Shark pic

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৬ নভেম্বর: যোগাযোগ ও বিদু্যত্‍ খাতের সহযোগিতা বাড়াতে প্রত্যাশিত তিন চুক্তি না করেই শেষ হলো অষ্টাদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম দিনের কর্মসূচি৷ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় কাঠমান্ডুর ‘রাষ্ট্রীয় সভাগৃহে’ সার্ক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে জোটের বিদায়ী চেয়ারম্যান মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম দুই দিনের এ সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন৷

সার্ক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেলা সাড়ে ১২টায় চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নির্ধারিত ছিল৷ কিন্তু তা না হওয়ায় নতুন চেয়ারম্যান নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সম্মেলন মুলতবি করেন৷সদস্য দেশগুলো একমত হতে না পারায় সার্ক আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা চুক্তি এবং সার্ক পণ্য ও যাত্রীবাহী মোটরযান চলাচল চুক্তি এবার নাও হতে পারে- এমন ইংগিত মঙ্গলবারই দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী৷

এরপর বিদু্যত্‍ সহযোগিতা বাড়াতে সার্ক কাঠামো চুক্তির সামান্য’ সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক চালিয়ে যান সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা৷ তবে তাদের সে চেষ্টা নিষ্ফলাই থাকে৷ বৈঠক সংশ্লিষ্ট একজন বুধবার সকালে বলেছিলেন, পর্দার আড়ালে’ অনেক কিছুই হয়, সুতরাং শেষ পর্যন্ত কি হবে তা বলা যায় না৷ তবে প্রথম দিনের নির্ধারিত সময়ে চুক্তি না হওয়ায় সেই আশাও টিকল না৷ বৃহস্পতিবার চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য কোনো সময়ও রাখা হয়নি৷

সম্মেলন শুরুর আগে জোর আলোচনা চললেও মূলত পাকিস্তানের বিরোধিতায় এই তিন চুক্তি আটকে যায়৷ পাকিস্তান বলছে, তারা এখনো চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য পপ্র্তুত নয়৷ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সড়কপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে প্রস্তাবিত ‘মোটর ভেহিকলস এগ্রিমেন্ট এর খসড়ায় বলা হয়েছিল, এর আওতায় পণ্য ও মালামাল পরিবহনের জন্য কার্গো ভেহিকল’, যাত্রী বহনের জন্য নিয়মিত বাস সার্ভিস এবং পিকনিক, স্টাডি টু্যর, সামাজিক অনুষ্ঠান বা এ ধরনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণকারীদের বাহনকারী যানবাহন সীমান্ত পেরিয়ে সদস্য দেশগুলোতে যাতায়াত করতে পারবে৷

সার্ক রিজিওনাল রেলওয়েজ এগ্রিমেন্ট ফর সার্ক মেম্বারস স্টেটস’ এর খসড়ায় কয়েকটি রুট ব্যবহার করে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তঃদেশীয় রেল নেটওয়ার্ক স্থপনের কথা বলা হয়৷ আর সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ফর এনার্জি কো-অপারেশন’ এর প্রস্তাবে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুত্‍ সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়, যার মধ্য দিয়ে এক দেশের বিদ্যুত্‍ সহজেই অন্য দেশ কিনতে পারবে৷

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনে তার বক্তৃতায় বলেন, এসব চুক্তি দ্রুত স্বাক্ষরিত হবে বলেই তার দেশের প্রত্যাশা৷সব মতপার্থক্য দূরে ঠেলে যৌথ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে আসার জন্যও সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি৷

আট সদস্য দেশের নেতৃবৃন্দ ও সার্কের পর্যবেক্ষক প্রতিনিধিরা বৃহস্পতিবার সকাল কাটাবেন কাঠমান্ডু থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে দ্বারিকা রিসোর্টে৷ সেখান থেকে ফিরে তারা বসবেন সমাপনী অধিবেশনে, যেখানে সম্মেলনের কাঠমান্ডু ঘোষণা চূড়ান্ত করা হবে৷ একইসঙ্গে আগামী সম্মেলন কবে কোথায় হবে- সে বিষয়ে আসবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা৷

