3দৈনিক বার্তাঃ  ফেনীর মানুষের মুখে মুখে সপ্তাহব্যাপী ঘুরে বেড়ানো গুঞ্জনটি সত্য হলো। ছককাটা পরিকল্পনা অনুযায়ী নিখুঁতভাবে ঘটলো একটি হত্যাকা-। প্রকাশ্য দিবালোকে, শ’ শ’ মানুষের চোখের সামনে। তিনটি গ্রুপ ভাগ হয়ে কিলিং মিশন সম্পন্নের পর নির্বিঘ্নে সরে পড়লো সন্ত্রাসীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেছে ঘটনা। কিছুটা আঁচও করতে পেরেছে কেউ কেউ। কিন্তু সবার মুখে কুলুপ। ভয়ে-আতঙ্কে কুঁকড়ে গেছে ফেনীর মানুষ। মঙ্গলবার বেলা ১১টার সময় ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে হত্যার পর ফের আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে ফেনী। রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ ফেনীর নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নানা তথ্য। সবার একই কথা, এক বনে দুই বাঘ থাকতে পারে না। প্রভাব-প্রতাপ ধরে রাখার এটি এক নির্মম মরণ কামড়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর টেন্ডার ভাগাভাগিই ফেনীর রাজপথকে করেছে রক্তাক্ত।
জেল-জালিয়াতির প্রতিবেদনই হত্যাকা-ের কারণ!
ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের এমপি নিজাম হাজারী একদা চট্টগ্রামের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আক্তারুজ্জামান বাবুর অনুসারী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। চট্টগ্রামের একটি অস্ত্র মামলায় সাজা হয়েছিল নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে। কিন্তু সাজার পূর্ণ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কারা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে মুক্তি পান তিনি। বিষয়টি যারা জানতেন তাদের অন্যতম হলেন একরামুল হক। আগে দলীয় রাজনীতির কারণে এটা প্রকাশিত হয়নি। সম্প্রতি দুইটি জাতীয় দৈনিকে জেল- জালিয়াতির তথ্য ফাঁস করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ তথ্য ফাঁস হওয়ার পর ঝুঁকির মুখে পড়েন নিজাম হাজারী। একদিকে এমপি পদ বাতিল অন্যদিকে নতুন করে শাস্তি ভোগের আশঙ্কা। নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠজনরা এ প্রতিবেদন প্রকাশের নেপথ্যে একরামের ভূমিকা রয়েছে এমন অভিযোগ তোলে। অন্যদিকে নিজাম হাজারীর জেল- জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হলে তার দলীয় তদবিরকারী আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিম প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিতর্কিত হন। একরামের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, বিষয়টি সমঝোতা করতে লন্ডনে একটি বৈঠক হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী ১৭ই মে ফেনী জেলার এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যান মিলিয়ে একডজন নেতাকে সাক্ষাতের সুযোগ দেন। সে সাক্ষাতে আলাউদ্দিন নাসিমের অনুরোধে জেলার ৪ এমপি ও ৪ উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে একরামও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে নেতারা নিজাম হাজারীর পক্ষে সাফাই গাইলে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বলেন, প্রতিবেদন মিথ্যা হলে মামলা করছেন না কেন। ওদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর একইদিন বিকাল ৪টায় নয়াপল্টনের একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন একরামুল হকসহ কয়েকজন। এ সময় নিজাম হাজারী তাকে ফোন করলে তিনি লাউড স্পিকারে সবাইকে শোনান। সেখানে উপস্থিত একরামের একজন ঘনিষ্ট বন্ধু বলেন, ফোনে নিজাম হাজারী বলেন, অতীতে যা হয়েছে ভুলে যাও। চলো আমরা দুইভাই মিলে ফেনীর রাজনীতিকে গোছাই। একরাম কোন জবাব না দিয়ে মৃদু হাসেন। একরামের ঘনিষ্ঠরা জানান, সেটা ছিল আসলে একরামকে বিভ্রান্ত করার একটি টোপ। এদিকে ওই ঘটনার পর থেকে ফেনীতে আওয়ামী লীগ মহলে একটি অঘটনের আশঙ্কা তৈরি হয়। গত দুই সপ্তাহ ধরে একরামের ঘনিষ্ঠজনদের কাছে গুঞ্জন ছড়ানো হয় একরামকে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। ফেনী জেলা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের অভিযোগ, নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে জেল-জালিয়াতির প্রতিবেদনটিই কাল হয়েছে একরামের জন্য।
দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ও কিছু ঘটনা
রাজনীতিতে একরামের উত্থান জয়নাল হাজারীর হাত ধরেই। জয়নাল হাজারীর আধিপত্য খর্ব হওয়ার পর অন্যরা নিজাম হাজারীর অনুসারী হলেও একরাম ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি নিজাম হাজারীর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখলেও জয়নাল হাজারীকেই মেনে চলতেন। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে নিজাম ও একরাম একসঙ্গেই চলতেন। কিন্তু নিজাম হাজারী ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত ও সদর আসনের এমপি হওয়ার পর প্রভাব নিয়ে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। নিজাম হাজারী কোনভাবেই বেয়াড়া একরামকে মেনে নিতে পারছিলেন না। অন্যদিকে উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একরামকে ঠেকানোও যাচ্ছিল না। প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার একরাম দলের শীর্ষমহলে তদবির ও নানা ঘাটে ম্যানেজ করে একের পর এক প্রকল্প বাগিয়ে নেন। এলাকায় অনেক রাস্তাঘাটের কাজ নিজের টাকায় আরম্ভ করে পরে টেন্ডার করিয়ে নেন। নিজের ফুলগাজী উপজেলা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় তিনি ব্যাপক প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। কিন্তু এককভাবে এ প্রকল্প বাগিয়ে নেয়া ও টেন্ডার নিয়ে নাখোশ হন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। বছর দেড়েক আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডে টেন্ডার নিয়ে একরামের সঙ্গে নিজাম হাজারীর লোকজনের হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৩ সালে সোনাগাজীতে বাঁকানদী সোজাকরণ নামে একটি বড় বাজেটের বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পান একরাম। কিন্তু সে কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজাম হাজারীসহ কয়েকজনকে তাদের নির্দিষ্ট কমিশন দিতে অস্বীকার করেন। এ নিয়ে নিজাম হাজারীর সঙ্গে তার দূরত্বের সূত্রপাত ঘটে। এছাড়া বালুমহাল নিয়ে একরামের সঙ্গে নিজাম হাজারীর অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। উপজেলা নির্বাচনে সে দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটান নিজাম হাজারী। তিনি উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের কাছ থেকে সমর্থন দেয়ার বিনিময়ে মোটা দাগের অর্থ ও সমীহ আদায় করলেও সেপথে হাঁটেননি একরাম। ফলে একরামকে নির্বাচনে হারাতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন হাজারী। ফুলগাজী উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীকে স্বপ্রণোদিত হয়ে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তিনি কয়েকদিন একরামের প্রচারণায় অংশ নেন। উপজেলা নির্বাচনের প্রচারণা চলাকালে দুইবার একরামের গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। নির্বাচনের দিন বকশীবাজার এলাকায় জেহাদের নেতৃত্বে একরামের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করে। এ ঘটনায় রনি নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এসব ঘটনার পেছনে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগেরই কয়েকজন নেতা। উপজেলা নির্বাচনের পর ফেনী ডায়াবেটিক হাসপাতালের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে একরাম জেলা আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতা জাহাঙ্গীর আদেল ও হারুনুর রশিদকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন। এ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হলেও পরে জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের হস্তক্ষেপ করে সেটা মিটমাট করে দেয়। কিছুদিন আগে একরামের ঘনিষ্ঠ কাজীরবাগ যুবলীগ নেতা লোকমানের ওপর হামলা এবং পৌর ছাত্রলীগ নেতা আরমানকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। স্থগিত করা হয় একরামের গঠিত কয়েকটি ইউনিয়ন কমিটি। এ নিয়ে একরামের সঙ্গে নতুন করে দূরত্ব বাড়ে নিজাম হাজারীর। সর্বশেষ নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পর সেটা দৃঢ়তা পায়। একদা জয়নাল হাজারীকে পেশী-প্রভাবে বধ করতে একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সহযোগিতায় ফেনীর রাজনীতিতে সামনে এসেছিলেন নিজাম হাজারী। কিন্তু যিনি সে সময় সহযোগিতা করেছেন পরবর্তীতে তিনিই রাজনৈতিকভাবে বধ হন। ফেনী আওয়ামী লীগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হন নিজাম হাজারী ও একরামুল হক। এলাকাবাসী বলেন, এক বনে দুই বাঘ থাকতে পারে না। একবাঘ আরেক বাঘকে খেয়েছে। এদিকে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে দলীয় কোন্দল এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, হত্যাকা-ের পর ফেনী আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শহরে কোন বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ হয়নি। পরে ফুলগাজী থেকে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা শহরে এসে বিক্ষোভ প্রকাশ করে। গতকাল একরামের জানাজা শেষেও নিজাম হাজারীকে অভিযুক্ত করে ফুলগাজী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্লোগান দেন। যদিও ফেনীতে একরামকে হত্যা করার সময় ঢাকায় আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিমের সঙ্গে ছিলেন নিজাম হাজারী।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দৃষ্টিতে হত্যাকা-: হত্যাকা-ের সময় একরামের সঙ্গে ছিলেন তার মালিকানাধীন পত্রিকার সাংবাদিক মহিবউল্লাহ ফরহাদ, ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন সামু, একরামের ব্যবসায়িক পার্টনার দেলোয়ার হোসেন। একরাম খুন হলেও তারা প্রত্যেকেই আহত হন। মহিবুল্লাহ ফরহাদ জানান, সকালে জেলা ডায়াবেটিক হাসপাতালে নিজের কার্যালয়ে একটি সালিশ মীমাংসা করেন একরাম। সেখান থেকে ফুলগাজী উপজেলা পরিষদে নারী উন্নয়নবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশ নিতে তারা পৌনে ১১টায় রওনা দেন। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বিরিঞ্চি লেভেলক্রসিং পেরিয়ে ২০০ মিটারে এলে শহীদ সালাম স্টেডিয়াম। স্টেডিয়াম পার হওয়ার পর হঠাৎ রাস্তার দু’পাশ থেকে মুখোশধারী কিছু তরুণ গাড়িতে ইট ছুটতে শুরু করে। একরামের নির্দেশে গাড়ির গতি বাড়ানো হলেও সামনে এসে দাঁড়ায় একটি ইজিবাইক টমটম। একরামের প্রাডো জিপের ধাক্কায় টমটম সরে গেলে রাস্তার পাশ থেকে টেনে দেয়া হয় একটি ময়লার ভ্যান। তারপর একটি গ্যাস সিলিন্ডার। সিলিন্ডারে লেগে গাড়ি বিলাসী সিনেমা হলের সামনে রাস্তার মধ্যখানে আইল্যান্ডে উঠে উল্টে যায়। এ সময় গাড়ির কাচ ভেঙে সন্ত্রাসীরা একরামের মাথায় ও পেটে গুলি করে। অন্যরা তখন জিপের মধ্যেই ছিলেন। সন্ত্রাসীরা একরামকে দা দিয়ে কোপাতে থাকে। এ সময় অন্যরা গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেও বেরুতে পারেননি একরাম। তারপর গাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ সময় কয়েকটি হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পুরো ঘটনাটি ঘটাতে সময় লাগে ১৫-২০ মিনিট। ঘটনাস্থলে রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ গ্যারেজ। উত্তর-দক্ষিণ রাস্তার পূর্বপাশে পশ্চিম পাশে একটি ৪ তলা ফ্ল্যাট বাড়ি ও পূর্বপাশে ল্যাবএইড হাসপাতাল। হাসপাতালের পাশ দিয়ে পূর্বদিকে যে গলিটি চলে গেছে সেটা দিয়ে সন্ত্রাসীরা স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলে যায়। এ সময় সেখানে শত শত লোক দেখলেও কেউ ভয়ে এগিয়ে আসেননি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কিলাররা তিন ভাগে ভাগ হয়ে এ মিশন বাস্তবায়ন করে। এ সময় একটি গ্রুপ স্টেডিয়ামের সামনে আরেকটি গ্রুপ সামান্য এগিয়ে ইউনিক কমিউনিটি সেন্টারের সামনে অবস্থান করছিল। কোন কারণে একরামের গাড়ি পেছনের দিকে ঘুরানো হলে স্টেডিয়াম এলাকায় এবং সামনে চলে গেলে ইউনিক কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গ্রুপ সেটা বাস্তবায়ন করতো। পুরো কিলিং মিশনে অংশ নেয় দেড় শতাধিক সন্ত্রাসী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৮টা থেকেই কিলিং স্পটে কিছু বহিরাগত যুবক অবস্থান করছিল। এলাকাবাসী তাদের পরিচয় জানতে চাইলে কয়েকজন একটি প্রোগ্রামের কথা বলে। সকাল থেকেই এমন পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে সন্ত্রাসীদের অবস্থান করছিল। পুলিশ স্টেশনও দূরে নয়। তার পরও সকাল থেকে এমন প্রস্তুতি নিয়ে একটি হত্যাকা- ঘটানো হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ছিল অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। এদিকে হত্যাকা-ের ঘটনায় মানুষের মুখে মুখে আওয়ামী লীগ কিছু নেতা ও কিছু সন্ত্রাসীর নাম উঠে এলেও মামলা হয়েছে একরামের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা মিনার চৌধুরীর বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে মামলায় অবাক হয়েছেন খোদ বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী।
