price-hike-yr-by-yr

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি: পাইকারী ও খুচরা বাজারের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাশূণ্য বাজার। হরতাল আর অবরোধ শুরু হওয়ার আগে রাত নয়টার পরেও যা বিক্রি হয়েছে এখন সারা দিনেও তা হয়না। এভাবেই বর্ননা দিলেন হাজারীবাগের কয়েকজন ব্যবসায়ী। প্রত্যহ কোন না কোন পণ্যের দাম বাড়ছে। দাম বাড়ার পেছনে পণ্য সংকটের চেয়ে স্বেচ্ছাচারিতাই বেশী লক্ষণীয়। কতিপয় ব্যবসায়ী এমন আছে যে, পণ্যের দাম বাড়তে পারে বা বাড়ছে এমন কোন লেখা বা সংবাদ সে অবগত হলে নিজ উদ্যোগে পণ্যের দাম আরেক ধাপ বাড়িয়ে দেয়। দ্রব্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় ক্রেতারা স্বস্তিতে নেই। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই সাধরণের চলাচল কমে যায়। তার কারণ বাজার থেকে নিরাপদে বাসায় ফিরবে সে নিরাপত্তাটুকুও নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতাই এর মূল কারণ। পণ্যের অভাবে ও দ্রব্যের বাজারে আগুন দামে ক্রেতারা দগ্ধ। সব খানেই যেন আগুন আর আগুন। পেট্রোলের আগুনের চেয়ে অর্থনৈতিক আগুনের ভয়াবহতা মোটেই কম নয়। মোহাম্মদপুরের বস্তি, মিরপুরের ফার্নিচারের দোকান ও ঝুটের গোডাউনসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরাও। গড়িতে আগুন লাগায় মালিকরাও কাদঁছেন ! আর আগুন নেভানোর জন্য পথিককে ডাকছেন। কিন্তু পথিকরা তার ডাকে সাড়া দেয়না। কারণ সেও নিরাপদ নয়। সড়কে চলা যাত্রীরাও নিরাপদ নয়। পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ রাস্তায় বের হতে বাধ্য হচ্ছেন। সুস্থ শরীর নিয়ে বের হয়ে অনেকেই আগুনে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছেন, হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। কেউ আবার ক্ষুধার যন্ত্রণায় বিছানায় কাতরাচ্ছেন। পেট্রলের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এগিয়ে এলেও যারা বাজার মূল্যের আগুনে মানসিকভাবে দগ্ধ হচ্ছে তাদের আগুন নেভাতে কেউ আসেনা।

অবরোধ-হরতাল ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই পরিবহন মালিকরা ট্রাক ও কাভার্টভ্যানের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন দেড় থেকে দুইগুন। আমদানি করা পণ্য বন্দরে আটকে থাকায় ঢাকার মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পণ্য মজুদেও টান পড়েছে। মান ভেদে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১ থেকে দেড় টাকা। আর কোথাও কোথাও বস্তা প্রতি বেড়েছে একশত পঞ্চাশ থেকে দু’শ টাকার মতো। সয়াবিন লিটারে বেড়েছে ৮ খেকে ১০ টাকা, পামঅয়েলের দাম বেড়েছে লিটারে ৪ টাকা। চাহিদানুপাতে মালবাহী পরিবহন চলাচল করতে না পারায় সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবহন পুড়ে গেলে মালিকরা সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ পাবে কিন্তু চালক ও হেলপার, লেবার ক্ষতিগ্রস্থ হলে তার ক্ষতিপূরণ করে দেয়ার ব্যবস্থাাও নেই, সম্ভব নয়। যে কারণে ঝুকিনিতে শ্রমিকরা রাজি হচ্ছেনা। তাই পরিবহন চলাচল করতে পারছেনা বলে বাজারে পণ্য দ্রব্যের সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। মহাসড়কে নিরাপত্তা দেয়া হবে বলা হলেও ভরসা পাচ্ছেনা ব্যবসায়ীরা। যে কারণে সড়কে পণ্যবাহী পরিবহন তেমন দেখা যায় না। দূরপাল্লার পরিবহনগুলো চললে সড়ক-মহাসড়কের দু’ধারের খাবার দোকান ও তেলের পাম্পগুলো সচল থাকে। পরিবহনের চাকাকে ঘিরে অসংখ্য মানুষের জীবন জীবিকার চাকা ঘুরে, কিন্তু হরতাল আর অবরোধ হলে তারা বেকার হয়ে বসে থাকেন। এভাবে চলতে থাকলে মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটবে। অভাবে পড়লে মানুষের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। সরকারের ভুলে যাওযা উচিত নয়, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্ব গতির কারণে ক্রমশ মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। ব্যবসা না হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে গত ছয় মাসে খেলাফি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপর।

