image_215835.vote_ctg_280415_26

দৈনিকবার্তা-চট্টগ্রাম, ২৮ এপ্রিল: ভোটগ্রহণের দিন মাঠে নামেননি মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলমের সমর্থক বিএনপির নেতাকর্মীরা।নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে তাদের কর্মী-সমর্থকদের জোরালো উপস্থিতি দেখা যায়নি।এমনকি অধিকাংশ বুথে এজেন্টদেয়ার মত কর্মীও পায়নি মনজুরকে সমর্থনদানকারী সংগঠন চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন।এর ফলে ভোটের খালি মাঠে ৭১৯ কেন্দ্রের সামনেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিনের সমর্থকদের ঢল নেমেছিল। সেই খালি মাঠেই আ জ ম নাছির আগামী পাঁচ বছরের জন্য নগরপিতার আসনে বসতে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন নগরবাসী।চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নগরীর দক্ষিণ পাহাড়তলি এলাকার অন্তত চারটি ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সরকার সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে সিল মারা হয়েছে। একটি ভোটকেন্দ্রে ফাটানো হয়েছ হাতবোমা।মঙ্গলবার সকালে ভোট শুরুর পর অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়ক সংলগ্ন বিএসআইআর ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র ও অলি আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রদখল করে নেয় ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীর কর্মীরা। সেখানে ছিনিয়ে নেওয়া বেশ কিছু ব্যালট পেপার পড়ে থাকতে দেখা যায় ।এসব ব্যালটে হাতি মার্কায় সিল দেওয়া ছিল। আওয়ামী লীগ সমর্থক আ জ ম নাছির উদ্দিন ওই প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।

বেলা পৌনে ১১টার দিকে দক্ষিণ পাহাড়তলী থানা এলাকার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ফতেয়াবাদ সিটি করপোরেশন বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র এবং সোয়া ১১টার দিকে পাহাড়তলীর ফতেয়াবাদ কলেজ কেন্দ্রেও একই পরিস্থিতি দেখা যায়।১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর লোকজনও এ সময় কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিএসআইআর ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ের কেন্দ্রের বাইরে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে বলে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. আবুল হাশেম জানান।এ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের ছয়টি বুথের মধ্যে ১ নম্বর ও ২ নম্বর বুথ থেকে বেশকিছু ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলমের কোনো এজেন্ট সেখানে ছিলেন না।১ নম্বর বুথের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মো. সুলতান মাহমুদ বলেন, এ বুথ থেকে দুর্বৃত্তরা স্বাক্ষর-সিল ছাড়া ৫৩টি ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে যায়।তবে ২ নম্বর বুথ থেকে ৪২টি ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেওয়ার পর ৪/৫টি ব্যালটে হাতি প্রতীকে সিল মেরে ফেরত দিয়ে গেছে’ বলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার মমতাজ হোসেন জানান।এই অবস্থার মধ্যে সকাল ১০টার দিকে ম্যাজিস্ট্রেট নূরে আলম ভুইয়া কেন্দ্র পরিদর্শনে এসে ঘুরে দেখে সাংবাদিকদের বলেন, প্রিজাইডিং অফিসার কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার ‘অভিযোগ করেননি’।পাঁচ মিনিট পর তিনি কেন্দ্র ছেড়ে যান।অন্যদিকে অলি আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ফজলুল কাদের জানান,তার কেন্দ্রে দুই হাজার ৫১০ ভোটের মধ্যে দেড় হাজার ভোট সকাল ১০টার মধ্যে বাক্সে পড়ে। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে ওই কেন্দ্র ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে।কেন্দ্রে প্রবেশের সময় প্রতিবেদক হাতি প্রতীকের একটি মিছিল ওই এলাকা থেকে বের হতে দেখেন।

