action aid

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২২ মার্চ: সুপেয় পানির অভাব, ল্যাট্রিন সুবিধা না থাকা, বাসস্থলে থাকার অনিশ্চয়তা, শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ না থাকা, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার অভাবের মত দশটি বিষয়ের কারণে মানসম্পন্ন জীবন অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছেন বস্তিবাসীরা। এই দশটি অগ্রাধিকার পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বস্তিবাসীরা দারিদ্রতা থেকে মুক্ত হতে পারছে না। নগর বাস্তিবাসীদের সমস্যা সমাধানে সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা না থাকায় এমন অবস্থা।একশনএইড বাংলাদেশ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েরসহায়তায় যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠান (আইডিএস) এর করা ‘নগর জনপদে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ ও জীবনমান’ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

রোববার ঢাকার একটি হোটেলে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। গবেষণা প্রকাশ অনুষ্ঠানে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠানের ফেলো ড ডলফ টি লিনটেলো বলেন, গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, নগর বস্তিবাসীদের জীবনমান অত্যান্ত খারাপ। তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের কোন উদ্যোগ নেই। জীবন বাঁচাতে বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মত মৌলিক চাহিদা পূরনে সরকারের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পান না বস্তিবাসীরা।

বাংলাদেশ ও ভারতে ২০১৪ সালে নগর জনপদে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ ও জীবনমান’ বিষয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের বগুড়া, চট্টগ্রাম ও ঢাকা নগরীর সাতটি বস্তিতে গবেষণার জন্য জরিপ করা হয়। জরিপ ও দলীয় আলোচনার মাধ্যমে ৭০৯ জন পুরুষ এবং ৭৫৫ জন নারীর নিকট থেকে এ গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

গবেষণা ফলাফল প্রকশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন ঢাকার কয়েকটি বস্তির বাসিন্দারা। এর মধ্যে কল্যানপুর ইঞ্জিনিয়ারিং হাউজিং সোসাইটি বস্তির মোফাজ্জল হোসেন বলেন, “৩৫ বছর ধরে বস্তিতে আছি। কোন সরকারই বস্তিবাসীদের নিয়ে কাজ করে না। থাকার জায়গা, পানি, চিকিৎসা, কর্মের সুযোগ, শিক্ষার সমস্যা দিন দিন তীব্র হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমাদের দেখার কেউ নেই। রায়েরবাজার বস্তি থেকে আসা কুলসুম বেগম বলেন, রাতে মশার কামড়ের সঙ্গে থাকে উচ্ছেদের ভয়। পানি, বিদ্যুৎ, টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। সবসময় আতঙ্কে দিন কাটাই আমরা।

সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক মর্যাদা এবং ক্ষমতায়নের মত বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। গবেষণায় অংশ নেয়া শতভাগ বস্তিবাসী মনে করেন, তাদের প্রধান সমস্যা নিরাপদ পানির অপ্রাপ্যতা। ল্যাট্রিন সুবিধার অভাব, বাসস্থান না থাকা, শিশুর বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ না থাকা, কাজের কম সুযোগ, ধর্মীয় আচার পালনে ব্যবস্থা না থাকাকে বস্তিবাসীরা বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া আরো সমস্যা প্রতিনিয়ত তারা মোকাবেলা করেন। তার মধ্যে আছে বাসস্থানের মালিকানা না থাকা, যাতায়াতে অসুবিধা, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, জীবনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার অভাব, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা, বিনোদন সুবিধার অভাব।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক একশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ঘরে থাকতে পারবে কিনা, খাবার জুটবে কিনা, সন্তান শিক্ষা পাবে কিনা তা নিয়েই চিন্তার অন্ত নেই বস্তিবাসীরা। তাদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ নেই। ভবিষ্যৎ বলতেও কিছু নেই। গবেষণার মাধ্যমে আমরা সেখানকার পরিস্থিতি তুলে এনেছি। এখন সরকার যদি পরিকল্পনা ও নীতির মাধ্যমে উদ্যোগ নেয় তবে বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়ন হবে।

