1দৈনিক বার্তাঃ একরাম হত্যাকা- মিশনের নেতৃত্বে ছিল ১১ সন্ত্রাসীর একটি টিম। তাদের সহায়তা করেছে শতাধিক সহযোগী সন্ত্রাসী। হত্যাকা-ের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ফেনীতে। সেখানে দেখা গেছে লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক সে হত্যাকা-ের দৃশ্য ও খুনিদের অনেকের চেহারা। এছাড়া ঘটনার সময় বিলাসী সিনেমা হলের পাশে নিউ সেভেন রেস্টুরেন্টে নাস্তা করছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। পুরো ঘটনাটি তার চোখের সামনে ঘটেছে। ফেনী শহরের একটি আবাসিক ফ্ল্যাটে বসে তিনি তার খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছে বর্ণনা করেছেন মর্মান্তিক সে ঘটনা। নিজাম হাজারী আতঙ্কে কেউ প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও কিলিং মিশনে জড়িতদের নাম এখন ফেনীবাসীর মুখস্থ। ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক কিলিং মিশনে তিন ভাগে অংশ নেয়া শতাধিক সন্ত্রাসীর মধ্যে বাস্তবায়ন করেছেন অন্তত ৫০ জন মিলে। কিন্তু মূল কিলিং মিশন পরিচালনা করে ফুটবল-ক্রিকেটের মতো ১১ সদস্যের একটি টিম। কোচের ভূমিকা নিয়ে আধ ঘণ্টা আগে মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থল রেকি করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের বুদ্ধিদাতা খ্যাত জাহাঙ্গীর আদেল। মূল কিলার গ্রুপে ছিলেন- ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজানুর শিবলু, আওয়ামী লীগ নেতা জেহাদ চৌধুরী, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী বড়মনি’র ছেলে আবিদ (নিজাম হাজারীর মামাতো ভাই), আবিদের বন্ধু বিরিঞ্চি ইটালি ভবনের বাসিন্দা শিপন, একাডেমি রোডের পূর্বপাশে বড়বাড়ির ছেলে বাপ্পী, হুংকারবাড়ির রুটি সোহেল, বারুইপুরের কাওসার, বনানীপাড়া বিরাজ মজুমদার বাড়ির সামনের বাড়ির রাকিব, গজারিয়ার আবুল হোসেন জাহাঙ্গীর, বনানীপাড়ার আসিফ ও বনানীপাড়া রেলক্রসিং এলাকার তুষার। শেষের সাতজন আবিদের সমসাময়িক ও জুনিয়র বন্ধু এবং এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তারা প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম থেকে কিছু ভাড়াটে সন্ত্রাসী মিশনে অংশ নেয়ার কথা ছড়িয়ে পড়েছে ফেনীর মানুষের মুখে মুখে।

যার যা ভূমিকা
হত্যাকা-ের তিনদিন আগে ফেনী পৌরভবনে একটি বৈঠকে কিলিং মিশন চূড়ান্ত হয়। যে বৈঠকের খবর প্রকাশিত হয় হাজারিকা প্রতিদিনে। বৈঠকের একটি সূত্র দূতের মাধ্যমে সাবধান করেছিল একরামকেও। হত্যাকা-ের দুদিন আগে স্টেডিয়ামে কাউন্সিলর শিবলুর নেতৃত্বে ও জেহাদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে আবিদকে অস্ত্র দেয়া হয়। পরস্পরের মধ্যে অঙ্গিকার হয় মিশন সফল হলে আগামীবার আবিদকে নির্বাচিত করা হবে ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ঘটনার দিন সকালে কিলিং স্পটের পাশের ইউআরসি ট্রেনিং সেন্টারে যান কমিশনার শিবলু। এলাকায় গ-গোল হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে অনেকটা জোর করেই প্রতিষ্ঠানটির ছুটি ঘোষণা করান তিনি। এরপরই কিছু ছেলের গায়ে দেখা যায় ফেনী কলেজের ইউনিফর্ম। তখন একরামের অবস্থানস্থল ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতাল থেকে পুরো রাস্তা জুড়ে বিভিন্ন স্পটে ভাগ হয়ে কিলিং মিশনের লোকজন অবস্থান নেয়। তারা একরামের প্রতিটি পয়েন্টের ব্যাপারে স্পটে কিলিং গ্রুপকে অবহিত করে। একরাম হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর বিরিঞ্চি রেলক্রসিং থেকে রাস্তায় গাড়ি চলাচল অনেকটাই বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে সে রাস্তায় হত্যাকা-ের সময় ছিল অনেকটাই ফাঁকা। ঘটনার সময় কাউন্সিলর শিবলু ও জেহাদ চৌধুরী স্পটেই উপস্থিত ছিলেন। একরামের ব্যক্তিগত প্রাডো গাড়িটি যখন স্টেডিয়াম পার হয় তখনই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে একটি ঠেলাগাড়ি দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়। একরামের গাড়ি ব্রেক করলে দুইপাশ থেকে মুখোশধারী মূল কিলার গ্রুপটি চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। একরামের গাড়িটি ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেলেও ততক্ষণে রাস্তায় একটি ইজিবাইক ও পৌরসভার একটি ময়লার ভ্যান দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়। শেষে রাস্তায় গড়িয়ে দেয়া হয় একটি গ্যাস সিলিন্ডার। এতে গাড়িটি আটকে পড়লে গুলি করে ও কুপিয়ে কাচ ভাঙে মুখোশধারী কিলাররা। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র নিশ্চিত করেছে, তাদের মধ্যে ছিল শিপন, বাপ্পী, রাকিব, আসিফ, তুষারসহ কয়েকজন। এ সময় খুব কাছ থেকে একরামুলের মাথা, বুক ও পেটে কয়েকটি গুলি করে আবিদ ও রুটি সোহেল। গুলির পর রাকিব, আসিফ ও তুষার মিলে উপর্যুপরি কোপাতে থাকে একরামকে। প্রথমে একটি মোটরসাইকেলে করে কিলারদের চারজন ফেনী কলেজের দিকে চলে যায়। তারপর চারদিক থেকে ঘটনাস্থলে কিছু লোক জড়ো হয়। এ সময় হলুদ ড্রামে করে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় গাড়িতে। তারপর ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজন বিরিঞ্চির দিকে, কয়েকজন শিবলু কমিশনারের বাড়ির দিকে এবং কয়েকজন উত্তর দিকে চলে যায়। তবে বেশিরভাগই চলে যায় পূর্বমুখী গলি ধরে বড়বাড়ির দিকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পেট্রোল ঢেলে গাড়িতে আগুন লাগানোর কাজটি করে কাওসার। এ সময় মানুষকে আতঙ্কিত করতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় কয়েকটি হাতবোমার। ২০ মিনিটের এ হত্যাকা-ে অংশ নেন কমিশনার শিবলু, জেহাদ চৌধুরী ও আবিদের অনুসারী ও সন্ত্রাসী বন্ধুরা। হত্যাকা-ের শেষ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে দেখা গেছে কমিশনার শিবলুকে। ঘটনাস্থলে দেখা গেছে পৌর মেয়র হাজী আলাউদ্দিনের এক নিকটাত্মীয়কেও। গাড়িতে আক্রমণকারী প্রথম কয়েকজনের মুখোশ থাকলেও পরে সবাই ছিল মুখোশবিহীন। তারপর তাদের বড় অংশটিই স্পট থেকে পূর্বদিকে ঢোকা গলি দিয়ে বড়বাড়ির দিকে চলে যায়। এ সময় একরামের গাড়ির পেছনে ছিল তার উপজেলা পরিষদের গাড়িটি। চালক ঘটনা পাশ কাটিয়ে জোরে গাড়িটি কিছুদূর সামনে নিয়ে যান। সেখানে পুলিশের গাড়ি দেখে পুলিশ কর্মকর্তার সাহায্য চান। অভিযোগ উঠেছে পুলিশ বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো দিকে চলে যায়।
চলছে গ্রেপ্তার ও পাল্টাপাল্টি দোষারোপ
