নেইমারের পিঠে কলম্বিয়ার জুনিগার হাঁটুর গুঁতো

দৈনিক বার্তা – রিও ডি জেনেইরো-ব্রাসিলিয়া ফ্লাইটের মাঝ পথে ক্যাপ্টেন সেই রুটিন ঘোষণাটাই করলেন, যা বিশ্বকাপ জুড়ে মোটামুটি সব ফ্লাইটে শুনছি।

‘হে বিদেশি অতিথিরা, ফুটবলের আপন ভূমিতে আপনাদের স্বাগত। ওয়েলকাম টু দ্য ল্যান্ড অব সকার’। কিন্তু আজ রুটিন নয়। তার সঙ্গে যোগ করলেন, “ফুটবলের দেশে আজ আমাদের সবার খুব মন খারাপ। আমাদের প্রিয় ছেলেটাই বিশ্বকাপ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। যাই হোক, আপনাদের সবার জন্য শুভেচ্ছা।” ব্রাজিলে চাইলেও এই ভরা বিশ্বকাপ বাজারে কোথাও হলুদ না দেখে উপায় নেই। যতই হোক আর্জেন্তিনার ব্রাসিলিয়ায় খেলা। আর এই প্লেনযাত্রীরা একটু পর সেই মাঠেই গিয়ে বসবে। তবু হলুদ জার্সি অন্তত গোটা পনেরো ভোরের ফ্লাইটে হাজির। সামনে দুটো সিট পরে এক মহিলা এত ক্ষণ মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। ক্যাপ্টেনের বলা শেষ হতে না হতেই কাঁদতে শুরু করে দিলেন। পকেটে মোবাইল ক্যামেরা রয়েছে। ছবি তুলব? তোলা উচিত হবে এই প্রাইভেট মুহূর্তের? ভাবতে ভাবতেই মহিলার পাশে বসা কিছু প্রবীণ তাঁকে গাল-টাল মুছিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন। এঁদের মুখচোখও শোকার্ত, গম্ভীর। গায়ে হলুদ রং, কিন্তু তার জৌলুস উধাও। বরং যেন কালো শার্টের নীরব শোকপালন!

ব্রাজিলের জাতীয় পতাকাও কি অর্ধনমিত করা হয়েছে নাকি? ব্রাসিলিয়া তো রাজধানী। মাঠে আসার সময় সরকারি অফিসগুলো খেয়াল করলে হত। অবশ্য পতাকায় আর কী আসে-যায়! গোটা ব্রাজিল তো মৌনতা পালন করছে। তার সবচেয়ে আদরের ছেলে নেইমার দ্য সিলভা, তিনি কিনা শিরদাঁড়ার হাড় ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছেন বিশ্বকাপ থেকে। গোটা ব্রাজিলের হৃৎপিণ্ডটাই যেন এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে সর্বনাশা সেই খবরে। কাল রিওয় বিখ্যাত বোতাফোগো ক্লাবের সামনে অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। ব্রাজিলের সেমিফাইনালে যাওয়া নিয়ে বাজি পুড়ছে। আলোয় আলো। রাস্তায় সাম্বা শুরু হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ সব বন্ধ! কলম্বিয়াকে হারানোর পূর্ণিমার চাঁদ ওঠা মাত্র অদ্ভুত ভাবে তাকে ঢেকে দিয়েছে অমাবস্যা! বিশ্বকাপে এমনিতে বহু দিনের পুরনো একটা চলতি কথাই আছে— তারাই চ্যাম্পিয়ন হবে যাদের রিজার্ভ বেঞ্চ সবচেয়ে শক্তিশালী। এই ভাবনা থেকেই বলা যে, সেরা প্লেয়ার খেলতে না পারলে বদলি যাদের একই রকম ভাল, কাপ তাদের।

ব্রাজিলেরই তো ইতিহাসে রয়েছে। পেলে বাষট্টির বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকে আর খেলতে পারেননি। তাঁর জায়গায় খেলেছিলেন আমারিল্ডো। যাঁর নাম কেউ শোনেনি। অথচ ব্রাজিল তো দিব্যি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। শনিবারও নেইমারের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার দুঃসংবাদ পেয়ে পেলে বলেছেন, “আমার ঠিক একই জিনিস হয়েছিল। কামনা করব, সে বার যেমন আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, এ বারও পারব!” কিন্তু গণ সেন্টিমেন্ট হল, পেলে তো বলেই খালাস! চ্যাম্পিয়ন করবেটা কে? ব্রাসিলিয়া স্টেডিয়াম যাঁর নামে, তিনি বাষট্টিতে একা চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিলেন। এমনই আত্মবিশ্বাস ছিল যে এখনকার লোকগাথা হল, ম্যাচের সকালে জিজ্ঞেস করতেন, আজ কার সঙ্গে খেলা রে? হায়, স্কোলারির কোনও গ্যারিঞ্চা নেই। আধুনিক ব্রাজিলের ঐশ্বর্য বলতে একা নেইমার। আর তাই মারাত্মক চোট ঘিরে এই পর্যায়ের বিপন্নতা! কাফু ব্রাজিলীয় ঐতিহ্যের কথা বলছিলেন। এটা কীসের ঐতিহ্য যে, এক মহাতারকার চোট ঘিরে এমন আবহ যে জার্মানি, তোমরা সেমিফাইনালে ওয়াকওভারই পেয়ে গেলে!