কেন্দ্রসংলগ্ন শহীদ আজমল হোসেন লেনের বাসিন্দা বিএনপি সমর্থক এসএম ইসমাইল বাবু অভিযোগ বলেন, আমরা নিজেদের ভোট দিতে পারিনি। সকাল থেকে সশস্ত্র লোকজন কেন্দ্র দখল করে হাতি প্রতীকের পক্ষে ভোট উৎসব করেছে।এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা যা দেখতে পাচ্ছেন আমরাও তা দেখতে পাচ্ছি। এখানে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।সকাল সাড়ে ১০টার সময় কেন কেন্দ্রে ভোটার নেই- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে যারা আছেন তারা ভাল বলতে পারবেন।বেলা পৌনে ১১টার দিকে ফতেয়াবাদ সিটি করপোরেশন বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র দখলে নিয়ে ছয়টি বুথে হাতি প্রতীকে সিল মারতে দেখা গেছে বলে অভিযোগ করেন কয়েকজন।সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত হওয়ার পর কেন্দ্রে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা তৎপর হয়ে উঠেন। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আবু সাঈদ ‘জীবনের নিরাপত্তা বজায় রেখে ভোট গ্রহণ করতে সহকর্মীদের অনুরাধ জানান।ওই কেন্দ্রের ৫ নম্বর বুথের ৫০১ থেকে ৫৩২ পর্যন্ত ব্যালট পেপারগুলোতে ভোটারের টিপসই ও প্রিসাইডিং অফিসারের সই ছাড়াই হাতি প্রতীকে সিল মারা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।বেলা সোয়া ১১টার দিকে দক্ষিণ পাহাড়তলীর ফতেয়াবাদ ডিগ্রি কলেজের ভোটকেন্দ্র দখল করে নেয় হাতি প্রতীকের সমর্থকেরা। এ সময় সাংবাদিকরা কে›েন্দ্র প্রবেশ করতে চাইলে তাদের উপর চড়াও হয় তারা।

কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের লাইন দেখা গেলেও তারা কেউ ভোট দিতে ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও এসময় নিস্ক্রিয় দেখা যায়।নগর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ানের দাবি, গত তিনদিন ধরে নেতাকর্মীদের বাসায় অব্যাহত পুলিশের অভিযান, ধরপাকড়, হয়রানির কারণে তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে সাহস পায়নি। এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি।আর মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ড.হাছান মাহমুদ মন্তব্য করেন, এম মনজুর আলম আদৌ বিএনপি করেন কিনা সেটা নিয়ে ওই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সন্দেহ আছে।সেজন্য নেতাকর্মীরা মনজুরের পক্ষে মাঠে নামেননি। এমনকি তারা এজেন্টও দিতে পারেননি।আওয়ামী লীগ সমর্থিত চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন নির্বাচন করেছেন হাতি প্রতীকে আর এম মনজুর আলমের প্রতীক ছিল কমলালেবু।

সকালে ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে সাতটি বুথের মধ্যে মাত্র তিনটিতে মনজুরের এজেন্ট আছে। এর মধ্যে একজন এজেন্ট আবার বুথে ঢুকেছেন গলায় হাতি প্রতীকের কার্ড ঝুলিয়ে। মোহাম্মদ আব্দুল করিম নামের ওই এজেন্ট প্রকাশ্যেই জানালেন, নগরীর পুরাতন গির্জায় তার দোকান আছে। তিনি হাতি প্রতীকের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। সকালে তাকে হাতি প্রতীকের এজেন্ট হওয়ার জন্য কেন্দ্রে আনা হয়েছিল। তবে এজেন্ট অতিরিক্ত হয়ে যাওয়ায় তাকে কমলালেবুর পক্ষে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।আব্দুল করিম কমলালেবুর এজেন্ট হিসেবে বুথে বসার পর প্রতিবাদ করেন ২০ দলের সমর্থিত দু’জন কাউন্সিলর প্রার্থী শহীদ হোসেন আর বেগম লুৎফুন্নেছার এজেন্টরা।মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের সামনে সকাল ৭টা থেকেই গলায় হাতি প্রতীকের কার্ড ঝুলিয়ে বিপুল সংখ্যক তরুণ-যুবকের উপস্থিতি দেখা গেছে। সেখানে কমলালেবু প্রতীকের সমর্থক কাউকেই দেখা যায়নি।এর মধ্যেই আবার সকাল ১১টার দিকে স্কুলের গেইটে কয়েকজন যুবককে শিবির, শিবির বলে হাতি প্রতীকের সমর্থকদের ধাওয়া দিতে দেখা গেছে।

