1
Fole Photo

দৈনিক বার্তা : অজপাড়া গাঁয়ের দুঃস্থ ও এতিম শিশুদের মাঝে আবাসন ব্যবস্থাসহ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া ও কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে নিরলস প্রচেষ্ঠা করে যাচ্ছেন দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেন অনাথ শিশু সদন।

হিন্দু অধ্যুষিত বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বড়াকোঠা ইউনিয়নের চৌধুরীরহাট মালিকান্দা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এলাকার শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে বাস্তবে রূপ দিতে সমাজকে ফুলের মতো করে সাজাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ফুলের মালা সমাজ কল্যান সংঘ। গত ১৬ বছর ধরে ওই সংঘের সদস্যরা এলাকার নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অবদান রেখে যাচ্ছেন।

সরেজমিন ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপকালে ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিট্রিশ শাসনের নাগপাশ থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে আত্ম উৎসর্গকারী অগ্নি যুগের অগ্নি পুরুষ চির কুমার বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেনের স্মৃতি ধরে রাখতে ওই গ্রামের মৃত হরিপদ রায়ের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা রনজিত কুমার রায় ১৯৮৩ সালে নিজের ১ একর ৭৩ শতক সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন হরিসভা সেবাশ্রম। যা পরবর্তীতে উজিরপুর উপজেলা কেন্দ্রীয় হরিসভা সেবাশ্রমে পরিনত হয়।

একে একে সমাজের অবহেলিত অসহায়, দুঃস্থ ও অনাথ শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে রনিজত কুমার রায় পর্যায়ক্রমে হরিসভা সেবাশ্রমের পার্শ্বেই প্রতিষ্ঠা করেন মাষ্টারদা সূর্যসেন অনাথ শিশু সদন, কারিগরি প্রশিক্ষণ দুঃস্থ ও এতিম পূর্ণবাসন কেন্দ্র, দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজ ও পরীক্ষা কেন্দ্র, রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ মন্দির ভিত্তিক শিশুশিক্ষা ও পাঠাগার, উত্তর মালিকান্দা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ফুলের মালা সমাজ কল্যান সংঘ। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানই সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে অনুমোদনসহ রেজিষ্টেশন লাভ করে। এছাড়াও এসব প্রতিষ্ঠানের সম্মুখে রনজিত রায়ের সম্পত্তিতে সরকারি অর্থে নির্মিত হয় কমিউনিটি ক্লিনিক।

রনজিত কুমার রায়ের নিজের কর্মদক্ষতা ও উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকার নিরলস প্রচেষ্ঠায় বেশ অল্পসময়েই প্রতিষ্ঠানগুলো এলাকার ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। বর্তমানে শিশু সদনে ৭৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এরমধ্যে দুঃস্থ ২৮ জন, পিতৃমাতৃহীন ৪৪ জন ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছে ৩ জন। সমাজের মহানুভব ব্যক্তিদের আংশিক সাহায্য ও সরকারের আংশিক অনুদান এবং বাকিটা রনজিত রায়ের নিজ খরচেই চলছে হতদরিদ্র অসহায়, পিতৃমাতৃহীন এসব শিক্ষার্থীদের কারিগরি প্রশিক্ষণ, সাধারন শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের বেতনাদি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতিবছর শিশু শ্রেনী থেকে এসএসসি পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করে দীর্ঘ ১৯ বছরে অসংখ্য শিক্ষার্থীরা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এখানে নেই কোন জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ভেদাভেদ। সুশিক্ষা, জ্ঞান ও কর্মধারার মাধ্যমে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে সমাজের অবহেলিত, দুঃস্থ, এতিম শিশুদের দুরাবস্থার বোঝা অপসারণের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে ভালবাসার ব্রতকে সামনে রেখে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যতিক্রমধর্মী এ প্রতিষ্ঠানগুলো। যেখানে নেই কোন কোলাহল, শিক্ষার্থীদের মাঝে নেই কোন জাতিভেদ কিংবা প্রতিহিংসা। মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানামেলে পৃথিবীর উঁচু প্রাচীর ভেদ করে নিজেদের জ্ঞান ও কর্মধারার আলোর পথের খোঁজে এগিয়ে যাচ্ছে এখানকার দুঃস্থ ও অনাথ শিক্ষার্থীরা।