ব্রাজিলের জাতীয় ভিলেন এখন স্প্যানিশ রেফারি কার্লোস ভেলাস্কো। ব্রাসিলিয়ার হোটেলে যে তরুণী চেক-ইন করাল, সে একই রকম বিমর্ষ। আর শুধু বলছে, এটা কী জাজ? জাজ মানে বুঝতে হবে রেফারি। তা কার্লোসের রেফারিং সত্যিই ফিফাকে তীব্র অস্বস্তিতে ফেলার মতো। ব্রাজিল-কলম্বিয়া ম্যাচে এই বিশ্বকাপের রেকর্ড সংখ্যক ফাউল হয়েছে, মোট চুয়ান্নটা। অথচ রেফারির হলুদ কার্ড বেরিয়েছে মাত্র তিনটে! ফুটবল মহলের তীব্র অভিযোগ, শুরুর থেকে কার্ড দেখাতে করলে নেইমারকে করা জুনিগার ফাউলটা ঘটত না।

তবে শুধু কলম্বিয়া কেন, প্রতি ম্যাচেই তো প্রতিপক্ষ নেইমারকে রাগবি ম্যাচের মতো ট্যাকল করেছে। চিলির দিন তাই। মেক্সিকোর দিন তাই। ফিফা কিছু দিন আগেও বলেছে, বল প্লেয়ারদের বিশ্বকাপে সব রকম নিরাপত্তা দেবে। ওটা বোধহয় ব্রাজিল নয়, রাশিয়া বিশ্বকাপের কথা ভেবেই বলা হয়েছিল! নেইমারকে নিয়ে বারবার গবেষণা হচ্ছিল, তাঁর ভাগ্য কি আটান্নর পেলের দিকে যাবে? না ছেষট্টির ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের পেলেকে অনুসরণ করবে? দেখা গেল পরেরটা। সে বারও বুলগেরিয়া ম্যাচে প্রচণ্ড মার খেয়ে পেলেকে কার্যত বাইরে চলে যেতে হয়। এর পর পর্তুগাল ম্যাচে মোরেস তাঁকে এমন মারেন যে লেখা হয়েছিল, ইংল্যান্ডের পুলিশের মাঠে ঢুকে পড়া উচিত ছিল। অথচ সে বারও ইংরেজ রেফারি জর্জ ম্যাককাবি কার্ড অবধি দেখাননি মোরেসকে। আর একটা কথা মনে রাখা দরকার। ব্রাজিলীয় মিডিয়া এই ডিপ্রেশনের মধ্যে বাষট্টির সঙ্গে মিল খুঁজে বারবার আশাবাদ দেখাচ্ছে যে, পেলে না থেকেও তো ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতায় ছেষট্টির ম্যাচ অনেক স্পষ্ট যে পেলের ওই আঘাতেই ব্রাজিলের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হয়ে যায়।

তবে নেইমার ফুটবল উচ্চতায় আটান্নর পেলেকে ধরতে না পারুন। নিজের ক্যাপটিভ অডিয়েন্স যে কোন মাত্রায় এই বিশ্বকাপে নিয়ে গিয়েছেন, তা গত চব্বিশ ঘণ্টায় পরিষ্কার। পোপ আর ওবামার বোধহয় প্রতিক্রিয়া আসতে বাকি আছে! নইলে উসেইন বোল্ট থেকে ক্রিস গেইল। জার্মান কাগজ থেকে মার্কিন দেশের সবচেয়ে বড় দৈনিক। চিরশত্রু আর্জেন্টাইন মিডিয়া থেকে জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানেচি! নেইমার দ্য সিলভা ভেসে যাচ্ছেন সমবেদনা আর শুভেচ্ছায়। মার্কিন দৈনিক শিরোনাম করেছে ব্রাজিল জিতল, নেইমার হারলেন। জার্মান দৈনিক লিখছে, নেইমার ব্রাজিলে না থাকা মানে তো জার্মানির ম্যানুয়্যাল নয়্যার না থাকা, ফিলিপ লাম না থাকা, ক্লোজে না থাকা, মুলার না থাকা, পোডলস্কি না থাকা। আর্জেন্তিনা মিডিয়া বলছে, নেইমার, আমরাও শোকাহত!

পৃথিবীর দুই গোলার্ধকেই শুধু দুঃখে ভাসিয়ে দেননি নেইমার, তাঁর জন্য প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বিস্ময়কর ভাবে রোমারিও-ও। রোমারিও এমনিতে দেশে বিশ্বকাপ সংগঠনের প্রবল বিরোধী। বিশ্বকাপ চলাকালীন তাঁর কোনও মন্তব্যই চোখে পড়ছে না। না কোনও চ্যানেলে, না কাগজে। সেই রোমারিও নীরবতা ভেঙে বলেছেন, “ভাই আমার, দ্রুত সেরে ওঠো। তোমার চোট লাগাটা মর্মান্তিক। তবে তুমি দ্রুতই ভাল হয়ে যাবে আমি জানি..!” ব্রাজিলীয় কাগজে এ দিন ছবি ছাপা হয়েছে, মাঠে নেইমার স্ট্রেচারে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হাউহাউ করে কাঁদছেন তাঁর অভিনেত্রী বান্ধবী। স্ট্রেচারে চলে যাওয়ার ছবিটা গোটা বিশ্বের টিভি দর্শক দেখেছে। ফোর্তালেজার হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে বার করে আনাটা ছবিতে এ দিন দেখলাম। মুখে তোয়ালে চাপা দেওয়া নেইমারের। সদাহাস্যময় বাইশ বছরের এক তরুণ। ব্রাজিল বিশ্বকাপের অঘোষিত পোস্টার বয়। কেউ জানত, শেষ পোস্টারে তাঁর ছবি থাকবে অ্যাম্বুল্যান্সে মুখে তোয়ালে দিয়ে!

ABP