পরম্পরার কিলিং স্পট: ফেনী শহরের কিলিং স্পট হিসেবে খ্যাত একাডেমি সড়ক। বিগত আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিকে ১৯৯৯ সালে একই স্পটে খুন হয়েছিলেন বশির নামে এক যুবলীগ নেতা। তৎকালে বশির ছিলেন একরামের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। অভিযোগ ওঠেছিল যুবলীগ নেতা জেহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ও একরামের সংশ্লিষ্টতায় সে খুনের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে জেহাদ চৌধুরীর সঙ্গে একরামের দূরত্ব তৈরি হয়। মঙ্গলবার একই স্পটে প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন হন একরাম। এবারও সে কিলিং মিশনের নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ নেতা জেহাদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ফুলগাজীতে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনে লড়তে চেয়েছিলেন জেহাদ চৌধুরী। একরাম তাকে সমর্থন না দেয়ায় উপজেলা নির্বাচনে জেহাদ তার বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া একদা দুর্ধর্ষ ক্যাডার থেকে জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিতে পরিণত হন একরাম। সাম্প্রতিককালে অতীতের অনেক অনুসারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না। ফেনীর বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরের যেখানে হত্যাকা- ঘটেছে সেখানকার পৌর কাউন্সিল রেজানুর শিবলু। তার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক যাচ্ছিল না একরামের। তার ঘনিষ্ঠরা জানান, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, জেহাদ ও রউফের নেতৃত্বে কিলিং মিশনের সদস্যদের অবস্থান ও নির্বিঘ্নে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন কমিশনার শিবলুর লোকজন।
সপ্তাহ ধরে ফেনীতে চলছিল গুঞ্জন: এদিকে সপ্তাহ ধরে হত্যার ব্যাপারে ফেনীতে গুঞ্জন চললেও তাতে গুরুত্ব দেননি একরাম। ঘনিষ্ঠদের বিভিন্ন সময়ে তিনি বলেছেন, ফেনীতে তার ওপর হামলার সাহস কেউ দেখাবে না। কিন্তু তার অতি আত্মবিশ্বাসই কাল হয়েছে। একরামের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান, কিছুদিন আগে ঢাকায় একটি হোটেলে বসে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র কেনার কথা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু বৈধ অস্ত্রের জন্য কাগজপত্র যোগাড় করার আগেই তিনি খুন হয়েছেন। খুনের ঘটনার আগের দিন ফেনী জেলার সাবেক এমপির মালিকানাধীন একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ ছাপা হয়েছিল। ওই সংবাদেও এমন একটি ঘটনার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হত্যা পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ফেনীজুড়ে ওই পত্রিকার আগাম সংবাদও এখন আলোচনায়।
এলাকাবাসী যা বলেন: প্রকাশ্যে দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে হত্যাকা- ঘটলেও ফেনীবাসীর মুখে কুলুপ। ভয়ে আতঙ্কে কেউ মুখ খুলছেন না। একরামের মালিকাধীন পত্রিকার সম্পাদক ও ঘনিষ্ঠ জসিম মাহমুদ বলেন, ফেনীতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা-ের কারণে জনপ্রিয়তাই একরামের জন্য কাল হয়েছে। একজন প্রভাবশালী নেতা তাকে হাতের পুতুল বানাতে চেয়েছিলেন। একরাম ধরা দেয়নি বলেই জীবন দিতে হয়েছে। পৌর বিএনপির সভাপতি ও ফেনী শহর ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক আলালউদ্দিন আলাল বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে ফেনীতে নির্বাচনের আগেই একটি না একটি গুম-খুনের ঘটনা ঘটানো হয়। এবার নির্বাচনের পর একজন জনপ্রতিনিধিকে প্রকাশ্যে দিবালোকে হত্যা করা হলো। এখন বিএনপির ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা চলছে। কিন্তু এ ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে বিএনপির ন্যূনতম সংশ্লিষ্ট নেই। ঘটনাস্থলে এক গ্যারেজ মালিক বলেন, আমি কথা বলতে পারি না, বোবা। একবার মুখ খুললেই চিরতরে মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। বিরিঞ্চি লেভেলক্রসিং এলাকার এক পান দোকানদার বলেন, দিনের বেলায় তো হত্যাকা- হয়েছে তাই সবাই দেখেছে। কিন্তু কেউ কাউকে চিনতে পারেনি। ফেনীতে কে কি করতে পারে সেটা সবাই জানে।