একই ওয়ার্ডের কদমমোবারক এম ওয়াই উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল ৭টা থেকেই প্রায় দু‘শ কিশোর, তরুণ বয়সী ছেলে কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেন্দ্রের অদূরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে সামিয়ানা টানিয়ে বসে আছে আরও শ’খানেক। সবার গলায় হাতি প্রতীকের প্ল্যাকার্ড ঝোলানো। সেখানেও দেখা মেলেনি কমলালেবু প্রতীকের কারও।সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর ৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওয়ার্ডের শহীদ এন এম জে চৌধুরী কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, হাতি প্রতীকের প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে কয়েক’শ তরুণ-যুবক সেখানে অবস্থান নিয়েছে।বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত ওই কেন্দ্রের সামনে কমলালেবুর প্ল্যাকার্ড ঝোলানো অবস্থায় হাতেগোণা তিনজনকে দেখা গেছে।ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আহসান হোসেন বলেন, আমার কেন্দ্রের সাতটা বুথে কমলালেবুর এজেন্ট আছে। বাইরে কমলালেবুর কেউ নাই বলে শুনেছি। সেখানে হাতি মার্কার মানুষ বেশি।১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে চারটি পৃথক কেন্দ্রে ভোটারের দীর্ঘ সারি। তাদের ঘিরে আছে হাতি প্রতীকে প্ল্যাকার্ড ঝোলানো শত শত বিভিন্ন বয়সী লোকজন। ভোটাররা কেন্দ্রে যাবার সময় তারা সুরে সুরে বলছে, হাতি-ঘুড়ি-গ্লাস। ঘুড়ি এবং গ্লাস আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সির প্রার্থীর প্রতীক।

সেখানে কয়েকজন ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু ভোট দেবার জন্য তারা ভেতরে যেতে পারছেন না। তাদের ভেতরে যেতে দেয়া হচ্ছেনা। আবার কেউ কেউ ভেতরে ঢুকলেও ব্যালট দেয়া হচ্ছেনা।তারা বলেন, এই কেন্দ্রে কমলালেবুর কেউ নেই। তারা যদি থাকত তাহলে চ্যালেঞ্জ করতে পারত।

২৯ নম্বর পশ্চিম মাদারবাড়ি ওয়ার্ডের শুভপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সেন্ট্রাল পাবলিক কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, ওই কেন্দ্রের ৬টি বুথ ঘিরে আছেন হাতি মার্কার প্ল্যাকার্ড ঝোলানো লোকজন। সেখানে সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে তাদের বাধা দেন হাতি প্রতীকের প্ল্যাকার্ড ঝোলানো কয়েকজন যুবক।মো.মোস্তফা নামে একজন ভোটার বলেন, আমি ভোট দিতে গিয়েছিলাম। আমাকে বলেছে আপনার ভোট হয়ে গেছে। এটা কেমন দেশ। আমি আমার ভোটটা দিতে পারলাম না।

নগরীর চকবাজার এলাকায় জামান হোটেলের সামনে কয়েকজন ভোটার দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলেন। তারা বলেন, আজকের এই অবস্থার জন্য বিএনপি দায়ী। এম মনজুর আলমের জন্য বিএনপির কর্মীরা কেউ মাঠে নামেননি বলেই সরকার এত দাপট দেখাতে পেরেছে।নগরীর ১৬ নম্বর জামালখান ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও ২০ দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী তৌহিদুস সালাম নিশাদ জানান, তিনি বিএনপির কর্মীদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলেন। তিনটি কেন্দ্রে তাকে ঢুকতেই দেয়া হয়নি। তার কর্মীদেরও ধাওয়া দেয়া হয়েছে।তিনি বলেন, ভোট ডাকাতি করা হয়েছে। এটা প্রহসনের নির্বাচন। আমি এই নির্বাচন বর্জন করলাম।

নগরীর পাঠানটুলি ওয়ার্ডে বারিক মিঞা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র, আগ্রাবাদ টিএন্ডটি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়, পশ্চিম মাদারবাড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের পতেঙ্গা বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঘুরে কমলালেবু প্রতীকের কোন সমর্থককে দেখা যায়নি।কর্মী-সমর্থকবিহীন এম মনজুর আলম বেলা ১২টার দিকে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে রাজনীতি বর্জনেরও ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার এই উপদেষ্টা।