া,উরকির চর,আবুর খীল,মগদাই,কাগতিয়ারটেক, উরকিরচর,কাগতিয়া কাসেম নগর, পশ্চিম বিনাজুরী, কলিপা ঘোনা, বাড়িয়া ঘোনা, মইশকরম, নাফিতের ঘাট, পুরালিয়া খাল দক্ষিণ গহিরা, মোবরক খীল, মঘাশাস্ত্রি বড়ুয়া পাড়া, অংকুরী ঘোনা, বদুর ঘোনা, কোতোয়ালী ঘোনা, নদীম পুর, পশ্চিম নদীমপুর, পশ্চিম ফতেহনগর এবং নগরীর মোহরা এলাকায় বিভিন্ন স্পটে জেলেরা ডিম আহরণ করেছে।

ডিম সংগ্রহকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হালদা নদীর গড়দুয়ারা নয়াহাট, অংকুরী ঘোনা ও মদুনা ঘাট এলাকায় ডিম সংহকারীরা বেশি পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছে। এ সময় প্রতিটি নৌকায় গড়ে ৩-৪ বালতি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করলে নদীতে ডিম ছাড়ার পরিমাণ কম হওয়ায় অনেকেই খালি হাতে তাদের পল্লীতে ফিরে যেতে দেখা গেছে। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী বছরগুলোতে এক একটি নৌকায় দশ থেকে পনের বালতি উপর ডিম সংগ্রহ করেছিল ডিম আহরণকারীরা। এতে করে ডিম সংগ্রহকারী ডিম আহরণকারীদের পল্লীতে খুশির আমেজের পরিবর্তে দেখা গেছে হতাশার চিত্র।


ডিম সংগ্রহকারী মো: কামাল উদ্দিন সওদাগর জানান, এ বছর হালদায় নদী থেকে আমি প্রতিটি নৌকায় গড়ে প্রায় ৫-৬ বালতি কওে ৬টি নৌকায় প্রায় ৩০ বালতি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করেছি। তবে এবার যতটুকু ডিম সংগ্রহ করেছি তা অন্যান্য বারের তুলনায় একটু কম।

এদিকে বিগত ও বর্তমান সময়ে হালদা নদীতে নির্বিচারে মা-মাছ নিধন, হালদার বাঁক কাটা, ডিম ছাড়ার পরিবেশ নষ্ট, রাবার ড্যাম ও এশিয়ান পেপার মিলের বর্জ্য হালদা নদীতে পতিত না হত তা হলে আরো অধিক পরিমাণে ডিম ছাড়ত মা-মাছ বলে মনে করেন হালদা নদী বিশ্লেষকরা।

মাদার্শা এলাকার মাছুয়াঘোনা হ্যাচারীর সহকারী ছোটন দাশ এই প্রতিবেদককে জানান, অন্যান্য বারের তুলনায় মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ কম। এতে করে ডিম সংগ্রহকারীদের চাহিদা সম্পূর্ণরূপে মিটেনি। তবুও ডিম সংগ্রহকারীদের সংগ্রহিত ডিম রেনুতে পরিণত করতে হ্যাচারীতে আসার তোড়জো বেশ চোখে পড়েছে।

অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর মা-মাছেরা বিশেষ করে গড়দুয়ারা নায়াহাট এলাকায় থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত পর্যন্ত ডিম ছেড়েছে। ম-মাছ ডিম ছাড়ার পর নাদীতে ভাটাঁ হওয়ায় নদীর নিচের দিকে সমস্ত হালদা নদীতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি নৌকায় গড়ে ২ থেকে ৩ বালতি পর্যন্ত প্রতি নৌকায় কম বেশি ডিম সংগ্রহ করেছে ডিম সংগ্রহকারীরা। সেই হিসাবে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমান ১১০২ বালতি বা ১৬ হাজার ৫০০ কেজি পর্যন্ত। আর এই সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম থেকে রেনু উৎপাদন হবে প্রায় ২৫০-২৭৫ কেজি। আর ওই উৎপাদিত রেনুর বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি প্রায় ৩৫-৪০ হাজার টাকা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও হালদা গবেষক মনজুরুল কিবরিয়া সাথে এই বিষয়ে আলাপকালে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে হালদায় প্রবল বর্ষন ও মেঘের গর্জনে স্বাভাবিক অবস্থায় ডিম ছেড়েছে মা-মাছ। নদীতে ডিম সংগ্রহকারীরাও প্রস্তুতি ছিল। ডিম সংগ্রহকারীরা আশানুরুপ ডিম সংগ্রহ করতে না পারলেও যা ডিম তারা (জেলেরা) নদী থেকে আহরণ করেছে তাতে তাদের দূদাশা কিছুটা দূরবিত হতে পারে, তাই তারা সন্তুষ্ট।

তিনি আরো জানান, ফটিকছড়ি এলাকায় নির্মিত রাবার ড্র্যাম, অধিক পরিমাণে মা-মাছ নিধন, হালদার বাঁক কাটা, ডিম ছাড়ার পরিবেশ নষ্ট ও এশিয়ান পেপার মিলের বর্জ্য হালদা নদীতে পতিত হওয়ায় এমন প্রতিকুল অবস্থার কারণে মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ আরো বাড়ত।

এই ব্যাপারে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা নাজিম আবদুল্লাহব আল মামুন এই প্রতিবেদককে বলেন, হালদা এবার যে পরিমাণে মা-মাছ ডিম ছেড়েছে কম নয়। তবে মা-মাছেরা যদি আমবস্যা পূর্ণিমাতে ডিম ছাড়ত তাহলে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ বেশি হত। এছাড়া  তিনি দ্বিতীয় দফায় মা-মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়তে পারে বলে নিশ্চিত করেন।

তিনি আরো বলেন, এবার মৎস্য দস্যুরা নির্বিচারে মা-মাছ নিধন করতে পারেনি। তবে মা-মাছ যাতে নিরাপদে ফিরে যেতে পারে এবং কেউ যাতে মা-মাছ শিকার করতে না পারে সে জন্য আমাদের অভিযান তথা পুলিশি টহল অব্যাহত ছিল ও থাকবে বলে তিনি জানান।

এদিকে নদীতে স্বল্প পরিমাণে ডিম সংগ্রহের পর থেকে কৃত্রিম রেনু পোনা উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা তৎপরতা চালাচ্ছে। এতে করে প্রকৃত ডিম সংগ্রহকারীদের মধ্যে আতংকে ভুগছে। কৃত্রিম রেনু পোনা উৎপাদন কারী ও বিক্রেতারা তৎপরতা সর্ম্পকে জেলা মৎম্য কর্মকর্তা ও হালদা প্রকল্প পরিচাক প্রভাতী দেব এর কাছে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, এই রকমের কোন কিছু আমি দেখিনি। আমার দুই উপজেলা দায়িত্বে থাকা মৎস্য কর্মকর্তা সার্বক্ষনিকভাবে হালদা পাড়ে রয়েছে। যদি এরকমের কোন কিছু দেখা যায় তা হলে তারা তাৎক্ষনিকভাবে এই ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহন করবে।