1দৈনিক বার্তাঃ নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, ফেনীর জয়নাল হাজারী ও লক্ষ্মীপুরের আবু তাহেরকে ঘিরে ফের আলোচনার ঝড়। এ আলোচনায় যোগ হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও ফেনীর এমপি নিজামউদ্দিন হাজারীর নামও। তাদের পরস্পরবিরোধী দোষারোপ আর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে অনেক খুনোখুনির প্রকৃত রহস্য আড়াল হয়ে যাচ্ছে, চাপা পড়ছে ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। ফলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে বারবার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কোনো ঘটনা ঘটলেই এসব নেতার পরস্পরবিরোধী অভিযোগ উত্থাপনের ঘটনায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রায়ই বিব্রত হচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। এসব নিয়ে উচ্চ পর্যায়েও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। আর রাজনীতির মাঠের ফসল চলে যাচ্ছে প্রতিপক্ষের ঘরে।

অতিসম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাতজনের অপহরণ ও গুম ঘটনার পর পরই মেয়র আইভী অভিযোগের আঙুল তোলেন এমপি শামীম ওসমানের দিকে। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে এমনকি সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া মন্তব্যেও তিনি অপহরণ ও গুম ঘটনার জন্য সরাসরি শামীম ওসমানকে দোষারোপ করেন। অন্যদিকে শামীম ওসমান পাল্টা দোষারোপ করেন আইভীর কর্মী আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে। তিনি প্রকাশ্য জনসভায় অভিযোগ তুলে বলেন, পলাতক নূর হোসেনকে সিটি করপোরেশন থেকে ২০ কোটি টাকার টেন্ডার কাজ পাইয়ে দেন আবু সুফিয়ান। এর বিপরীতে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণপূর্বক নৃশংস হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যায়। অভিযোগের সপক্ষে শামীম ওসমানের উদ্ধার করা অডিও রেকর্ডের সিডিটি এখন পুলিশের হাতে। কিন্তু সাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জের পরস্পরবিরোধী ‘ব্লেইম গেম’ আপাতত কমে গেছে। এ ব্যাপারে সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলে এক পর্যায়ে শামীম ওসমান ও আইভী উভয়েই নীরব হয়ে যান।

এরই মধ্যে দুই দিন ধরে সাত হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি পলাতক নূর হোসেনের সঙ্গে কথোপকথন নিয়ে আবার দোষারোপের বক্তব্য শানিত হয়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে, নূর হোসেন ওরফে হোসেন চেয়ারম্যান দেশত্যাগের আগে টেলিফোনে শামীম ওসমানের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাকে বাঁচানোর আকুতি জানান। এ নিয়ে আবারও শুরু হয়েছে দোষারোপের ঝড়।

মেয়র আইভী ও এমপি শামীম ওসমানের পরস্পরবিরোধী সমালোচনার ঝড় চলার মধ্যেই হঠাৎ আলোচনায় উঠে এসেছেন ফেনীর জয়নাল হাজারী। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সন্ত্রস্ত ফেনীকে প্রকম্পিত করে রাখা জয়নাল হাজারীর নাম ছিল দেশবাসীর মুখে মুখে। ২০০১ সালের নির্বাচন চলাকালে তার মাস্টারপাড়া বাসভবনে পুলিশ-বিডিআর অভিযান চালায়। অভিযানের আগমুহূর্তে আগাম খবর পেয়ে তিনি পালিয়ে যান ভারতে। দেশে ফিরে আসেন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দায়িত্ব নেওয়ার পর। তবে তিনি আর ফেনীর রাজনীতিতে প্রবেশ করতে পারেননি। মূলত ২০০১ সাল থেকেই ফেনীর রাজনীতি থেকে দূরে চলে যান হাজারী। তার নিকটজনেরাই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। কিছু দিন জেলে কাটাতে হয় তাকে, পরে ছাড়া পেলেও অনেকটা নীরবেই ঢাকার বাসায় সময় কাটাতে থাকেন। কিন্তু মঙ্গলবার ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামের হত্যাকাণ্ড কেন্দ্র করে আলোচনা-সমালোচনায় চলে আসে হাজারীর নাম। সেখানেও শুরু হয় ‘ব্লেইম গেম’।

