12দৈনিক বার্তাঃফেনীর ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হক একরাম হত্যার নেপথ্যে ঘুরেফিরে ফেনী-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য নিজামউদ্দিন হাজারীর নামই উঠে আসছে। স্থানীয়দের ধারণা, একরামের সঙ্গে নিজামের রাজনৈতিক বিরোধের কারণেই নৃশংসতম এ হত্যাকান্ডটি ঘটেছে। ফেনীর সচেতন মহলের সন্দেহের তীরও নিজাম হাজারীর দিকে। তবে নিজাম হাজারী বুধবার দুপুরে দৈনিক বার্তাকে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররাই একরামকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। একটি গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে জড়ানোর চেষ্টা করছে। কিছু মিথ্যা ও বানোয়াট গল্প বানাচ্ছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। এদিকে একরাম হত্যার প্রতিবাদে ফুলগাজী উপজেলায় বৃহস্পতিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এর আগে বুধবার সকাল ৯টায় ফেনী শহরের মিজান ময়দানে একরামুল হকের প্রথম জানাজা, সকাল সাড়ে ১০টায় ফুলগাজীর পাইলট হাইস্কুল মাঠে দ্বিতীয় ও বেলা সাড়ে ১১টায় বন্ধুয়া এলাকায় নিজ বাড়িতে তৃতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরিন আখতার, ফেনী-২ এর সংসদ সদস্য নিজামউদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাজী রহিমউল্লাহ, স্থানীয় ৫ উপজেলার চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, পুলিশ সুপার, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদসহ সব স্তরের হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, একরামুলকে ঠান্ডা মাথায় ও পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলেও জানান তিনি। একরাম হত্যার ঘটনায় ফেনীতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

3
নৃশংসতম এ খুনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপিকে দায়ী করা হলেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরেই একরামুল খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ বিএনপির। দল দুটি অন্যান্য ঘটনার মতোই একে অপরকে দোষারোপ করছে। তবে নৃশংসতম এ হত্যাকান্ডের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি হলো, একরাম খুন হতে পারেন- এমন একটি সংবাদ ঘটনার আগের দিন জয়নাল হাজারী সম্পাদিত স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা হাজারিকা প্রতিদিনে আগাম প্রকাশিত হয়। সংবাদটির শিরোনাম ছিল- ‘নিজাম এখন উভয় সঙ্কটে, প্রতিপক্ষকে খুন ও গুমের পরিকল্পনা হচ্ছে’।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! প্রতিবেদন প্রকাশের একদিন পরই একরামুল হক একরাম সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন। এ খুনের পর ফেনীতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ফেনীর অনেকেই হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন, তাহলে কি নিজাম হাজারীর ক্যাডাররাই একরামকে খুন করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেনীর এক সময়ের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন নেতা ছিলেন একরামুল। জয়নাল হাজারীর হাত ধরেই ১৯৮৩ সালে রাজনীতিতে হাতেখড়ি একরামের। পরে জয়নাল হাজারীর স্টিয়ারিং কমিটির চার ক্ষমতাধর সদস্যের একজন হন তিনি। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে জয়নাল হাজারী ভারতে পালিয়ে গেলে একরামও আত্মগোপনে চলে যান। ২০০৩ সালে ফেনীর দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি নিজাম হাজারীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হন একরাম। