Image - Why Strawberry shooting VERDICT went Bangladeshis disfavour in GREECE - 02

দৈনিকবার্তা-মাঈনুল ইসলাম নাসিম : ইউরোপে আইনের চেয়ে তার ফাঁক বেশি এমন কমন যে ডায়ালগ বহুকাল ধরে প্রচলিত আছে, সেই আইনের ফাঁক গলেই কি বেরিয়ে যাচ্ছে গ্রীসে বাংলাদেশিদের ওপর গুলিবর্ষনকারী প্রবল প্রতাপশালীরা ? ১৭ এপ্রিল ২০১৩ ‘নেয়া মানোলাদা’ গ্রামের প্রত্যন্ত মেঠোপথ রক্তে রঞ্জিত হলেও বাংলাদেশিরা কেন বঞ্চিত হচ্ছে আজ ন্যায়বিচার থেকে ? কোন অদৃ্শ্য শক্তি নয়, দৃশ্যমান শক্তির দাপটেই কি বিচারের বাণী কেঁদে চলেছে নীরবে নিভৃতে ? এতোসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সামনে চলে এসেছে বেশ কিছু অপ্রিয় সব সত্য।

রাজধানী এথেন্স থেকে ২৬০ কিলোমিটার দূরবর্তী কৃষিপ্রধান এলাকা ‘নেয়া মানোলাদা’র স্ট্রবেরি খামারবাড়িতে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত বাংলাদেশিদের উপর গ্রীক ফোরম্যান ও তার সহযোগীরা প্রকাশ্যে গুলি চালালে ২৯ জন বাংলাদেশি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আহতদের নেয়া হয় হাসপাতালে, সৌভাগ্যবশতঃ সেদিন জানে বেঁচে যান অনেকেই। গুলীবর্ষনকারীদের গ্রেফতার করে গ্রীক পুলিশ, মামলা হয় আদালতে। প্রতিবাদে ফেটে পড়েন বাংলাদেশিরা।

তীব্র নিন্দা জানানো হয় গ্রীসের মেইনস্ট্রিম বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিবার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে। সিএনএন বিবিসি আল-জাজিরাতে ফলাও করে সংবাদ প্রচারিত হয়। ‘রক্তাক্ত স্ট্রবেরি’ আখ্যা দিয়ে বর্জনের ডাক দেয়া হয় গ্রীসে ব্যাপক উৎপাদিত অর্থকরী এই সুস্বাদু ফল। এথেন্সে দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ বিভিন্ন গ্রীক মন্ত্রনালয়ের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে বাংলাদেশ সরকারের গভীর উদ্বেগের কথা জানান দেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ লেভেলে।

গ্রীক সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে আশ্বাস দেয় ‘নেয়া মানোলাদা’ অঞ্চলে আহত বাংলাদেশিদেরকে ‘স্টে পারমিট’ দিয়ে বৈধ করে নেবার। মূলতঃ রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই গুলিবর্ষন ঘটনার ৬ মাসের মাথায় আসে সুদিন। ১২ অক্টোবর ২০১৩ ‘নেয়া মানোলাদা’ প্রশাসন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের হাতে তুলে দেয় আহত বাংলাদেশিদের ‘স্টে পারমিট’। এই প্রতিবেদক সেদিন ‘নেয়া মানোলাদা’য় সরেজমিনে উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষ করেন রক্তের বিনিময়ে বৈধতা পাওয়া বাংলাদেশিদের উচ্ছাস।

বকেয়া বেতন সহ পর্যাপ্ত আরো ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় তখন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে মামলার রায় বাংলাদেশিদের প্রতিকুলে যাবার নেপথ্যে অপ্রিয় অনেক সত্যই উদঘাটিত হয়েছে ব্যাপক অনুসন্ধানে। বন্দরনগরী পাত্রাসের আদালতে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিরা যারা স্বাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনজীবির ‘হোমওয়ার্ক’ বলতে আসলে কিছুই ছিলো না। মামলার শুনানীর প্রথম দিবসেই বাংলাদেশিদের আইনজীবির নেক্কারজনক অনুপস্থিতি ‘বিসমিল্লায় গলদ’ হিসেবে পরিগণিত হয়।

এমনও হয়েছে, একই স্বাক্ষী একই দিন একই বিষয়ে কখনো কখনো স্ববিরোধী স্বাক্ষ্য দিয়েছেন, আবার কখনো কখনো বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। একাধিক স্বাক্ষীর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। মামলার শুনানিতে ভিক্টিমদের পক্ষ্যে যারপররনাই দুর্বলতার পেছনে আইনজীবির পাশাপাশি বাংলাদেশিদের পক্ষে কাজ করা দোভাষির আনাড়িপনাকেও এখন দায়ি করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দোভাষী ঐ বাংলাদেশির তেমন কোন অসৎ উদ্দেশ্য না থাকলেও তার ভাষাগত দুর্বলতা এবং ‘আইকিউ’ ঘাটতিতে পুরো বিচার প্রক্রিয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশিরা।