অনুষ্ঠানের সভাপতি তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, “দারিদ্র দূরীকরণে সরকারের যত পরিকল্পনা, নীতি , কৌশল সব পল্লী বা গ্রাম কেন্দ্রীক। নগরের দারিদ্র দূর করতে সরকারের কোন পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা নেই। তাই বস্তিবাসীর জীবনমান দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে।
সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের কোষাধক্ষ্য ড. সালমা শাফি বলেন, “বস্তিবাসীদের সেবা নেয়ার জন্য কোন যায়গা নেই। সরকারের উচিৎ ছিল তাদের কাছে সেবা নিয়ে যাওয়া। সরকারও এখনও সেই নীতি নিতে পারেনি। শত চেষ্টা করেরও আমরা বস্তিবাসীদের জন্য এই কাজ করতে পারিনি। ঢাকা শহরের মাস্টার প্ল্যানে এই পরিকল্পনা থাকতে হবে।

গবেষণায় দেখা যায় শহরের বস্তিতে বসবাসরত এই মানুষগুলো বেশিরভাগই যেমন অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমের সাথে জড়িত, তেমনি এদের অল্প বিস্তর পাওয়া সেবাগুলো তারা পায় অপ্রাতিষ্ঠনিক উৎস থেকে। ফলে তাদেরকে বেশি পয়সা দিয়ে মৌলিক সেবাসমূহ কিনতে হয়, বাধ্য হয়েই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বস্তিবাসীরা থাকে সরকারি খাস জমিতে যা কিনা কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির আয়ত্ত্বে থাকে। তাই বাসস্থান, বিদ্যুৎ, পানি পেতে তাদের জমির মালিকের সাথে মৌখিক চুক্তিতে যেতে হয় চড়া দামে। এতে তাদের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যায়। ফলে তারা দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পায় না।

বস্তিবাসীর জীবন মান উন্নয়নে এলাকাভিত্তিক সুষ্ঠু নীতি ও কর্মসূচি প্রয়োজন বলে গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে। শহরকেন্দ্রিক দারিদ্র্য সম্পর্কিত নীতিমালার অভাব এবং সরকারি সেবাসমূহের অপ্রতুলতার কারনেই বস্তিবাসীর এই অবস্থা। সরকারি সেবাসমূহের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা উঠে এসেছে গুরুতে¦র সাথে। গবেষণার নীতিগত ফলাফল তুলে ধরে একশনএইড বাংলাদেশের পরিচালক ড. তারিকুল ইসলাম বলেন, বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়নে তাদের প্রয়োজনীয় অগ্রাধিকারগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মৌলিক সেবাসমূহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল শহরবাসীর জন্য স্থায়ী ও নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করতে হবে। আর এ কাজ করতে সরকারকেই প্রথম এগিয়ে আসতে হবে।

গবেষণার ফলাফল তুলে ধরতে গিয়ে ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. ফেরদৌস জাহান বলেন, যেহেতু নগরের দারিদ্র্য জনগোষ্ঠী দখল করা জায়গায় ভাড়া দিয়ে থাকছে, তাই নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেকা ক্ষেত্রেই বঞ্চিত।সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হলেই দারিদ্র্য জনগোষ্ঠী তাদের জীবনমান উন্নয়নের পথ নিজেরা খুঁজে নিতে পারবে।

বিভিন্ন শহরে ভিন্ন ভিন্ন বস্তিতে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সেবাসমূহ আদৌ পাচ্ছে কিনা এবং তা থেকে তারা কতটুকু মানসিক সন্তুষ্টিতে আছেন সেগুলো এই গবেষণায় চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাদের প্রয়োজনসমূহকে অবশ্যই সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমের সাথে জড়িত শহরের বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়নকল্পে নীতিমালা ও কর্মসূচি গ্রহণে এ গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জীবনমান উন্নয়নে মানুষের অগ্রাধিকারগুলোকে গুরুত্ব প্রদান এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।