1দৈনিক বার্তাঃ  এক সময় সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে খ্যাত ফেনীতে রাজনৈতিক হত্যা,গুম, অপহরণ, ছিনতাইসহ অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় ফের সন্ত্রাসের জনপদে পরিনত হয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ সালে জয়নাল হাজারীর দুর্দন্ড প্রতাপে এই জেলাকে মৃত্যু উপত্যকা ও লেবানন বলে দেশে বিদেশে পরিচিতি লাভ করে। ২০০১ সালের পর  মাঝখানের কিছু সময় রাজনীতি হানাহানি গুপ্ত হত্যা বন্ধ হলেও ২০১৩ সালের  শেষ দিকে আবারো চলছে প্রকাশ্যে দিবালোকে হত্যার রাজনীতি। দিনদুপুরে ছুরি ছিনতাই, অপহরণ, গুম, টেন্ডারবাজি, বালুমহাল লুট, বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারে অস্ত্রের মহড়া, স্বর্ণ দোকানে ডাকাতি, ব্যাংকের টাকা ছিনতাই  ফেনীতে এখন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে চলতি এপ্রিল ও মে মাসে বিএনপি ও যুবদলের নেতাকর্মীসহ ১৩ জন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। গত ৫ মাসে ৭ জন গুম হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি অপহরনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ২০ মে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হক একরামকে দিনদুপুরে প্রকাশ্যে গুলি ও আগুন দিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। চলতি বছরে লেমুয়ায় যুবদল নেতা আবুল কালামের মস্তক বিহিন লাশ উদ্ধার এবং শহরের বিসিক এলাকা থেকে অপহরণ হওয়া যুবলীগ নেতা শহীদুল আলমের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গুম হওয়া যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান রিপন ও কৃষক ইউসুফ মিয়াসহ বাকীদের এখনও কোন হদিস মেলেনি।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফেনীর গডফাদার খ্যাত জয়নাল হাজারীর হাত থেকে রেহাই পাইনি সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ডিল মেশিন দিয়ে মানুষ ছিদ্র করার রেকর্ড করেছে জয়নাল হাজারী। সেসময় মানুষ ফিসফিসিয়ে কথা বলতো। হাজারীর নিজস্ব বাহিনী স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা চতুর্দিকে ছোঁক ছোঁক করতো। ৯৭ সালের ২৫ মার্চ তুষার নামে এক ছাত্রদল নেতাকে হাজারীর স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে হত্যা করেছে। একই সালের ২৭ মার্চ শহরের ট্রাংক রোডে যুবদল নেতা নাছির, ৯৮ সালে বিএনপি নেতা নুর নবী, রতন নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। সুমন নামে এক ছাত্রদল নেতাকে পেট্টোল বাংলা এলাকায় জবাই করে হত্যা করেছে। এছাড়া জাকির, বশির, মান্নান, মুন্না রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে হত্যার শিকার হন। এছাড়া দাগনভূঞার চন্দ্রপুর ট্রেজেডিতে ৪ জন নিহত এবং কোম্পানীগঞ্জে খালেদা জিয়ার জনসভা শেষে ফেরার পথে সোনাগাজীর চর ইঞ্জিমান ট্রেজেডিতে হত্যা করে অসংখ্য লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।

সে সময়ের আলোচিত ফেনীর গডফাদার জয়নাল হাজারীর ডায়ালগ ছিল ‘আমি করবো আওয়ামী লীগ, আর তোরা করবি হাজারী লীগ’। স্টিয়ারিং কমিটি নেতারা হাজারী লীগই করতো। ২০০১ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মুখে হাজারী পালিয়ে ভারত চলে যান। পলাতক অবস্থায় তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। আ’লীগের একটি অংশ চলে যায় হাজারীর বিরুদ্ধে। বর্তমানে আর জয়নাল হাজারীর সে যুগ নেই। এখন ফেনী চলছে তার শিষ্য (অনুজ) নিজাম উদ্দিন হাজারীর ইশারায়। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল হাজারীর ইশারায় চলতো তার গঠিত স্টিয়ারিং কমিটি ও ফেনী আওয়ামী লীগ। আর বর্তমানে চলছে সাধারণ সম্পাদক নিজাম হাজারীর ইশারায়। এ যেন মুদ্রার এপিট-ওপিট।