হরতাল-অবরোধে নানামাত্রিক ক্ষতি হয় তা জেনেও হরতালকে কেন আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়না ? সরকার হয়তো কখনোই সেটা করবেনা। কারণ সে জানে আগামী নির্বাচনে হেরে গেলে হরতাল নামক হাতিয়ারকে ব্যবহার করা হবে। সরকার ক্ষমতায় থেকেই যখন কার্যত বিরোধী দলকে আটকাতে হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি দিয়ে থাকে, সেই সরকার কখনোই হরতালকে নিষিদ্ধ করবেনা আপাতঃ দৃষ্টিতে তা-ই মনে হয়। নেতানেত্রীদের ক্ষমতার পরিবর্তন হয় কিন্তু ব্যবসায়ীদের দুঃখ দূর হয় না। ব্যবসায়ীদের সংগঠন প্রধানরা প্রায়শই বলে থাকেন, এই অচল অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করবেন, সাধুবাদ জানাই তাদের। তাদের এটাও ভাবা উচিত যার সিদ্ধান্তের কারণে এই অচল অবস্থা তৈরী হয়েছে তার কাছে যাওয়া হয়না কেন ? রোগী হয়ে ডাক্তার দেখানোর আগে রোগ যাতে না হয় সে জন্য টিকা বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে সেটা বেশী ভাল হয়। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বাজারকে অস্থির করে তোলা যেমন অপরাধ তার চেয়ে বড় অপরাধ ক্ষমতায় থেকে অপশাসনকে দীর্ঘায়িত করা। জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেয়ায় আজকের এ অচল অবস্থার তৈরী হয়েছে। শাসক শ্রেণীকে একথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। মজুদে টান পড়ায় রাতারাতি পণ্যের দাম বাড়ছে। চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এ- ই-াষ্ট্রির দাবি অনুযায়ী হরতাল-অবরোধের প্রথম ১৫ দিনে এসএমইসখাতে দেড়শ কোটি, উৎপাদন খাতে ১০০ কোটি, পণ্য ও পরিবহন খাতে ৬৮ কোটি, রপ্তানি খাতে ৬৯৫ কোটি টাকাসহ ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির আরেকটি খাত হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। বাণিজ্যমেলা ব্যবসায়ীদের জন্য প্রাণের সঞ্চার করে। ভোক্তার কাছে পণ্যের গুণাগুণ তুলে ধরার মৌসুম। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বোচ্ছাচারীতার কারণে এবারের মেলাতে আশানুরূপ ক্রেতা নেই। বিক্রেতারা ভাবেন আজকের চেয়ে আগামীকাল ভাল হবে কিন্তু সেই আশা হতাশায় রুপ নিয়েছে। রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকার আবাসিক হোটেলগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকছে। রাজনৈতিক কর্মসূচীকে ঘিরে উত্তেজনা থাকায় পুলিশের হয়রানির কারণে লোকসংখ্যা কম। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থা দেখেও না দেখার ভান করেন। জনগণ কষ্টে আছে এটা তাদের বুঝতে ও মানতে কষ্ট হচ্ছে।

জনগণ স্বস্তিতে নেই। কেউ খাবার পায়না আর কেউ চায়না এটাই দেখা যায় সবখানে। রাজধানীতে সবজি সংকট আর ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সবজি চাষিরা বিনামূল্যে সবজি বিলিয়ে দিচ্ছে ! এলাকাবাসীকে সবজি ফ্রি দিচ্ছে। ঘাসের পরিবর্তে সবজি খাওয়ানো হচ্ছে গরুকে। ফসল বুনেও বিক্রি করতে পারছেনা। আড়তে চাষিদের ভিড় নেই, নেই পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাও। ট্রাকে মাল পরিবহনের পরিবর্তে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ব্যবসার পুঁজি ফুরিয়ে যাচ্ছে, মাছের বাজারে মাছের দেখা নেই, যা কিছু মিলছে তাও আবার চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। ডাল, চাল আর সবজির দাম লাগামহীন। ঢাকায় ক্রেতাদের হাহাকার আর এলাকায় বিক্রেতা দিশেহারা। ডিম আর মুরগী নিয়ে বিপাকে খামারীরা। আমিষের চাহিদা মেটানো যাচ্ছেনা। পোলট্রিশিল্প সমন্বয় কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, গত ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অবরোধে তাদের প্রায় ২৫৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঢাকার আশপাশে পরিবহন কিছুটা চললেও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ঢাকার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সমস্যা প্রকট হচ্ছে। বাগদা চিংড়ির দাম অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় চিংড়ি চাষিরা দিশেহারা। চার মাস ধরে তাদের এই অবস্থা চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম ও চাহিদা কমে যাওয়ার এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। হরতাল-অবরোধে ক্ষতি হয় না এমন কোন খাত আছে কিনা তা বলা মুশকিল।

