tigerদৈনিক বার্তা-নিজস্ব সংবাদদাতা, গাজীপুর, ৭আগস্ট,ঢাকা : বিশ্ব প্রকৃতির মানচিত্র থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বাঘ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। বাঘ বনের জীববৈচিত্র্য, খাদ্য শৃঙ্খল ও প্রতিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক হওয়ায় প্রকৃতি ধীরে ধীরে তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। বিংশ শতাব্দীতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে তিন প্রজাতির বাঘ। বর্তমানে পাঁচ প্রজাতির বাঘ কোনো রকমে টিকে আছে। ফলে বাঘ এখন মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত।

১৯০০ সালে বাঘের সংখ্যা এক লাখে থাকলেও বর্তমানে তা চার হাজারেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীতে যে ১৩টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব এখনো বজায় রয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। বর্তমানে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ হতে পারে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দশকে পৃথিবী থেকে বাঘের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বন্যপ্রানী ও প্রকৃতি সংরণ অঞ্চলের বন সংরক ড. তপন কুমার দে জানান, বাঘ আমাদের জাতীয় প্রাণী ও বীরত্বের প্রতীক। বাংলাদেশে বর্তমানে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবন। সারা বিশ্বে বন উজাড় এবং শিকারীদের বাঘ হত্যার ফলে বর্তমানে এই প্রাণীটি মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। বাঘ পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখনো অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এই ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশকে টাইগার রেঞ্জ কান্ট্রি (টিআরসি) বলা হয়। এই দেশগুলো হচ্ছে ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানামার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া। এর মধ্যে পৃথিবীর সর্বাধিক বাঘ আছে ভারতের প্রায় এক হাজার ৭০০টি। দেশটির ৫৬টি বনাঞ্চলে এসব বাঘ ছড়িয়ে আছে।

বাঘের আটটি উপপ্রজাতির মধ্যে ইতোমধ্যে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে বাঘের পাঁচটি উপপ্রজাতি বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রান টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার ও ইন্দো-চায়না টাইগার কোনো রকমে টিকে আছে। এবার পাঁচম বারের মত বাংলাদেশে ‘বিশ্ব বাঘ দিবস’ উদ্যাপিত হচ্ছে। ‘বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় গৌরব’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ বৃহস্পতিবার পালিত বিশ্ব বাঘ দিবস। এ উপলক্ষে জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে ঢাকা, খুলনা ও সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন উপজেলায় বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বব্যাপী বাঘ বিলুপ্তি রোধকল্পে ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গ্লোবাল টাইগার ফোরাম (জিটিএফ) গঠিত হয়। এটি হচ্ছে বাঘ অধ্যুষিত এবং বাঘ সংরণ বিষয়ে সহায়তাদানকারী দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংস্থা। ২০০০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকাতে ফোরামের প্রথম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে ১০ দফা কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ জিটিএফের সদস্যদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা বর্তমান সংখ্যার দ্বিগুণ করা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী বাঘ ও বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলগুলো সংরণে সম্মিলিত উদ্যোগে সহায়তাদান করছেন বিশ্বব্যাংক; ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএসএআইডি, জিটিআই, জিআইজেড ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থা। জিটিআই ও বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা ও উদ্যোগে ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত ১৩টি টিআরসি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরণকে বেগবান করার জন্য ঘোষণাপত্র তৈরি হয়।

ওই ঘোষণাপত্রের আলোকে প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হচ্ছে। তবে এবার ২৯ জুলাই পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্যাপিত হওয়ায় বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হচ্ছে ৭ আগস্ট।

বাঘ বনের জীববৈচিত্র্য, খাদ্যশৃঙ্খল ও প্রতিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক। বনের প্রাকৃতিক বংশ বৃদ্ধি যাতে ব্যাহত না হয় তার জন্য তৃনভোজী প্রাণী হরিণ, শূকর, বনগরু ইত্যাদি শিকার করে বাঘ বনের প্রতিবেশ চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাঘ বন রায় অতন্ত্র প্রহরী এবং তার নির্ধারিত আবাসস্থলে অন্য কোনো বাঘ বা মানুষের আনাগোনা সহ্য করে না। বাঘ একটি বনের জীববৈচিত্র্যের স্ট্যাটাস নিরূপণের ইন্ডিকেটর প্রজাতি। বাঘ কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বনাঞ্চলের অবস্থা/বাঘের আবাসস্থল বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন। তাই মহাবিপদাপন্ন প্রজাতির বাঘ রার জন্য বিভিন্ন দেশ-বিদেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে বাঘের আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত ১৩টি টাইগার রেঞ্জ দেশ বাঘ সংরণের জন্য ন্যাশনাল টাইগার রিকভারি প্রোগ্রাম (এনটিআরপি) ও জিটিআরপি বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশে বাঘের অবস্থা

ড. তপন কুমার দে জানান, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সুন্দরবনে এখনো ৩০০ থেকে ৫০০টি বাঘ টিকে আছে বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। ২০০৪ সালে ইউএনডিপি, বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বাঘের পদচিহ্নের ওপর ভিত্তি করে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। ওই জরিপে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি নির্ধারণ করা হয়।

তার মধ্যে পুরুষ বাঘ ১২১টি, বাঘিনী ২৯৮টি ও বাচ্চা ২১টি ছিল। সুন্দরবনের আয়তন ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার এবং এই বনাঞ্চলে বাঘের ঘনত্ব পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক। বাঘ আছে বলেই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরতি আছে এবং প্রাণিকুলের খাদ্যচক্র বিরাজমান আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাঘ বিপ্তিভাবে ছোট ছোট বনে ছড়িয়ে আছে এবং ওইসব বন থেকে বাঘ দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সুন্দরবন সর্বাধিকসংখ্যক বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র। গবেষণা ও পরিবীণের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ বিপর্যয়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, শিকারের অভাব ও সুন্দরবন লোকালয় সংলগ্ন খাল-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে বাঘ-মানুষে সঙ্ঘাত বাড়ছে। সুন্দরবনে বাঘের শিকার প্রাণীর মধ্যে চিত্রা হরিণ, শূকর, মায়া হরিণ ও বানর রয়েছে। বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত থেকে জানা যায়, প্রতি বছর গড়ে ৩০-৫০ জন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা যান। তাদের বেশির ভাগ বাওয়ালী, জেলে, মৌয়ালী ও জ্বালানি কাঠ আহরণকারী। সুন্দরবনের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশে বিশেষ করে সাতীরা রেঞ্জ সংলগ্ন লোকালয়ে মাঝে মাঝে গবাদিপশু বাঘের আক্রমণের শিকার হয়। গড়ে ২-৩ টি বাঘ লোকালয়ে মানুষের হাতে মারা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সংখ্যা বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা সুন্দরবনের প্রতিবেশ চক্রের পরিবর্তন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং হরিণ পাচার ও শিকারের কারণে খাদ্য সঙ্কটসহ বিভিন্ন কারণে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ববাড়ছে। আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুসারে স্ন্দুরবনে বাঘ ও হরিণের সংখ্যা ধারণমতার মধ্যে রেখে অবৈধ হরিণ শিকার বন্ধ, আবাসস্থলের উন্নয়ন ও নিয়মিত টহল প্রদান করে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।