একরামুল হক হত্যাকা-ের ঘটনায় প্রথম দুদিন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলেও গতকাল থেকে শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিলিং মিশনের অন্যতম হোতা আবিদকে। আগের দিন ফেনীতে আটককৃতদের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গতকাল দুপুরে কমিশনার শিবলুকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লেও পুলিশ তা নিশ্চিত করেনি। গতকাল নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফেনী জেলা পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ বলেন, দুজনকে আটক করা হয়েছে। বিভিন্নভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মিলিয়ে দেখা হচ্ছে অভিযুক্তদের নাম। এদিকে হত্যাকা-ের ঘটনায় চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের চিরন্তন কৌশল। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, নিজাম হাজারীর জেল-জালিয়াতির প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ফেনী জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন ১৭ই মে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে নিজাম হাজারীকে পদত্যাগের কথা বলেন। বৈঠকে উপস্থিতদের মধ্যে একরামুল হক ও জাহাঙ্গীর আদেল দুজনই সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থী হন। এ নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন নিজাম হাজারী। যদিও সেদিন বিকালে একরামকে ফোন করে নিজাম হাজারী ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ফলে নিজাম হাজারীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলা হচ্ছে চারদিক থেকে। ওদিকে ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলিম গতকাল একটি সংবাদ সম্মেলন করে হত্যাকা-ের জন্য বিএনপি নেতা মাহতাবউদ্দিন মিনার চৌধুরীকে দায়ী করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিজাম হাজারীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে এবং থাকবে বলেও ঘোষণা দেন। তবে জেলা আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরছে মানুষের মুখে মুখে। নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা সভাপতি মর্মান্তিকভাবে নিহত হলেও কোন প্রতিবাদ নেই আওয়ামী লীগের। এমনকি ফেনী শহরের ডায়াবেটিস হাসপাতাল ও পৌরভবন ছাড়া কোথাও একটি ব্যানার পর্যন্ত দেখা যায়নি। ওদিকে গতকাল ফুলগাজী সদরে আয়োজিত একটি দোয়া মাহফিলে নিজের বাহিনীসহ অংশ নিয়েছেন নিজাম হাজারী। তবে সেখানে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে ফুলগাজী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
আমার কথায় কেন সরকারি দলের কর্মীরা হত্যাকা- করবে: মিনার
হত্যাকা-ের পর দায়েরকৃত মামলার এক নম্বর আসামি বিএনপি নেতা মাহতাবউদ্দিন মিনার চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, আমাদের দুজনের মধ্যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনদিন সামনাসামনি উচ্চবাচ্য হয়নি। এছাড়া আমাদের বাড়ির দূরত্ব কোয়ার্টার কিলোমিটার। আমার শ্বশুরবাড়ির ১০০ মিটারের মধ্যেই একরামের বাড়ি। এমন কিছু ঘটেনি যে জন্য একটি মানুষকে জানে মারতে হবে। মিনার চৌধুরী বলেন, আমি যতদূর জানি জেলা আওয়ামী লীগের বড় পদ, শত শত কোটি টাকার টেন্ডার, বালুমহাল ইত্যাদি নিয়ে একরামের সঙ্গে নিজাম হাজারীর বিরোধ চলছিল। সম্প্রতি জেল-জালিয়াতি নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন এ বিরোধকে তুঙ্গে নিয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা কেউ কেউ নিজাম হাজারীকে ফেনী আওয়ামী লীগে এককভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। মিনার চৌধুরী প্রশ্ন তোলে বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে কিলিং মিশনে অংশ নেয়া সবাই ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমি বিএনপি রাজনীতি করি। আমার কথায় কেন তারা এত বড় একটি হত্যাকা- ঘটাবে?