কিছু দিন পর পর রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায় মন্দাভাব চলছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, হরতালে ২০১৩ সালে ক্ষতি হয়েছিল ৬৪ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে প্রতি দিনের হরতালে গড়ে ১৬শ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। (যুগান্তর, ১৯/০১/১৫)। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পাইকারি বাজার , শপিংমল ও তৈরী পোশাক রফতানি খাতসহ ১৪ টি খাত। যার ফলে সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। হরতাল-অবরোধে দেশের অর্থনৈতি নারকীয় অবস্থা বলে শিকার করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। প্রশ্ন হলো এই হরতাল-অবরোধের দায় কার ? দুই নেত্রী একে অপরে দোষারোপ করছেন। সর্বদাই জনগণের কথা বলে নিজেদের দল ও কর্মীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন। সরকার আসে সরকার যায় তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়, কিন্তু জনগণ ৪৩ বছর আগেও য়েখানে ছিল, আজও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। সারাদেশে পাচশতাধিক নারী, শিশু, যুবক,বৃদ্ধ অগ্নিদগ্ধ হয়েছে তাদেরতো প্রধানমন্ত্রী দেখতে গেলেননা। যখন পুলিশ কর্মকর্তারা দগ্ধ হলো তখনই তিনি দেখতে গিয়ে দোষীদের হাত পোড়ানোর কথা উচ্চারণ করলেন। সাধারণ মানুষ তাই মনে করে, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের উপর ভর করে সরকার চলছে বলেই তিনি পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়েছিলেন। সরকার জনগণের ভাল চাইলে জনগণ যাতে দগ্ধ না হয় সে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহে তা সম্ভব হয়নি। এর আগে একজন দগ্ধ রোগী ‘আমি অসুস্থ সরকার চাইনা’ এই কথা বলার পর থেকে বার্ণ ইউনিটে মন্ত্রী ও আমলাদের আনাগোনা কমেছিল, জনগণ তা ভুলেনি।

দীর্ঘদিন থেকে আমরা দেখে আসছি, অধিকাংশ নীতি নির্ধারকরা চাটুকারিতায় ব্যস্ত হওয়ায সমস্যা দূর না হয়ে বরং বাড়ছে। শাসকদলের শোষণে দেশের আজ নাজুক পরিস্থিতি। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের মুখে শোনা যাচ্ছে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে। তারা কি করে এতটা নিশ্চিত হয়ে এমন মন্তব্য করলেন এটা জনসাধারণের একটি প্রশ্ন। আমরা কি তাহলে বেগম জিয়ার কথাটি প্রহণ করেতে পারি না যে, তিনি বলেছেন, সহিংস ঘটনার পেছনে সরকারের হাত রয়েছে। তা যদি না হয় তাহলে কি করে মন্ত্রীরা এক যোগে এক সপ্তাহ সময় বেঁেধ দিলেন ? প্রায় তিন সপ্তাহের এই অবরোধ-হরতালে ত্রিশ জনের অধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, এদের পরিবারের কি হবে ! একটি সুষ্ঠ নির্বাচন না দেয়ায় সাধারণ মানুষকে পুড়ে কয়লা হতে হচ্ছে, পরিবহনের চালক পুড়ে তার আসনে পড়ে আছেন। এই বিভৎস ছবি দেখেও কি একটি অর্থবহ সংলাপের কথা মনে পড়েনা । এটি কাঙ্খিত নির্বাচন দিয়ে জন সমর্থন প্রমাণ করুন। রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে আসলে অনেক অসঙ্গতি দূর হবে বলেই সাধারণ মানুষ মনে করেন।

২০১৩ সালের অচলাবস্থা কেটে উঠতে না উঠতেই আবার অর্থনৈতিক বিপর্যয় যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে এমন ভাবনা কল্পনা জগত পার করতেও ব্যর্থ হবে। কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নেই বরং যা কিছু চলমান আছে তাও আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাবা আর ভাইয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন না করে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তা করা দরকার। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো ঐকমত্য পোষণ করে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, জনশক্তি রপ্তানি, আমাদানি ও রপ্তানি খাতের সমস্যা দূর করে, বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে সততা ও দক্ষতার সাথে পথ চলতে পারলে আশা করা যায় এই দৈন্যতা দূর হবে।

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।