জয়নাল হাজারী নেই আছেন নিজাম হাজারী : জয়নাল হাজারী নেই, তাতে কী? থেমে নেই হাজারী জামানার মতো হত্যার রাজনীতি।  ফেনীতে চলছে লাশের মিছিল। গত ২০ মে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হক একরামকে গুলি ও আগুন দিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের মাস্টার পাড়াস্থ একরাম চেয়ারম্যানের বাসা থেকে গাড়ি করে ফুলগাজী যাওয়ার পথে একাডেমি এলাকার বিলাসী সিনেমা হলের সামনে স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গাড়ি আটকে দিয়ে করে এলোপাতাড়ি গুলি করে পুডিয়ে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের ঘটনায় ফেনীসহ দেশবাসীকে স্তব্দ করে দেয়। ফেনী জেলা আ’লীগের সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার সময়ও এরকম জঘন্য ঘটনা ঘটেনি। এদিকে হত্যা কান্ডের রহস্য নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। তবে এঘটনাকে অনেকে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল কিংবা প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসা বহিপ্রকাশ বলে ধারনা করছেন। এই হত্যার দায় নিয়ে আ’লীগ-বিএনপি পরস্পরকে দোষারোপ করে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে নিহত একরাম চেয়ারম্যানের এক সমর্থক হত্যাকান্ডের জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীকে দায়ি করছেন। ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল হাজারী সম্পাদিত দৈনিক হাজারিকা প্রতিদিন পত্রিকায় একরামসহ আরো তিন নেতা গুম হতে পারে বলে ১৯ মে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। সংবাদে নিজাম হাজারীকে ইংগিত করেছেন জয়নাল হাজারী সম্পাদিত দৈনিক হাজারিকা প্রতিদিন।

এছাড়া চলতি মে ও এপ্রিল মাসে ১৩ জন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। শুধু এপ্রিল মাসে ১২ টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২৮ এপ্রিল  ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার জায়লস্কর ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামের ছোট ফেনী নদীর পাড় থেকে পুলিশ এক অজ্ঞাত পুরুষ (৪০) হাত-পা বাধা গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে। ২৭ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজীর চরলক্ষীগঞ্জ গ্রামে গৃহবধূ আসমা বেগম (২৮) অগ্নিদ্বগ্ধ লাশ উদ্ধার করে সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশ। ২৪ এপ্রিল সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মোহদিয়া গ্রামে নিজাম উদ্দিন নামে একব্যক্তি খুন হয়েছে। ২০ এপ্রিল সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের মাইজ বাড়িয়া এলাকায় বেলায়েত হোসেন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

১৯ এপ্রিল ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার মুহুরীগঞ্জে যুবদল নেতা মোঃ শাহীনুর আলম সুমন (২৫) কে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা হত্যা করেছে।  ১১ এপ্রিল দিবাগত রাত ১০ টায় ফেনী পৌরসভার পাঠনাবাড়ি সড়কে আবুল হাসান মো. কায়সার (২৮) নামের ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ১৪ এপ্রিল ফেনী পৌরসভার বারাহীপুরের যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম অমলের লাশ অপহরণের ১১ দিন পর উদ্ধার করেছে পুলিশ। ১৪ এপ্রিল ফেনীর বিসিক এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার পরিবারের দাবী সে দলীয় কোন্দলের শিকার। এঘটনায় ফেনী মডেল থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। গত ১২ এপ্রিল জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের পশ্চিম মধুগ্রাম গ্রামের ছালে আহম্মদের বাড়ির একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে মো. ছিদ্দিক (২৮) নামে এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। একই দিন দাগনভূঞা উপজেলার রামনগর ও বরইয়া গ্রামের সীমানায় একটি শুকনো ছরার মধ্যে একটি অর্ধগলিত মহিলার লাশ উদ্ধার করেছে দাগনভূঞা থানা পুলিশ। ১০ এপ্রিল  ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার করিম উল্লাহপুর গ্রামে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে আবদুল খালেক বাচ্চু ১০ এপ্রিল সকালে ফেনী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ৩ এপ্রিল ফেনী সদর উপজেলার দক্ষিণ কাশিমপুর তেমুহনী নামক স্থানে এনামুল হক স্বপন নামে এক প্রাইভেটকার চালককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এর আগে ২৪ মার্চ ফেনী সদর উপজেলার লেমুয়া ইউনিয়নের কসকা এলাকা থেকে মস্তকবিহীন এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মস্তকবিহীন লাশটি লেমুয়া ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি আবুল কালামের (৩০)।

ফেনী জেলা বিএনপি সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ভিপি জানান, আওয়ামী লীগ ১৯৯৬-২০০১ ফেনীতে সন্ত্রাসের জনপদ বানিয়েছে। এখন একই কায়দায় হত্যা, গুম, অপহরণ চালিয়ে ফেনীকে আবার অশান্ত করে সন্ত্রাসের অভয়ারন্যে পরিণত করছে।ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান বিকম জানান, ফেনীকে অতীতের ন্যায় শান্ত রাখা হবে। সন্ত্রাসের জনপদ হতে দেয়া হবেনা। একরাম হত্যাকারীদের কোনো ছাড় দেয়া হবেনা।

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্নমহাসচির হাজী আলাউদ্দিন জানান, সন্ত্রাস কারো কাম্য নয়। হত্যার রাজনীতি অচিরেই বন্ধ হওয়া উচিত।

ফেনীর পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ সাম্প্রতিক সময়ে আইন শৃঙ্খলার অবনতির কথা স্বীকার করে বলেন, পুলিশ আলোচিত হত্যাকান্ডসহ অপরাধ দমনে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, পুলিশ বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত শুরু করেছে। কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তেও স্বার্থে আর কিছু বলতে পারছিনা। আশা করছি একরাম  চেয়ারম্যান হত্যাকান্ডের ক্লু সহসাই উদঘাটিত হবে।