24177

দৈনিকবার্তা-কুমিল্লা,৩ ফেব্রুয়ারি: ভোর হলো না। গন্তব্যে পৌঁছাও গেল না। ঘুমের মধ্যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। ভোররাতে গুপ্তঘাতকের মতো যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে বাসের ভেতর পুড়ে কয়লা হয়েছেন সাতজন। আহত ও দগ্ধ হয়েছেন কমপক্ষে ২৮ জন।মঙ্গলবার ভোররাতে উপজেলার জগমোহনপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এ ঘটনায় আরো অন্তত ২৮ জন আহত হয়েছেন, যাদের ১০ জনই দগ্ধ হয়েছেন।

কুমিল্লা ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মনির হোসেন জানান, কক্সবাজার থেকে ঢাকামুখী আইকন পরিবহনর একটি বাস ভোররাত সাড়ে ৩টার দিকে জগমোহনপুর এলাকায় পৌঁছালে তাতে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে অবরোধ সমর্থকরা। এতে বাসটিতে আগুন ধরে পুড়ে ঘটনাস্থলেই সাত জনের মৃত্যু হয়।কুমিল্লা ও চৌদ্দগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়।আহতদের উদ্ধার করে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে কয়েকজনকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।দগ্ধ ১০ জনকে পরে ঢাকায় পাঠানো হয় বলে কুমিল্লা মেডিকেলের পরিচালক হাবিব আব্দুল্লাহ সোহেল জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার ভোররাত সাড়ে তিনটার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়াবাজার-সংলগ্ন জগমোহনপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আইকন পরিবহনের বাসে এই হামলা হয়।বাসের যাত্রী ও হাসপাতাল সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, নিহত ব্যক্তিরা হলেন যশোরের সদর উপজেলার নুরুজ্জামান পপলু ও তাঁর স্কুলপড়য়াা মেয়ে মাইশা, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার আবু তাহের ও আবু ইউসুফ, নরসিংদীর পলাশ উপজেলার আসমা বেগম ও তাঁর ছেলে শান্ত এবং ঢাকা কাপ্তানবাজারের ওয়াসিম।নিহত সাতজনের লাশ সকালে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মর্গে নেওয়া হয়।আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ জনকে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। দগ্ধ নয়জনকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেওয়া হয়। বার্ন ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক মির্জ্জা মু. তাইয়েবুল ইসলাম বলেন, দগ্ধ নয়জনের মধ্যে তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। বাকি ছয়জন নিজ উদ্যোগে ঢাকায় চলে গেছেন। এই ছয়জনের শরীরের ৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে জানানো হয়েছে, দগ্ধ হওয়া ছয় ব্যক্তি ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ভর্তি হওয়া ব্যক্তিরা হলেন কক্সবাজারের মো. হানিফ (৩৫) ও রাশেদুল (২৫), মানিকগঞ্জের মো. ফারুক (২৩) ও মো. জিলক্বদ (২০), ফরিদপুরের মো. আরিফ (২২), নারায়ণগঞ্জের মো. শফিকুল (১৮)।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ খন্দকার জানান, রাশেদুলের ৮০ শতাংশ ও শফিকুলের শরীরের ২৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় তাঁদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জিলক্বদের শরীরের ২০ শতাংশ, আরিফের ১০ শতাংশ ও হানিফের ৭ শতাংশ পুড়ে গেছে।মিতার বরাত দিয়ে চৌদ্দগ্রামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবময় দেওয়ান জানান, পপলু ঠিকাদার ছিলেন। ব্যবসায়িক কাজে কক্সবাজার যাওয়ার সময় সাগর দেখাতে স্ত্রী ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যান তিনি।