পৈশাচিক বর্বরতায় একরাম হত্যাকাণ্ডের মাত্র এক দিন আগেই জয়নাল হাজারীর পত্রিকা ‘হাজারিকা প্রতিদিনে’ এ হত্যা ও গুমের আগাম আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। সোমবার পত্রিকাটির লিড রিপোর্টে আরও বলা হয়- ‘স্থানীয় এমপি নিজামউদ্দিন হাজারী উভয় সংকটে থাকায় এখন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন হত্যা হুমকির মধ্যে রয়েছেন।’ হুমকিতে থাকা নেতাদের তালিকা ছাপানোর পর দিনই একরাম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পত্রিকায় আগাম হুমকি প্রকাশের জেরেই ফেনীর বর্তমান এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম হাজারী বলেন, জয়নাল হাজারীকে রিমান্ডে নিলেই একরাম হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা যাবে। অন্যদিকে পাল্টা দোষারোপ করে জয়নাল হাজারী বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এমপি নিজাম হাজারী ও তার অনুসারীরাই জড়িত। ফেনীতে আরও খুন আরও লাশ পড়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তিনি। উভয়ের পাল্টাপাল্টি দোষারোপ আর বক্তব্য নিয়ে ফেনীর সর্বত্র আওয়ামী লীগে দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। ফেনীর এ কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনা সারা দেশে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ করেছে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারাও পড়েছেন বিব্রতকর অবস্থায়। এসব আলোচনা-সমালোচনা, কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনৈতিক ময়দানে লাভের ফসল যাচ্ছে প্রতিপক্ষের ঘরে।

এদিকে লক্ষ্মীপুরের গডফাদার চিহ্নিত আবু তাহের ও তার সন্তানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে অন্যরকম। এখন তাহের পরিবার অস্ত্রবাজির পরিবর্তে নীরব সন্ত্রাসে জিম্মি রেখেছে গোটা জেলাকে। জায়গাজমি জবরদখল, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে গত কয়েক বছরে তাহের পরিবার কয়েক শ কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। আবু তাহের এখন লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র। তার ছেলে সালাহউদ্দিন টিপু লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এবং জেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক। আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন পৌর আওয়ামী লীগের কাছে জেলা আওয়ামী লীগ রীতিমতো ধরাশায়ী। জেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা পাঁচ-সাত বছর ধরেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। এ সুযোগে সালাহউদ্দিন টিপু তার যুবলীগ নিয়ে সারা লক্ষ্মীপুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। লক্ষ্মীপুর জেলা সদরে এখন মার্কেট নির্মাণ, বাড়িঘর নির্মাণ, জায়গা-জমির ঝামেলা মেটাতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন দাপুটে নেতা আবু তাহের। অন্যদিকে জেলবন্দী পুত্র বিপ্লব সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলার যাবতীয় টেন্ডারবাজি। ছোট ছেলে শিবলুর বিরুদ্ধে রয়েছে জেলার মাদক ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ। সব ক্ষেত্র থেকেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার পাহাড় জমিয়ে তুলেছে পরিবারটি। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত আর মালয়েশিয়ায় তাদের দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদ গড়ে তোলার খবরও লক্ষ্মীপুরবাসীর মুখে মুখে। একসময়ের বিএনপি ক্যাডার নাসিরও এখন আবু তাহেরের আজ্ঞাবহ। বেশুমার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চন্দ্রগঞ্জের যুবদল সমর্থিত জিসান বাহিনীও ব্যাপক তৎপর। তার পেছনেও জেলা যুবলীগের এক নেতার ইন্ধন আর আশীর্বাদের ছায়া আছে। বিএনপি সমর্থক খ্যাত এ দুই অস্ত্রবাজ বাহিনী দ্বারা লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের শায়েস্তা করা হচ্ছে অহরহ। যখন তখন ফেলা হচ্ছে লাশ, চলছে রক্তের হোলিখেলা। এসব ঘটনায় লক্ষ্মীপুরে আবু তাহের ও তার পরিবার নিয়ে চলছে আলোচনার ঝড়। বিতর্কিত হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগ, বিব্রত হচ্ছেন স্থানীয় নেতারা।