Thakurgaon disabled pic-1

দৈনিকবার্তা-ঠাকুরগাঁও ৬ এপ্রিল: ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতিবন্ধী শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত। শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় বাইরে এখনো অধিকাংশ প্রতিবন্ধী শিশু আর সরকারি সুযোগ সুবিধাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শিক্ষা কার্যক্রমের মুল স্রতধারায় আনতে না পরলে প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে আশংকা অনেকেরই।

সবার আগে পরিবার থেকেই অবহেলিত আর সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশুরা। সখপুরনতো দুরের কথা, ভাল খাবারও জোটেনা বেশিরভাগ শিশুর কপালে। নেই বিনোদন আর অন্যান্য সুবিধাও। দারিদ্রতা ও অসচেতনতায় অনেক প্রতিবন্ধী শিশুদের রাখা হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরে। সদর উপজেলার বরুনাগাঁও মাদ্রাসা পাড়ার আব্দুর রশিদ জানান, পরিবারের সদস্য ৫জন। এর মধ্যে স্ত্রী, ও দুই ছেলে শামীম ও রুপম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। সংসারের এক হাতের উপার্জন দিয়ে সংসার চলে কোনমতে। লেখাপাড়া করাব কি করে। দু-বেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে কোন মতে দিন কাটে। আব্দুর রশিদ আরো বলেন, অনেকে এসে নাম লিখে নিয়ে যায় কিন্তু প্রতিবন্ধীদের ভাতা জোটেনা আমার কপালে। একই গ্রামের দুলু মোহাম্মদ অভিযোগ করে বলেন, তার মেয়ে প্রতিবন্ধীর ভাতার জন্য দালালকে ৫শ টাকা দিয়েছি। কিন্তু সেই ভাতা দেখা পাইনি।

প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজ পর্যায় পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের লেখাপাড়ার সুযোগ সুবিধার কথা বলা হলেও নেই তাদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষা উপকরন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা লোখাপড়ায় এগিয়ে গেলেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও শিক্ষক একে অন্যের ভাষা বুঝতে না পারায় পিছিয়ে পরছে তারা। এতে স্কুল থেকে ঝড়ে পরছে বেশির ভাগই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। ঠাকুরগাঁও শহরের হাজীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী ইতি আক্তার ইশারা ভাষায় জানান, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাষা বুঝতে সময় লাগে এবং কষ্ট হয়। আমানত উল্লাহ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেনির ছাত্র রিমন হাসান জানান, প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরন থাকলে আমরা বুঝতে পারতাম ভাল। এতে আমরাও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতো ভাল রেজাল্ট করতাম।

সদরের কাশিডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক স্মৃতি বসুনিয়া বলেন, বিদ্যালয়টিতে ওঠার জন্য সিড়ির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তাদের বোঝানোর জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরন নেই। এতে বিদ্যালয় গুলোতে প্রতিবন্ধীরা ভর্তি হলেও পরবর্তীতে ঝরে পরে যায়। প্রতিবন্ধীরা বঞ্চিত হওয়ার পেছনে সচেতনতার অভাব আর অভিভাবদেরই দায়ী করলেন সমাজ সেবা কর্মকর্তা আর তাদের সমাজের বোঝা না ভেবে সুশিক্ষা আর যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসার আহবান শিক্ষাবীদদের।

ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর গোলাম কিবরিয়া বলেন, প্রতিবন্ধীদের সুপ্ত মেধা কাজে লাগাতে হবে। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। নইলে প্রতিবন্ধীরা পরিবার,সমাজ ও দেশে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। ঠাকুরগাঁও সমাজ সেবা অধিদপ্তর উপ-পরিচালক এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিবন্ধীরা সবচে বেশি অবহেলিত হয় পরিবারে। অনেক পরিবার কর্তারা প্রতিবন্ধী শিশুদের লুকিয়ে রাখে। প্রকাশ করতে চায়না।

ঠাকুরগাঁও সমাজ সেবা অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী জেলায় ২৩ হাজার ২৫০জন প্রতিবন্ধী রয়েছে। এরমধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতা ভোগী ৪হাজার জন আর শিক্ষা উপ-বৃত্তি পাচ্ছে ৭শ জন আর প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭টি। ঠাকুরগাঁওয়ের এই ৭টি প্রতিষ্ঠান হলো: শহরের আর্টগ্যালারী মোড়ে ফাররিচিং ইকোনোমিক্যাল এন্ড ইনভায়ারমেন্ট (ফ্রিড), হাজীপাড়া বরুনাগাঁওয়ে অন্বেষা প্রতিবন্ধী রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, ভেলাজানে চামেলী প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা, আরাজী ঝাঁড়গাঁও গ্রামে একতা প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা, ভুল্লী বাজারে হিমালয় এ্যাকশন ফর নিডি পিপলস, সুইড বাংলাদেশ, সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম। তবে এ বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে দু’একটিতে ভাল পরিবেশ দেখা গেলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নেই মানসম্পন্ন শিক্ষক, বসার ব্রেঞ্চ, চেয়ার টেবিল, শিক্ষা উপকরণ। এ কারনে প্রতিষ্ঠান গুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এলেও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছতে পারছেনা। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান গুলোতে বিনা বেতনে পরিশ্রম করছে শিক্ষক কর্মচারিরা। বেতন ভাতা না পাওয়ায় অনেক শিক্ষক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে।

অন্বেষা প্রতিবন্ধী রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রধান মনিরা খাতুন জানান, সরকারি ভাবে আর্থিক সহযোগিতা কম পেলেও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছি দীর্ঘ দিন ধরে। অর্থের অভাবে প্রতিবন্ধীদের আবাসন ব্যবস্থা ও পুনর্বাসন করা যাচ্ছেনা। তিনি আরো বলেন, এ প্রতিষ্ঠান গুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা ভাল ফলাফল করছে কিন্তু উচ্চ শিক্ষার জন্য গিয়ে ঝরে পরে যাচ্ছে। ফাররিচিং ইকোনোমিক্যাল এন্ড ইনভায়ারমেন্ট (ফ্রিড) এর সভাপতি তহমিনা আখতার মেল্লা জানান, ২০১১ সালে ৩৫জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ১৬২জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে সাধারণ লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে। তাদের লেখাপাড়ার পাশাপানি নাচ ও গানও শেখানো হয়। এ কারনে শিক্ষার্থীরা লেখাপাড়ায় মনোযোগী। সরকারি সহযোগিতা পেলে এ প্রতিষ্ঠানটি অনেক বড় হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।