স্থানীয় শাহ আলম বয়াতি, লিটন বাড়ৈ বলেন, ‘অজপাড়া গাঁয়ের এ প্রতিষ্ঠানটি একাধিক মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে পরিদর্শন করেছেন সমাজের অনেক মহানুভব ব্যক্তিরা। তারা শুধু পরিদর্শন বইতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে মনভোলানো বাণী লিখে গেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন সহযোগীতার কিন্তু পরে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলো জরার্জীণ হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অর্থাভাবে তা পূর্ণনির্মান করা সম্ভব হচ্ছেনা’।

সর্বশেষ বিগত ২০১০ সালের ১৩ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির সম্মুখে স্থায়ীভাবে নির্মিত মাষ্টারদা সূর্যসেন এর আবক্ষ মুর্তির উদ্বোধন এবং মাষ্টারদা সূর্যসেন অনাথ শিশু সদন, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও দুঃস্থ এতিম পূর্ণবাসন কেন্দ্র ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে আসেন তৎকালীন সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ। ওইসময় মন্ত্রী অজপাড়া গাঁয়ের এ ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগে মুগ্ধ হয়ে দুঃস্থ, এতিম পূর্ণবাসন ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মাষ্টারদা সূর্যসেন অনাথ শিশু সদনের জরাজীর্ণ ভবনগুলো নির্মানের জন্য সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগীতারও আশ্বাস প্রদান করেন। সেমতে বরিশাল গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরেফুর রহমান মন্ত্রীর নির্দেশে উল্লেখিত কাজের খসড়া প্রাক্কলন খানাসহ প্রশাসনিক অনুমোদন ও ১০ কোটি ৪১ লাখ ৮৯ হাজার ৯২৫ টাকার অর্থ বরাদ্দের নিমিত্তে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালকের বরাবরে সুপারিশ করেন। বর্তমানে যা একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

মানব সেবামূলক ব্যতিক্রমধর্মী উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রনজিত কুমার রায় কালেল কন্ঠকে বলেন, একটি অফিস ভবন, দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভবন, একটি কম্পিউটার কক্ষ, একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কক্ষ, একটি গেস্ট হাউজ, দুইটি আবাসিক ভবন, দুটি ডাইনিং ও রান্নাঘর, দুটি বাথরুম জরাজীর্ণসহ অন্যান্য আসবাবপত্রগুলো ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে পরেছে।এছাড়াও অর্থাভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের একজন তত্ত্বাবধায়ক, তিনজন স্থায়ী শিক্ষক, খন্ডকালীন ২২ জন শিক্ষক, একজন মন্দিরের পূজারী, একজন পাচক, একজন দাড়োয়ানের বেতন ভাতা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরো বলেন, সমাজের মহানুভব সমাজপতি, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতা ও নিজ উদ্যোগে জাতির কলঙ্ক মুক্ত ও সমাজের কুসংস্কার দূর করতে চেয়েছিলাম। সেলক্ষ্যে শতাধিক পিতৃমাতৃহীন সন্তানদের শিক্ষা, বস্ত্র, চিকিৎসা, কারিগরি শিক্ষা ও আশ্রয়সহ তিন বেলা খাবারের দায়িত্ব নিয়ে আজ আমি নিঃস্ব হয়ে পরেছি। অনেক ক্ষেত্রেই আজ আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সমাজের অবহেলিত অনাথ ও দুঃস্থ শিশু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা ভবনগুলো নির্মানে তিনি উল্লেখিত কাজের খসড়া প্রাক্কলন খানাসহ প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য একনেকের সভায় উল্লেখিত অর্থবরাদ্দের জন্য প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেও হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।