খুনি যে-ই হোক তাকে ছাড়া হবে না -ওবায়দুল কাদের
ফেনী প্রতিনিধি জানান, ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একরামুল হকের জানাজায় উপস্থিত হয়ে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত ও ঠা-া মাথার হত্যাকা-। এ হত্যাকা- মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। ’৭১ সালেও একজন জনপ্রতিনিধিকে এরকম নির্মমভাবে খুন করা হয়নি। খুনি যে-ই হোক তাকে ছাড়া হবে না। এ মুহূর্তে কারও ওপর দায় চাপাতে চাই না। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। তিনি বলেন, অশান্ত থেকে ফেনী এক সময় শান্ত হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার ফেনীকে অশান্ত করে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফেনীবাসীকে এবং চেয়ারম্যান একরামের পরিবারকে সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জে ৭ হত্যাকা- এবং ফেনীর একরাম চেয়ারম্যান হত্যাকা-ের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুলের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরও বিএনপি নেতৃবৃন্দ অনেক আজগুবি কথা বলেছিলেন। তদন্তে সব বেরিয়ে এসেছে। ফেনীতেও তদন্তে প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করা কঠিন হবে না। তাদেরকে আইনের আমলে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। গতকাল সকাল ৯টায় ফেনীর মিজান ময়দানে প্রথম জানাজা, বেলা ১১টায় ফুলগাজী পাইলট হাই স্কুল মাঠে দ্বিতীয় জানাজা ও সাড়ে ১১টায় বন্দুয়া দৌলতপুর গ্রামে তৃতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। এসব জানাজায় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ফেনীর স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জাসদের কেন্দ্রীয় নেত্রী শিরিন আক্তার, ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য রহিম উল্ল্যাহ, নারী সংসদ সদস্য জাহানারা বেগম সুরমা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান, সাবেক সভাপতি আজিজ আহম্মদ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। চেয়ারম্যান একরাম হত্যার ঘটনায় তার বড় ভাই রেজাউল হক জসিম বাদী হয়ে বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনারের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ৩৫ জনকে আসামি করে ফেনী মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। পুলিশ হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে ১৫ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। এ ছাড়া হত্যাকা- বে্যবহৃত সন্দেহে একটি লাল রঙের প্রাইভেট কার চট্ট-মেট্রো প ১১-০০১৬ ও দু’টি মোটরসাইকেল (ফেনী-হ-১১-৩৬০৯ এবং একটি নম্বরবিহীন) পরিত্যক্ত অবস্থায় শহরের বিরিঞ্চি এলাকা থেকে উদ্ধার করেছে। গত মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ফেনী শহরের একাডেমি এলাকায় বিলাসী সিনেমা হলের সামনের সড়কে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকের গাড়ির গতি রোধ করে সন্ত্রাসীরা ককটেল ফাটিয়ে তাকে গুলি করে এবং গাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়। এতে তিনি গাড়ির ভেতর পুড়ে মারা যান।
গাড়ি ভাঙচুর: চেয়ারম্যান একরামের জানাজা ও দাফন শেষে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কিছু বিক্ষুব্ধ একরাম সমর্থক ফেনী-ফুলগাজী-পরশুরাম সড়কের বন্দুয়া পুলের সামনে ৪-৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে। এসব গাড়ির মধ্যে চেয়ারম্যান একরামের জানাজা ও দাফনের সংবাদ সংগ্রহ করে ফেরার পথে ফেনীর সাংবাদিকদের বহনকারী একটি মাইক্রোবাসও ভাঙচুর করা হয়েছে।