আহত যাদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে তাদের মধ্যে নয় জনের পরিচয় জানা গেছে।তারা হলেন- বাসচালক দুলাল (৪৫), যাত্রী মানিকগঞ্জের ফারুক আহমেদ (২৩), শরিফুল (১৯), আলী হোসেন (২০), নারায়ণগঞ্জের জিলকদ (২২), শফিকুল ইসলাম (২২), কক্সবাজারের রাশেদুল বাদশা (৪২), হামিদ (৩৪) ও ফরিদপুরের আরিফ (১৮)।এদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে কুমিল্লা মেডিকেলের ডা. হাবিব জানান।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, আইকন পরিবহনের বাসটি যাত্রী নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফিরছিল। ভোররাত সাড়ে তিনটার দিকে বাসটি জগমোহনপুর এলাকায় পৌঁছে। এ সময় বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এতে বাসে আগুন ধরে যায়। আগুনে পুড়ে বাসের ভেতর সাতজন মারা যান। আহত ও দগ্ধ হন অন্তত ২৮ জন। এছাড়া কুমিল্লা মেডিকেল ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরো অন্তত ১৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এরা হলেন- কক্সবাজারের চকরিয়ার মৃত আব্দুল নূরীর ছেলে জমির উদ্দিন, পাহাড়চান্দা গ্রামের সালেহ আহমেদের ছেলে হানিফ, বানিয়াছড়া গ্রামের মৃত আব্দুন নবীর ছেলে জমিরউদ্দিন, টেকনাফ এলাকার নুরুল আলমের ছেলে মোহাম্মদ, নারায়ণগঞ্জের ওলুপাড়া কাত্তাহকান্দার গ্রামের আফাজ উদ্দিনের ছেলে বাবু, একই এলাকার মো. আকরাম হোসেন মিয়ার ছেলে মো. আমির হামজা, মাইনউদ্দিন, আব্দুল লতিফের ছেলে মো. ঈমান আলী, আব্দুল গওহরের ছেলে গোলাপ হোসেন।

জামালপুরের কমলনগর গ্রামের ইউনুছ মোল্লার ছেলে শরীফ, আব্দুস সালামের ছেলে ফারুক আহমেদ, হাতিগাড়া উপজেলার গকুল নগর গ্রামের আকবর আলীর ছেলে আজিজ, যশোরের মাহরুহা বেগম, কালিরবাজার এলাকার আলমগীরের ছেলে রাহুল, নরসিংদী জেলার পলাশ এলাকার জসিম উদ্দিন মানিকের ছেলে মুন্না।চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্ট নাজিম উদ্দিন বলেন, পেট্রলবোমার আগুনে বাসটির সব আসন পুড়ে গেছে।যাত্রীরা ঘুমে থাকায় হতাহতের সংখ্যা বেশি হয়েছে।

কুমিল্লার দগ্ধ ছয়জন বার্ন ইউনিটে ভর্তিনিহত নুরুজ্জামানের স্ত্রী মাফরুহা (৩৭) এ ঘটনায় আহত হয়েছেন।পুড়ে কয়লা হয়েছে তাঁদের মেয়ে মাইশা। চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন মাফরুহা বলেন, বাসের বেশির ভাগ যাত্রী ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ আগুন দেখে চিৎকার করে বাসের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ি।মাফরুহা জানান, তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে ওই বাসে ওঠেন। তাঁর স্বামী ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন।

নিহত আসমা বেগমের ছেলে মুন্না জানান, কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে তাঁরা বাসে ওঠেন। নেমে যাওয়ার কথা ছিল কাঁচপুরে। তার আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। এ ঘটনায় তাঁর ভাই শান্তও মারা গেছে।ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তীসহ মহাসড়ক পুলিশের কর্মকর্তারা। তাঁরা হতাহতের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উত্তম চক্রবর্তী বলেন, দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।

এদিকে, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়াবাজার এলাকার জগমহোনপুরে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা মেরে অগ্নিসংযোগে দগ্ধ মানুষ ও নিহতদের দেখতে ঘটনাস্থলে গিয়ে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক এমপি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে বলেছেন, খালেদা জিয়া কি নির্মম হত্যা কান্ড আপনি দেখে যান। পুড়ে যাওয়া মানুষকে শান্তনা জানানোর ভাষা আমার জানানেই আমি আজ অবাক এসব রাজনীতি নয়। হত্যা নৈরাজ্য করে দেশকে পাকিস্তান বানাবেন না, নিরহ মানুষ হত্যা করে ক্ষমাতায় যাওয়া খালেদা জিয়া”