আইনজীবি ও দোভাষীর নেক্কারজনক পারফরম্যান্সের পাশাপাশি এথেন্সের বাংলাদেশিদের অতি উৎসাহী একটি মহলের বাড়াবাড়িতেও অনিশ্চিত হয়ে যায় আসামীদের প্রাপ্য শাস্তি, ভেস্তে যায় ক্ষতিগ্রস্তদের বকেয়া বেতন সহ বিশেষ ক্ষতিপূরণ পাবার বিষয়টি। গ্রীসের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্বস্ত সূত্র এই প্রতিবেদককে জানায়, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আন্দোলনের নামে আদালতের বাইরে হৈ-হুল্লোড় এবং উস্কানিমূলক মুভমেন্টে শুরু থেকেই বিব্রত বোধ করতে থাকে গ্রীক প্রশাসন।

ক্ষমতাসীন রাজনীতিক দলের তরফেও খুব নেতিবাচকভাবে নেয়া হয় আদালতের বাইরে বাংলাদেশিদের অপ্রীতিকর জমায়েত। বিচারকদেরও নজর এড়ায়নি এজলাসের বাইরের চিত্র। আন্দোলনকারীদের গতিবিধি এবং গ্রীসে তাদের অতীত-বর্তমান অনুসন্ধানে নেমে পড়ে গ্রীক গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন। বছরের পর বছর স্ট্রবেরি শ্রমিকদের শোষণকারী ‘মাস্তুরা’ তথা রক্তচোষা সুপারভাইজারদের সাথে আদালতের বাইরে হৈচৈকারীদের কারো কারো সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট হয় গোয়েন্দাদের কাছে।

তাছাড়া সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে যোগসাজশে আদালতের বাইরে আন্দোলনের নামে মূলতঃ বিচারাধীন বিষয়কে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা হিসেবে দেখা হয় গ্রীক প্রশাসনের তরফ থেকেও। মামলার আসামী তথা গ্রীক খামার মালিকের সাথে বর্ণবাদী রাজনৈতিক দল ‘গোল্ডেন ডন’-এর সুসম্পর্কের বিষয়টিও সামনে চলে আসে তখন। এমতাবস্থায় আদালতের রায় খামার মালিকের খুব বেশি প্রতিকুলে গেলে রাজধানী এথেন্স সহ গ্রীসের আনাচে-কানাচে নিরীহ বাংলাদেশিদের ওপর ‘গোল্ডেন ডন’ উগ্রবাদীদের চোরাগুপ্তা হামলা আশংকাজনকহারে বৃদ্ধি পাবে, এমন নিশ্চিত গোয়েন্দা তথ্য আগে থেকেই ভাবিয়ে তুলেছিল গ্রীক প্রশাসনকে।

পাত্রাস কোর্টের বিজ্ঞ বিচারকরাও টোটাল ইস্যুটি সম্যক অবগত ছিলেন এবং যার প্রভাব খুব সুষ্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় চলতি বছর জুলাইয়ের শেষে দেয়া তাঁদের রায়ে। তাছাড়া আসামীদের বিরুদ্ধে প্রথমে ‘হত্যা চেষ্টা’ হিসেবে মামলা দায়ের করা হলেও রহস্যজনক কারণে খুব দ্রুতই সেই মামলার মোটিভ পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় ‘ক্ষতি করার চেষ্টা’ হিসেবে। মামলার মোটিভ বদলে যাবার সেই রহস্যও অবশেষে আর রহস্যের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকেনি, পরিষ্কার হয়ে যায় দিনের আলোর মতো।

গ্রীক প্রশাসনের দৃষ্টিতে আদালতের বাইরে আন্দোলনকারীদের উস্কানিমূলক অপতৎপরতা, উগ্রপন্থী ‘গোল্ডেন ডন’ কর্তৃক রাজধানী জুড়ে বাংলাদেশিদের ওপর চোরাগুপ্তা হামলার প্রস্তুতির গোয়েন্দা তথ্য, সব মিলিয়ে স্পর্শকাতর এই ইস্যুতে তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিমুক্ত পলিসিকেই ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ হিসেবে প্রাধান্য দেয় গ্রীক প্রশাসন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিজ্ঞ বিচারকদের রায়ে সরকারের সেই পলিসিরই প্রতিফলন ঘটে পুরোমাত্রায়।

এদিকে গুলিবর্ষনের শিকার বাংলাদেশিদের হয়ে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতে রিভিউ আপীলের জোর প্রস্তুতি চলছে এখন এথেন্সে। নানামুখী দারুন চাপে আছেন বাংলাদেশিদের গ্রীক আইনজীবি। আপীল পরবর্তী সুপ্রিম কোর্টে বড় ধরণের তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিদের বকেয়া বেতন সহ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ আদায়ের একটি ভালো সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো সেপ্টেম্বরের শুরুতে এমন আভাসই দিয়েছে।

গুলিবর্ষন ঘটনার ভিডিও দেখুন :

[youtube_video id=”_m04RJd0xl8″]