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একরাম তার এক সময়ের গুরু জয়নাল হাজারীকে এলাকাছাড়া করতে নিজাম হাজারীর সঙ্গে হাত মেলান; দুজনে প্রভাব খাটিয়ে ফেনীর সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে নেন। এভাবেই ফেনী আওয়ামী লীগের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হন একরাম। শুরু হয় নিজাম হাজারী ও একরামের প্রকাশ্য বিরোধ। সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন একরাম। কিন্তু নিজামের কূটচালে সটকে পড়েন তিনি। তাছাড়া কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত ফুলগাজী উপজেলা নির্বাচনে জেলা তাঁতী দলের আহ্বায়ক মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনারকে সমর্থন দেন নিজাম। এতে বেকায়দায় পড়ে যান একরাম। তবে একরাম উপজেলা নির্বাচনে নিজাম হাজারীর বিরোধিতার জবাব দেন অন্যভাবে। একসময়ের নিজাম হাজারী ও একরামের রাজনৈতিক গুরু জয়নাল হাজারীকে হেলিকপ্টারে করে ফেনী পাইলট হাইস্কুল মাঠে নিয়ে আসেন একরাম। নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নেন একরাম। নির্বাচনের পর নিজাম-একরাম বিরোধ আরও চরম আকার ধারণ করে। একরাম এবং জয়নাল হাজারীর সুসম্পর্কে আতঙ্কিত ছিলেন নিজাম হাজারী। দুজনের কারণে তাকে সব প্রভাব হারিয়ে ফেনী ছাড়তে হবে-এ আশঙ্কাও ছিল নিজামের। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে এ একাডেমি সড়কে নিজের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ফুলগাজী যুবলীগ নেতা আবুল বাশার বৈশ্যাকে হত্যা করে একরাম বাহিনী। বৈশ্যা ফেনী থেকে টেম্পোযোগে ফুলগাজী যাওয়ার পথে পথরোধ করে একরামের নির্দেশে সন্ত্রাসীরা তাকে কুপিয়ে, গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এক যুগ পর একই স্থানে একরামের হত্যাকান্ড নতুন রহস্যের জন্ম দিয়েছে।
একরাম হত্যায় গ্রেফতার ২৩ : একরামুল হক একরাম হত্যায় সন্দেহভাজন হিসেবে ২৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগে একরামুল হকের ভাই বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় জেলা তাঁতী দলের আহ্বায়ক ও ফুলগাজী উপজেলা নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনারকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। পরে ফেনী মডেল থানা পুলিশ হত্যাকারী সন্দেহে বিভিন্ন স্থান থেকে ২৩ জনকে গ্রেফতার করে। এছাড়া হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত সন্দেহে একটি গাড়ি ও দুটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে। এদিকে বিএনপি নেতা মিনারকে মামলায় জড়ানো প্রসঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের কারণে অপবাদ ঘোচাতে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। তিনি বলেন, সব পত্রিকায় হত্যাকান্ডের চাঞ্চল্যকর সংবাদ ছাপানো হয়েছে। ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন হাজারীর অনেক অপকর্ম একরাম জেনে যাওয়ার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মির্জা ফখরুল উল্লেখ করেন। এদিকে হত্যাকান্ডের পর থেকে পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক বলে উল্লেখ করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রকাশ্য রাজপথে একজন জনপ্রতিনিধিকে হত্যা করা হলেও পুলিশ আধা ঘণ্টা পর সেখানে উপস্থিত হয় বলে নেতাকর্মীরা উল্লেখ করেন।
মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১১টায় ফেনী শহরের একাডেমি সড়কে বিলাসী হোটেলের সামনে গাড়িতে গুলি করে ও পুড়িয়ে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও জনপ্রিয় আওয়ামী নেতা একরামুল হক একরামকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় গাড়িচালকসহ আরও চারজন দগ্ধ হন।
ফুলগাজী-পরশুরামে বিক্ষোভ : একরাম হত্যার প্রতিবাদে বুধবার দুপুরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এলাকাবাসী। জানাজা শেষে তারা ফেনী-ফুলগাজী-পরশুরাম সড়ক অবরোধ করে। এ সময় বেইলি ব্রিজের পাটাতন খুলে ফেলে তারা; গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করে রাখে। যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা গণমাধ্যমের গাড়িসহ কয়েকটি যানবাহনও ভাংচুর করে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দ্রুত খুনিদের গ্রেফতার করা না হলে লাগাতার অবরোধ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নেতারা।