Jahazদৈনিকবার্তা-২৪,আগস্ট: পৃথিবীর বিভিন্ন সাগরে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে পণ্যবাহী (কার্গো) প্রায় পাঁচ হাজার জাহাজ। এটা যেকোনো মুহূর্তের হিসাব। এসব জাহাজে করে মালপত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা জিনিস, জ্বালানি তেল, শস্য ও খাদ্যদ্রব্য, মোটরগাড়ি, যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার প্রভৃতি পরিবহন করা হচ্ছে। জাহাজকে তাই বলা যেতে পারে বিশ্ববাণিজ্যের প্রধান ভরসা। কিন্তু আশঙ্কাজনক মাত্রায় কার্বন নির্গমনের মাধ্যমে এসব জাহাজ পৃথিবীর পরিবেশ ও জলবায়ুর মারাত্মক ক্ষতিও করছে। বিজ্ঞানীরা তাই এবার কম্পিউার-নিয়ন্ত্রিত ও পরিবেশবান্ধব জাহাজ নির্মাণের চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। হয়তো সেই জাহাজ সমুদ্রের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি পণ্য পরিবহনেও অধিকতর কার্যকর হবে।

ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান মায়েরস্কের জাহাজ ট্রিপল-ই বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম। এটি এক হাজার ৩২০ ফুট লম্বা, যা কিনা প্রায় চারটি ফুটবল মাঠের সমান! ট্রিপল-ইর উচ্চতা ২৪০ ফুট আর বিস্তার ১৯৪ ফুট। এটি ২০ ফুট মাপের ১৮ হাজার কনটেইনার পরিবহন করতে পারে। এসব কনটেইনারকে যদি রেলগাড়ির মতো একটির পেছনে আরেকটি যুক্ত করা যায়, তবে তা লম্বায় ১১০ কিলোমিটার হবে।

এ রকম বিশাল পরিবহন ছাড়া যেহেতু চলেই না, বিকল্প ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু মানুষের নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে যন্ত্রনির্ভর জাহাজের ব্যবহার কতটা কার্যকর হবে? সেগুলো কি নিজে নিজে চলতে পারবে? ট্রিপল-ইর মতো বড় একটা জাহাজ চালনায় মাত্র ২০ জনের একটি দলই (ক্রু) যথেষ্ট। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে এখন তুলনামূলক কম জনবল নিয়েই গভীর সমুদ্রে এসব জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। তাই বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, একদিন হয় সম্পূর্ণ স্বচালিত অথবা কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার আওতায় কোনো মানব ক্রু ছাড়াই বড় আকারের জাহাজ ঠিকমতো চালিয়ে নেওয়া যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে জাহাজ তৈরির নকশা শেখান ম্যাট কলেট। তিনি বলেন, পণ্যবাহী জাহাজের আকার গত ১৫ বছরে অনেক বড় হয়েছে। দীর্ঘ ও একঘেয়ে বা পুনরাবৃত্তিময় কোনো কাজে মানুষ খুব বেশি দক্ষ নয়। আর দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা এমনই একটি ব্যাপার। তাই মনোযোগে ঘাটতি হলেই সংঘর্ষ বা তলদেশ আটকে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা দেখা দিতে পারে। স্বচালিত জাহাজে এ ধরনের দুর্ঘটনা নিশ্চয়ই কমে আসবে। কারণ, দুই মাসব্যাপী যাত্রায় কম্পিউটারের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যন্ত্রচালিত জাহাজের দ্বিতীয় ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য হলো, এটি ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন নির্গমনের মাত্রা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনার সুযোগ থাকবে। কারণ, মানুষের ভ্রমণক্লান্তি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে যাত্রার সময়সীমা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। তাতে গতি বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানির ব্যবহার ও খরচও বাড়াতে হয়। ফলে কার্বন নির্গমন বেশি হয়। কিন্তু মানুষবিহীন জাহাজে সেই তাড়াহুড়া থাকবে না। ফলে কার্বন নির্গমনও হবে কম।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মানুষবিহীন সমুদ্রযান তৈরি ও ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এমইউএনআইএন (ম্যারিটাইম আনম্যানড নেভিগেশন থ্রু ইন্টেলিজেন্স ইন নেটওয়ার্কস) নামের একটি প্রকল্পও চালু করেছে। এটির বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছেন যে মানুষবিহীন নৌযান চালু করতে মৌলিক কোনো বাধা নেই। জাহাজশিল্প নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ব্যাপারে এখন বেশ মনোযোগী হয়েছে।

কিন্তু মানুষবিহীন জাহাজ চালনায় কিছু বাধাও আসতে পারে। যেমন: অগ্নিকা- বা যান্ত্রিক বিপর্যয়ের মতো আকস্মিক দুর্ঘটনা বা পরিস্থিতি সামাল দিতে কম্পিউটার যথেষ্ট ভালো নয়। এ সময় বাইরে থেকে সহায়তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষক পল স্টট বলেন, স্বয়ংক্রিয় জাহাজ চালনার ব্যাপারটি বাস্তবায়নের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে। মাছ ধরার অনেক নৌযানের পাশাপাশি জাহাজ চালনা যেকোনো নাবিকের জন্যই একটি দুঃস্বপ্নের মতো ব্যাপার। স্বচালিত জাহাজের জন্য এটি হবে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি।

অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বিজ্ঞানীদের আশা, আগামী ১৫ বছরের মধ্যেই মানুষবিহীন জাহাজ চালু করা যাবে। আর সেটিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে নামাতে হয়তো ২০ থেকে ৩০ বছর লেগে যাবে। প্রযুক্তির ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে তখন জাহাজের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে মানুষের কাছ থেকে কম্পিউটারের কাছে।