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ইতোমধ্যে পরবর্তী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছেন৷ এর আগে চতুর্থ ও দ্বাদশ সম্মেলনও ইসলামাবাদে হয়েছিল৷ মতপার্থক্য ভুলে জনগণের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করুন: প্রধানমন্ত্রীপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মতপার্থক্য এক পাশে রেখে এতদাঞ্চলের জনগণের প্রকৃত সমৃদ্ধি আনতে সর্বশক্তি নিয়ে কাজ করার জন্য সার্ক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান

৷তিনি বলেন, সার্ক প্রকৃতপক্ষেই সার্বিক রাজনৈতিক সদিচছা ও উচ্চাশা অর্জন করতে পারে৷ এজন্য আমাদের মতপার্থক্য একপাশে রেখে এতদাঞ্চলের জনগণের প্রকৃত সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি আনয়নে সর্বশক্তি নিয়ে কাজ করতে হবে৷আরো বাসত্মবসম্মত, ফলাফলমুখী এবং সম্মিলিত সমৃদ্ধির লৰ্যে পারস্পরিক কল্যাণমূলক অংশীদারিত্বের পদক্ষেপ গ্রহণে সার্ক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন, আরো শানত্মিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও জ্ঞানভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া গঠনে অবদান রাখার অঙ্গীকার করি৷তিনি বলেন, দ্রুত উন্নয়নে সার্ক দেশগুলোকে তাদের সার্বিক প্রচেষ্টা, উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রয়োগ সর্বপর্যায়ে জোরদার করতে হবে৷

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য ও জলবায়ূ পরিবর্তন প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা আরো গভীরতর করার আহবান জানিয়ে বলেন, সার্কের কর্মকান্ডে গতিশীলতা আনয়নে আমাদের মধ্যে আরো খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার৷শেখ হাসিনা বলেন, দারিদ্র্য সার্ক অঞ্চলের অভিন্ন ও প্রধান শত্রম্ন৷ এটি এ অঞ্চলের শানত্মি ও উন্নয়নকে ব্যাহত করছে৷ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উলেস্নখ করে তিনি খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধানের আহবান জানান৷

এ অঞ্চলের উন্নয়নে সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়ে মোদী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় সমন্বিত উদ্যোগ যতোটা জরুরি, বর্তমান বিশ্বের আর কোথাও ততোটা জরুরি নয়৷সার্ক নিয়ে হতাশা ও সংশয় রয়েছে- মন্তব্য করে উপস্থিত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উদ্দেশ্যে নরেন্দ্র মোদী বলেন, এই নৈরাশ্যকে আশাবাদে রূপান্তর করতে আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে৷

নরেন্দ্র মোদী বলেন, ভবিষ্যত্‍ ভারত নিয়ে তিনি যে স্বপ্ন দেখেন পুরো সার্ক অঞ্চলে যেন তার বাস্তবায়ন ঘটে তিনি সে প্রার্থনা করেন৷আমাদের একে অন্যের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে- একসঙ্গে অনেক কিছু করারও আছে৷ আমি জানি ভারতকেই নেতৃত্ব দিতে হবে এবং আমরা আমাদেরটা করব৷ আমি আশা করি আপনারাও তা করবেন৷অন্যদিকে, পারস্পরিক লড়াই নয় বিদ্যমান সমস্যার সমাধানকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ৷সার্ক অঞ্চলের মানুষের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও শান্তি প্রতিষ্ঠাকে পাকিস্তান সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় বলেও জানান পাক প্রধানমন্ত্রী৷

শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য গভীর সংযোগ এ প্রতিপাদ্যে নেপালে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন৷এসময় নওয়াজ শরীফ বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে পাকিস্তান সব সময়ই সার্কের পাশে থাকবে৷ ১৮তম সম্মেলনের প্রতিপাদ্যটিতে সকল রাষ্ট্রের মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে৷আমাদের উচিত সকলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার৷ দারিদ্র্যকে সকলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জাতীয় সমস্যার সমাধান করতে সার্কভুক্ত সকল রাষ্ট্রকে একত্রে কাজ করতে হবে৷ এ অঞ্চলে সন্ত্রাস দমনে সকল সার্ক দেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালনোর আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে বুধবার নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে৷নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা বুধবার সকালে কাঠমান্ডুর সিটি হলে দু’দিনের এই শীর্ষ সম্মেলন উদ্বোধন করেন৷

সম্মেলনে নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার সাথে আফগানিসত্মানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভূটানের প্রধানমন্ত্রী টিশেরিং তোবগায়া, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ূম, পাকিসত্মানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এবং শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মহিন্দ রাজাপাকসে যোগ দিয়েছেন৷

এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘শানত্মি ও উন্নয়নে গভীর সংহতি’৷ সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা বলেন, সন্ত্রাসবাদ আমাদের অভিন্ন শত্রু এবং দৰিণ এশিয়া এর ভয়াবহ শিকার৷ সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা এবং ধমর্ীয় মৌলবাদ দৰিণ এশিয়ার শানত্মি ও স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করছে৷ তাই সন্ত্রাসবাদ দমনে আমাদেরকে সম্মিলিত ও দ্ব্যর্থহীন পদৰেপ নিতে হবে৷তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সকল প্রতিষ্ঠান ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা গুলোর মধ্যে স্বচছ ও কার্যকর সহযোগিতাসহ সার্কের আওতায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন৷

নেপালের প্রধানমন্ত্রী এ অঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ৰতি রোধে সকল সার্ক দেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানান৷ তিনি শানত্মি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সার্ক দেশগুলোর সহযোগিতা কামনা করেন৷এর আগে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ূম নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার কাছে সার্কের চেয়ারম্যানশিপ হসত্মানত্মর করেন৷

১৯৮৭ সালের নভেম্বর এবং ২০০২ সালের জানুয়ারির পর এনিয়ে তৃতীয়বার নেপালে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ ২০০৮ সালে নেপাল ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার পর এই শীর্ষ সম্মেলন কূটনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷সম্মেলনে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দৰিণ কোরিয়া, মরিশাস, মায়ানমার, ইরান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৯ জন পর্যবেৰকও যোগ দিয়েছেন৷

বৃহস্পতিবার কাঠমান্ডু ঘোষণা গ্রহণ এবং কয়েকটি আঞ্চলিক চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে কাঠমান্ডু সিটি হলে শীর্ষ সম্মেলন শেষ হবে৷ শীর্ষ সম্মেলনে মঙ্গলবার সমাপ্ত হওয়া সার্ক মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক এবং এর আগে সার্ক মন্ত্রীদের সভার প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হতে পারে৷শীর্ষ সম্মেলনে আঞ্চলিক পর্যায়ে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে৷ এগুলো হচ্ছে- সার্ক এগ্রিমেন্ট অন মোটর ভেহিকেলস, সার্ক এগ্রিমেন্ট অন রেলওয়ে সার্ভিস এবং সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন এনার্জি কো-অপারেশন৷নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহেন্দ্র বাহাদুর পান্ডে বলেছেন, এসব চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা চলছে৷

সার্ক হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত একটি অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক সংস্থা৷ ১৯৮০’র দশকে দক্ষিণ এশিয়ার এ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংক্রানত্ম সংগঠনটির ধারণা আসে এবং ১৯৮৫ সালে ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় এর প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ তখন বাংলাদেশ, ভূটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলংকাকে নিয়ে সার্ক গঠিত হয়৷ এরপর আফগানিসত্মানকে নতুন সদস্য ও বেশকয়েকটি দেশকে পর্যবেক্ষক হিসেবে গ্রহণের মধ্য দিয়ে এর সম্প্রসারণ ঘটে৷