সংসদ ভবন হয়ে পড়েছে অনিরাপদ 

পূর্বের বেষ্টনী খুলে ফেলার পাশাপাশি নতুন বেষ্টনীর নির্মাণকাজ বন্ধের ফলে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে দেশের অন্যতম সেরা দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা জাতীয় সংসদ ভবন ও এর চারপাশের এলাকা৷ এ যেন নিরাপদ স্থান অনিরাপদ হয়ে পড়েছে৷ ভবনের চারপাশে নতুন প্রকল্পের কাজ সমাপ্তের আগেই পূর্বের নিরাপত্তাবেষ্টনী খুলে ফেলা হয়েছে৷ পুরনো বেষ্টনী খুলে দেওয়া আর নতুন প্রকল্পের কাজ বন্ধ এ অবস্থায় সংসদ ভবন চত্বরের নিরাপত্তা আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে৷ এদিকে নতুন নির্মাণকাজের দায়িত্ব পাওয়া দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অবিলম্বে পাঁচ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করার জন্য গণপূর্ত বিভাগকে চিঠি দিয়েছে৷ 
প্রসঙ্গত, সংসদের নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে গত বছরের শেষ দিকে নয় কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে আট ফুট উঁচু স্টিলের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় গণপূর্ত বিভাগ৷ কাজ পায় জিকে বিল্ডার্স ও রফিক কনষ্ট্রাকশন লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান৷ 

এর মধ্যে রফিক কনষ্ট্রাকশন পায় চার কোটি ৫৯ লাখ টাকার দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের কাজ এবং গোলাম কিবরিয়া টিপুর জিকে বিল্ডার্স পায় পাঁচ কোটি ২৩ লাখ টাকার উত্তর-পূর্ব পাশের সীমানাবেষ্টনী নির্মাণের কাজ৷ তারা কাজও শুরু করে৷ বেশির ভাগ এলাকায় পাইলিং করা হয়৷ এরপর পরিবেশবাদীসহ বিভিন্ন মহল সংসদ ভবনের চার পাশে বেড়া দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলে একপর্যায়ে সরকার কাজ বন্ধ করে দেয়৷ কিন্তু ততদিনে নতুন কাজের ঠিকাদাররা পুরনো নিরাপত্তাবেষ্টনীগুলো খুলে ফেলেছে৷ এ অবস্থায় কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংসদ চত্বরের নিরাপত্তা আরো শিথিল হয়ে পড়েছে৷ সংশ্লিষ্ট সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে, নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায় সংসদ চত্বরের পূর্বদিকের খেজুরবাগান চত্বরে প্রতি রাতে অসামাজিক কার্যকলাপের মজমা বসছে৷ এ প্রসঙ্গে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম খান বলেন, পূর্বের নিরাপত্তাবেষ্টনী পুনঃস্থাপন করার অনুমতি চেয়ে স্পিকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে৷ অনুমতি পেলে অনতিবিলম্বে সেগুলো যথাস্থানে স্থাপন করা হবে৷ এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, নিরাপত্তাবেষ্টনী স্থাপনের কাজ আপাতত স্থগিত হলেও দেশের অন্যতম স্পর্শকাতর এ স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশা হাতে আনার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সীমানাপ্রাচীরের আদলে তিন ফুট কংক্রিটের দেওয়ালের পর চার ফুট উঁচু লোহার রেলিং নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে৷ 

এর আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ, স্থাপত্য এবং সংসদ সচিবালয় ও সংসদের নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন৷ ওই বৈঠকে তিনি এই নির্দেশনা দেন বলে জানা গেছে৷ তবে এ কাজ শুরু হবে স্থপতি লুই আই কানের প্রকৃত নকশা হাতে পাওয়ার পর৷ এর আগ পর্যন্ত নতুন বেষ্টনী নির্মাণ বন্ধ থাকবে৷ এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নিরাপত্তাবেষ্টনী উঁচু করার কাজ স্থগিত আছে৷ মূল নকশাটি আনা হবে এবং তা দেখে পরবর্তী সময়ে নতুন করে কাজ শুরু করা হবে৷ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, সংসদ ভবন এলাকায় নকশাবহির্ভূত কোনো স্থাপনা করা হবে না৷ 

নাম প্রকাশে অনুচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, লুই কানের মূল নকশা আনার পর নিরাপত্তাবেষ্টনী করা হলেও চলমান প্রকল্পে সেই কাজ হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ তার জন্য নতুন প্রকল্প নিতে হবে৷ সে ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত যে টাকা ব্যয় করা হয়েছে, তা কোনো কাজেই আসবে না৷ বর্তমান টেন্ডারও সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়বে বলে তিনি উল্লেখ করেন৷ এ বিষয়ে রফিক কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্ত্বাধিকারী আবদুল মাজেদ বলেন, কার্যাদেশ পাওয়ার পর আমার প্রতিষ্ঠান দ্রুত কাজ শুরু করে৷ নকশা অনুযায়ী বিশেষভাবে তৈরি করে আনা হয় স্টিলের রেলিং৷ পাইলিংয়ের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে৷ এর পর কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ তার ভাগের প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কাজ বন্ধ করে দেওয়ার পর গত এপ্রিলে আড়াই কোটি টাকার বিল জমা দিয়েছি৷ অনতিবিলম্বে এ টাকা না পেলে আদালতে যাব৷ এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম খান বলেন, ঠিকাদাররা যে পরিমাণ কাজ করেছে তার বিল ছাড় করার প্রক্রিয়া চলছে৷ এতে সন্তুষ্ট না হলে তারা ব্যবস্থা নিতে পারে৷ 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থপতি লুই আই কানের করা মূল নকশায় না থাকলেও আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদের শাসনকালে তখন প্রথমবারের মতো সংসদ ভবন চত্বরের চারপাশে বেষ্টনী নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়৷ কিন্তু ব্যাপক সমালোচনার মুখে বাতিল হয় সেই সিদ্ধান্ত৷ গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জাতীয় সংসদ ভবনের চার পাশে তিন ফুট উঁচু লোহার বেষ্টনী দেওয়া হয়৷ এরপর গত মহাজোট সরকারের আমলে নিরাপত্তার কথা বলে চার পাশে ১০ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মাণের পরিকল্পনা হয়৷ তবে পরিবেশ ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের আপত্তির মুখে সেই পরিকল্পনাও বাতিল হয়৷ এরপর পরিকল্পনা পরিবর্তন করে লোহার বেষ্টনী আরো উঁচু করার সিদ্ধান্ত হয়৷ 

এরই মধ্যে প্রস্তাবিত মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় গত মার্চে জায়গা নির্ধারণ করা হয়৷ এ জন্য সংসদ ভবনের পূর্ব পাশে লাল নিশানা পুঁতে সীমানা চিহ্নিত করা হয়৷ ফুটপাথ থেকে ৫৫ ফুট ভেতরে এসব নিশানা দেওয়া হয়৷ সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে খবর প্রকাশের পর বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে সেই কাজও স্থগিত করা হয়৷