মন্ত্রী আরো বলেন, যারা দেশের বিরুদ্ধে, জাতির বিরুদ্ধে, পতাকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, হরতাল-অবরোধের নামে মানুষ হত্যা করে-গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে তারা নৈরাজ্যবাদী লুণ্ঠনকারী এদের বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়ে মাঠে থেকে প্রতিহত করতে হবে। এরা ৭১ এর ন্যায় সন্ত্রাসী কায়দায় মাঠে নেমেছে এরা পাকিস্তানের দালাল তারা দেশের মানুষের শান্তি চায়না। পরিদর্শন কালে আরো উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক হাসানোজ্জামান কল্লোল, পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী, হাইওয়ে পুলিশের ডিজি , র‌্যাব-১১ কুমিল্লা অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার শিবলী আহমেদ, কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্রশাসক আলহাজ্ব ওমর ফারুক, আনসারের এরিয়া কমান্ডার সহ স্থানীয় আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ।

এর পূর্বে মন্ত্রী মিয়াবাজার আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে এক প্রতিবাদ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন এসময় অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা আওয়ামলীগের সহ-সভাপতি ভাইস চেয়ারম্যন নরুল ইসলাম হাজারী, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী সেলিম, জেলা আওয়মালীগ সদস্য আলী হোসেন চেয়াম্যান, চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান, উপজেলা আওয়ামীলীগের যগ্ম সধারণ সম্পাদক আক্তার হোসেন পাটোয়ারী, বাতিসা ইউপি চেয়াম্যান জাহিদ হোসেন টিপু, উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক ও শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহজালাল মজুমদার, আব্দুল বারীক, মীর হোসেন মীরু, রহমত উল্লাহ বাবুল, মিয়া মোঃ নিজাম, ভিপি মাহবুব ইসলাম প্রমূখ।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধের ২৯ দিন আজ। এ ছাড়া রোববার থেকে চলছে ৭২ ঘণ্টার হরতাল। সারা দেশে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের চলমান ৭২ ঘণ্টার হরতাল আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বিরোধী জোট।মঙ্গলবার বিকেলে এক বিবৃতিতে জোটের পক্ষ থেকে হরতালের সময়সীমা বাড়ানোর এই ঘোষণা দেন।

বিবৃতিতে জানানো হয়, নেতা-কর্মীদের খুন-গুম, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিচারব্যবস্থার ওপর সরকারি নগ্ন হস্তক্ষেপ, খালেদা জিয়া এবং দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ সব নেতা ও বিশিষ্ট নাগরিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রতিবাদে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি চলমান ৭২ ঘণ্টার শান্তিপূর্ণ হরতাল ৫ ফেব্র“য়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বাড়ানো হলো।গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে রোববার থেকে টানা ৭২ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছিল বিএনপি-জোট। এই ৭২ ঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হরতাল বাড়ানোর ঘোষণা এল।দেশব্যাপী ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে খুন, গুম, হামলা-মামলা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সোমবার থেকে চলা ৭২ ঘণ্টা হরতালের সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।মঙ্গলবার বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে হরতালের সময় বাড়ানোর কথা বলা হয়।

৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ চলছে। এর দুই দিন আগেই সহিংসতার শুরু। সহিংসতায় এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আগুন দেওয়া হয়েছে চার শতাধিক যানবাহনে। আরও প্রায় ৫০০টি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে।বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করতে না পেরে সারাদেশে লাগাতার অবরোধের ডাক দেন। এর ফাঁকে ফাঁকে হরতালের ঘোষণা আসছে বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষ থেকে। সর্বশেষ রোববার ভোর থেকে সারা দেশে ৭২ ঘণ্টার হরতাল করছে তারা।

হরতাল-অবরোধে গাড়িতে আগুনে এবং পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে নিহতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে। এছাড়া আগুনে পুড়ে ও বোমায় দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শতাধিক মানুষ, যাদের বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।