চরম দুর্ভোগে বানভাসী মানুষ,নেই বিশুদ্ধ পানি ও খাবার

দৈনিকবার্তা-ঢাকা,১সেপ্টেম্বর : দেশে বিভিন্ন জায়গায় বন্যা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি৷সোমবার পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে৷কয়েক জায়গায় কমলেও এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি৷ সোমবার সকাল ৯টা থেকে পরবতর্ী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী, রংপুর ও ঢাকা বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে৷ সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারী ধরণের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে৷ সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে৷এদিকে পরবতর্ী ৭২ ঘন্টায় বৃষ্টিপাত হ্রাস পেতে পারে৷

আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ছত্রিশগড় ও তত্‍সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি দুর্বল হয়ে মৌসুমী বায়ুর অক্ষ বরাবর মিলিত হয়েছে৷ মৌসুমী বায়ুর অঙ্গ রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, উড়িষ্যা, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম পর্যনত্ম বিসত্মৃত রয়েছে৷ মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারী থেকে প্রবল রয়েছে৷

বগুড়া: বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি হ্রাস পেলেও বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার এবং বাঙালী নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে৷ বন্যা দুর্গত এলাকায় ২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে৷এদিকে সারিয়াকান্দির রোহাদহ বন্যা নিয়ন্ত্রন বাধ ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে৷ ফলে আরো ১শটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে৷ তীব্র পানির স্রোতে সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা পয়েন্টে রবিউল (১৪) ভেসে গেছে৷ আজ সোমবার দুপুর পর্যনত্ম তার সন্ধান পাওয়া যায়নি৷ রোববার বিকেলে ধুনট উপজেলার গোপাল নগর ইউনিয়নের চর খুকশিয়ার নূরম্নল ইসলামের ছেলে অন্টুল হক (৭) মারা গেছে৷বন্যাকবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থ লোকের সংখ্যা ১ লাখ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৬শ’ ৯০ জনে৷ বন্যায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় অনেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধে আশ্রয় নিয়েছে৷ এরই মধ্যে ২২০টি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে৷

স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান দুর্গত এলাকায় সার্বৰণিক তদারকি এবং ত্রাণ দেয়ার কাজে নিয়োজিত আছেন৷ গতকাল রোববার বিকেল পর্যনত্ম ৰতিগ্রস’দের মাঝে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ২২০ মেট্রিক টন খাদ্য শষ্য বিতরণ করা হয়েছে৷ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতর্া এনডিসি আরিফুজ্জামান জানান, ৩টি উপজেলায় ৫ হাজার ৫৪টি নলকুপ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ ফলে বন্যা দূর্গত এলাকায় তীব্র পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে৷ কন্ট্রোল রুম সূত্র থেকে আরো জানানো হয়, উপজেলাগুলোতে ২২ হাজার ৩শ’ ৩৫টি গবাদি পশু পানি বন্দী হয়ে পড়েছে৷ অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গোখাদ্যের সংকট তৈরি হয়েছে৷

মুন্সীগঞ্জ:পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মুন্সীগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে৷ নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে ভাগ্যকুল পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে৷ এতে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের আরও নতুন কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে৷ পানিবন্দি রয়েছেন ৩০টি গ্রামের প্রায় চলি্লশ হাজার মানুষ৷ পানিতে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি ও সবজির ক্ষেত৷কয়েকটি এলাকায় রাস্তায় পানি ওঠতে শুরু করেছে৷ এদিকে দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট৷ পানিবন্দি এলাকায় বৃদ্ধ ও শিশুদের মাঝে পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে৷ জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল জানিয়েছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় প্রশাসন সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে৷ ইতিমধ্যেই দুর্গত এলাকায় চাল ও নগদ টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে৷

সিরাজগঞ্জ:যমুনার পানি সামান্য কমলেও সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে৷ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় যমুনার পানি সাত সেন্টিমিটার কমে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে৷তবে বন্যার পাশাপাশি টানা বৃষ্টিতে বন্যা কবলিতদের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে৷ জেলার কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালী উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি৷ সেই সঙ্গে কাজিপুর উপজেলার মেঘাই রিং বাঁধ ভাঙায় নতুন করে তিনটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছেন৷ টানা বন্যার কারণে বন্যাকবলিত মানুষদের বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা পানিবাহিত রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে৷সরকারিভাবে বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম৷ টানা বন্যায় মানুষ স্বাভাবিক কাজ করতে না পারায় তারা দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন৷

শরীয়তপুর:শরীয়তপুরের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে৷ তবে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড৷জেলার ২০টি ইউনিয়নের ২ শতাধিক গ্রামে মানুষের জীবনে নেমে এসছে চরম দুর্ভোগ৷ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন জেলার অন্তত ১ লাখ মানুষ৷ দুর্গত এলাকাগুলোতে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি৷তবে বন্যা কবলিতদের নামের তালিকা প্রস্তুতের কথা জানিয়েছে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক৷ অধিকাংশ টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গো-খাদ্যের চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে৷ শত শত একর ফসলী জমি তলিয়ে যাওয়ায় মারাত্বক ক্ষতির মুখে পড়েছেন স্থানীয় কৃষকেরা৷ বিদ্যালয়ের মাঠ ও শ্রেণী কক্ষে বন্যার পানি প্রবেশ করায় ১০টি ঊচ্চ বিদ্যালয় এবং ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷ নড়িয়া-সুরেশ্বর সড়কসহ জেলার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচলে বিঘ্ন হচ্ছে৷

কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি ধীর গতিতে কমলেও ব্রহ্মপুত্রের পানি এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে৷ বসতভিটা ও নিম্নাঞ্চল থেকে পানি দ্রুত সরে না যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগে রয়েছেন বানভাসীরা৷ খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে ভুগছেন তারা৷ দুর্গত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ৷রাজিবপুর উপজেলার শিবেরডাংগী এলাকায় পাকা সড়ক ধসে যাওয়ায় রাজিপুর ও রৌমারী উপজেলার সাথে গত ২ দিন ধরে ঢাকার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে৷ গত ১৮ দিন ধরে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও তিস্তা অববাহিকায় তলিয়ে থাকা গ্রামগুলোর মানুষ জন নৌকা ও কলাগাছের ভেলায় আশ্রয় নিয়ে দুর্বিসহ দিন পার করছে৷ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গবাদী পশুসহ আশ্রয় নেয়া লোকজন নিদারুন কষ্টে দিন পার করছেন৷ পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন অনেক পরিবারের সদস্যরা৷ অন্যদিকে চারণ ভূমি তলিয়ে থাকায় গবাদী পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বানভাসীরা৷

গাইবান্ধা: জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট ফজলে রাবি্ব মিয়া ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলায় বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন৷ তিনি নৌকায় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে এই ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন৷ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দুই উপজেলার প্রায় সব এলাকা ডুবে গেছে৷ এতে চর এলাকাসহ সর্বত্র লোকজন দারুন দুর্ভোগে পড়েছে৷ ডেপুটি স্পিকার শনিবার নিজের তহবিল থেকে ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর, গজারিয়া ও ফুলছড়ি ইউনিয়ন এবং সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া ও সাঘাটা ইউনিয়নে ৰতিগ্রসত্মদের মাঝে দেড় লাখ টাকার চিড়া, গুড় এবং নগদ ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করেন৷এ ছাড়া একই দিন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে বন্যার্তদের মাঝে ১৮ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়৷

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার হ্রাস পেলেও এখনও বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে৷ তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ২সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলেও কমেছে ধরলা নদীর পানি৷এদিকে,মাদারীপুর, জামালপুর মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে৷