image_1682_210032

দৈনিকবার্তা-নীলফামারী, ২ ফেব্রুয়ারি: আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়/ হয়তো বা হাঁস হবো, কিশোরীর ঘুঙুর রহিমে লাল পায়/ সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে/ আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে/ জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলার সবুজ করুণ ডাঙ্গায়/ হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে/ হয়তো শুনবে এক লক্ষ্মীপ্যাঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে”।

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার উপমায়- রুপকল্পে নানাভাবে উঁকি দিয়েছে একটি পাখিই সবচেয়ে বেশি। পাখিটিকে তিনি আদর করে বলেছেন লক্ষ্মী পাখি। আসলে পাখিটির প্রচলিত নাম লক্ষ্মীপ্যাঁচা। জীবনানন্দের আমলে ‘প্যাচা’ না লিখে লেখা হতো ‘পেচা’। কোনো একসময় এদেশের প্রতিটি গ্রামেই ইঁদুর- শিকারী এ নিশাচর পাখিটির আনাগোনা ছিল। ফসলের ক্ষেতে আর গোলা ঘরে ইঁদুরের উৎপাত দমিয়ে রাখতে লক্ষ্মী- প্যাচার জুড়ি ছিল না। তাই হাজার বছর আগে গাঁয়ের মানুষ পাখিটির নাম রেখেছিল ‘লক্ষ্মী’। পাখিটি ছিল লক্ষ্মীর দূত, লক্ষ্মী দেবীর বাহন। এই উপমহাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে লক্ষ্মী-প্যাচার কদর আরও বেশি। গুজরাটে লক্ষ্মী- পাঁচাকে সাক্ষাৎ দেবীর আসনেই বসানো হয়েছে। লক্ষ্মী-পাঁচার গুজরাটি নাম ‘রেবি দেবী’। লক্ষ্মী- প্যাঁচার ইংরেজি নাম ‘বার্ন ওল’ অর্থাৎ গোলা- ঘরের প্যাঁচা। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘টাইটো অ্যালবা’ অর্থাৎ সাদা প্যাঁচা।

বাংলার সেই লক্ষ্মী পাখিটি এখন আর চোখেই পড়ে না। সে এখন এক বিপন্ন পাখি। এদেশের গ্রামে কিন্ত সহজে এখন লক্ষ্মী পাঁচা খুঁজে পাবেন না। অধিকাংশ গ্রাম থেকেই পাখিটি বিদায় নিয়েছে। গ্রাম থেকে এর তিরোধানের অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে একটা বড় কারণ উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের জনপ্রিয়তা। খেতে পানি জমিয়ে বোরো চাষের প্রচলন হবার ফলে ফসলের জমিতে ইঁদুরের বংশ নিপাত হয়েছে। অন্যদিকে কৃষকের উদ্বৃত্ত ফসল পুরনো দিনের বাঁশ, চাটাই ও মাটি দিয়ে গড়া গোলা- ঘরের বদলে পাকা গুদাম-ঘরও সাইলোতে স্থান পাচ্ছে। এর ফলে গাঁয়ের ইঁদুরের চিকন স্বাস্থ্য মোটা ও সুন্দর করার সুযোগ কমে গেছে। গ্রামে আজ ইঁদুরের আকাল। গ্রামীণ জীবনযাত্রার এ পরিবর্তনগুলো আমাদের জন্য যতটা সুখকর, লক্ষ্মী- প্যাঁচার জন্য ততটা নয়।

লক্ষ বছর আগে লক্ষ্মী- প্যাঁচারা হয়তো আর সব প্যাঁচার মতো গাছের কোটরে কিংবা মাটির গর্তে বাস করত। তবে হাজার বছর ধরে মানুষের গোলা-ঘরে বাস করে এর ঠিকানা বদলে গেছে। মানুষের বসতবাড়ির অন্ধকার সিলিং এখন এর হোম অ্যান্ড্রেস। গাছে কি করে বাসা করতে হয় সম্ভবত পাখিটি পুরোপুরি ভুলে গেছে। মানুষের ঘরে স্থান না দিলে পৃথিবী থেকে এরা হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আবার তা নাও হতে পারে: টিকে থাকার ক্ষমতা এদের কম নয়। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর সব মহাদেশে এর বসবাস আছে। এককালে আমাদের দুশ্চিন্তা ছিল, গাঁয়ের পুরনো হোম অ্যান্ড্রেসটা। খোয়া যাওয়ার পর লক্ষ্মী- প্যাঁচারা অন্যত্র নতুন আবাস গড়ে নিতে পারছে কি!

বাংলাদেশের গ্রাম থেকে লক্ষ্মী- প্যাঁচা যে উৎখাত হয়ে যাচ্ছে তা আমরা লক্ষ্য করেছি বহুদিন আগেই। অনেকদিন ধরেই দেখছি, রাতে গ্রামের পথে হাঁটলে লক্ষ্মী- প্যাঁচার দেখা মেলে না। সাপের মতো ‘হিস-হিস’ শব্দে এর ডাকও আর কানে আসে না। গাঁয়ের মানুষ এখন আর আমাদের লক্ষ্মী- প্যাঁচার কোনো সন্ধান দিতে পারে না। অনেক নবীন চাষি কোনোদিন লক্ষ্মী- প্যাঁচা দেখেনি। লক্ষ্মী- প্যাঁচার কথা বললে তারা সাধারণত খুঁড়লে- প্যাঁচার উল্লেখ করে। ছোটখাটো পোকামাকড় খেয়েই রাত কাটে বলে গাঁয়ে আজও এ প্যাঁচাটি টিকে আছে। লক্ষ্মী- প্যাঁচার দেখা পেয়েছে বলে যারা দাবি করে তাদের জেরা করলেই বুঝা যায় তারা আসলে খুঁড়লে- প্যাঁচা দেখেছেন।

গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে গেলেও ভাগ্যক্রমে শহরে- নগরে এখনও দু’একটি লক্ষ্মী- প্যাঁচার দেখা এখনও মেলে। যেমন এই শহরেই মাঝে মাঝে মেলে দেখা। লক্ষ্মী- প্যাচারা গ্রাম ছাড়লেও তাই এখনও দেশ ছেড়ে যায়নি। আমাদের মতো এরাও এখন শহরবাসী হয়েছে। আমাদের মতোই শহরের ঝঞ্ছাট আর দুষণ নিয়ে শত অভিযোগ মনে চেপে রেখে এই ইট- কাঠ- লোহারহরে এদের শেষ আশ্রয় হয়েছে।