khaleda-zia1

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৮ জুন: বিএনপিচেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা নাইকো দুর্নীতি মামলার কার্যক্রম চলবে বিচারিক আদালতে।মামলাটি বাতিলে খালেদার রিট আবেদন ও এ সংক্রান্ত রুল খারিজ এবং বিচারিক কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছেন হাইকোর্ট।আগামী দুই মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে খালেদাকে। তবে তার জামিনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে নিম্ন আদালতকে বলেছেন উচ্চ আদালত।জরুরি অবস্থার সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের করা এই মামলা চ্যালেঞ্জ করে খালেদার রিট আবেদনে সাত বছর আগে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।সে সময় জারি করা রুল খারিজ করেই বিচারপতি মো.নূরুজ্জামান ও বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় দেয়।এর ফলে খালেদার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলার বিচার চালাতে আর কোনো বাধা থাকল না বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।খালেদার আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন,তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপলি করবেন।দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ফৌজদারি মামলায় রিট আবেদন বিচার্য হতে পারে না। এ কারণে হাই কোর্ট এ রায় দিয়েছে। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় নাইকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। পরের বছর ৫ মে খালেদাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।এতে অভিযোগ করা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দেওয়ার’ মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন।খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে গেলে ২০০৮ সালের ৯ জুলাই দুর্নীতির এই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে হাই কোর্ট, সেই সঙ্গে দেওয়া হয় রুল।

প্রায় সাত বছর পর চলতি বছর শুরুতে রুল নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাটি সচল করার উদ্যোগ নেয় দুদক। খালেদার আবেদনে রুলের ওপর শুনানি শুরু হয় ১৯ এপ্রিল।নাইকোকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করার অভিযোগে খালেদার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও একই দিনে আরেকটি মামলা করেছিল দুদক।আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ২০১০ সালের মার্চে হাই কোর্ট ওই মামলা বাতিল করে দেয়। রায়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই মামলাটি করা হয়েছিল।বিচারিক আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে বেআইনি কাজ করেছে উল্লেখ করে উচ্চ আদালত ওই রায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের বিধিমালাও সংশোধন করতে বলেছিল।এ প্রসঙ্গ টেনে খালেদার মামলার আইনজীবী রাগীব রউফ হাই কোর্টের শুনানিতে বলেছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মামলাটি যে কারণে বাতিল করা হয়েছে, একই কারণে বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলাটিও চলতে পারে না।আর তখনকার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চুক্তি অনুমোদন করায় খালেদার বিরুদ্ধে এভাবে ফৌজদারি মামলাও চলতে পারে না বলে শুনানিতে দাবি করেছিলেন এই আইনজীবী।

বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, রিট আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়।রুল খারিজ করা হল।এই আদেশ বিচারিক আদালতে পৌঁছানোর দুই মাসের মধ্যে আসামিকে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হল।বিচারক রায়ে বলেন, নিম্ন আদালত জামিন চাইলে আদালত জামিন বিবেচনা করবেন, কেননা আবেদনকারী (খালেদা) জামিনের অপব্যবহার করেননি।রায়ের পর মাহবুব উদ্দিন খোকন আপিল করবেন জানিয়ে বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এ মামলায় নেই।তাহলে খালেদার আবেদন খারিজ হল কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালত বলেছে, দুদক এ মামলা দায়েরের যে অনুমোদন দিয়েছিল, তা সঠিক ছিল। এ কারণে রুল খারিজ করা হয়েছে।তিনি জানান, একজন কমিশনারের সই থাকলেই দুদকের মামলার অনুমোদন গ্রহণযোগ্য হবে বলে এর আগে আপিল বিভাগের এক রায়ে বলা হয়েছিল।খালেদা জিয়ার মামলায় ওই অনুমোদন হাই কোর্টে দেখানো হলেও শেখ হাসিনার মামলায় তা করা হয়নি।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান রায়ের পর বলেন, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা দুই মামলার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। তাছাড়া খালেদার মামলায় অপরাধ সংগঠনের যথেষ্ট প্রাথমিক উপাদানও রয়েছে।আদালত রুল খারিজ করায় এ মামলা চলতে আর আইনি কোনো বাধা থাকল না বলে জানান তিনি।খালেদা জিয়া ছাড়া এ মামলার বাকি আসামিরা হলেন- চার দলীয় জোট সরকারের আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, তখনকার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।নাইকো দুর্নীতি মামলার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা বাতিলের আবেদন জানিয়ে রিট করেছিলেন খালেদা জিয়া। এ রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে নাইকো দুর্নীতির মামলার কার্যক্রম স্থগিত ও রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।এর আগে গত ২৮ মে রুলের শুনানি শেষ হলে যেকোনো দিন রায় দেওয়া হবে বলে জানিয়ে অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন হাইকোর্ট।

খালেদা জিয়ার পক্ষে রুলের শুনানি ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, রাগীব রউফ চৌধুরী ও এ কে এম এহসানুর রহমান। । দুদকের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন মো. খুরশিদ আলম খান।নাইকো ছাড়াও গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা বাতিলেও খালেদার রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে রুল জারি ও মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছিলেন হাইকোর্ট। গত ১৯ এপ্রিল মামলাগুলোর রুল শুনানি পেছাতে খালেদার আইনজীবীদের চারটি সময়ের আবেদন খারিজ করে দিলে গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা দিয়ে রুল শুনানি শুরু হয়।গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার রুল শুনানি বুধবার শেষ হওয়ায় রায় যেকোনো দিন দেওয়া হবে বলে জানিয়ে অপেক্ষমান (সিএভি)রেখেছেন বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি আব্দুর রবের হাইকোর্ট বেঞ্চ।অন্যদিকে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা রুল শুনানি চলছে বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চে। গত ৯ এপ্রিল এ মামলার কার্যক্রমের স্থগিতাদেশ আরও ছয় মাসের জন্য বৃদ্ধি করেন একই আদালত।

মামলাগুলোর মধ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলার রুলের শুনানি আগেও একবার শেষ হয়েছিল। এর রায়ের দিন গত ৫ এপ্রিল ধার্য ছিল বিচারপতি মো. মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জেবিএম হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চে।এর মধ্যে আসামিপক্ষকে শুনানি শেষ করতে বলা হয়েছিল। অন্যদিকে নাইকো দুর্নীতি মামলা ও গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার রুলের শুনানি প্রথম দফায় শুরুর অপেক্ষায় ছিল।এর আগেই এসব মামলার বেঞ্চ পরিবর্তনে গত ২ এপ্রিল প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তার আইনজীবীদের এ সংক্রান্ত চারটি আবেদন গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা।গত ৫ এপ্রিল পূর্ববর্তী স্ব স্ব হাইকোর্ট বেঞ্চ মামলাগুলোর বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দেন। পরে গত ৭ এপ্রিল মামলা তিনটির রুল নিষ্পত্তির জন্য নতুন বেঞ্চের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা)।খালেদা জিয়াকে প্রধান আসামি করে করা এসব মামলা হাইকোর্টের আদেশে কয়েক বছর ধরে স্থগিত ছিল। সম্প্রতি মামলাগুলো সচলের উদ্যোগ নিয়ে রুল শুনানির দিন ধার্যের আবেদন জানায় দুদক।এসব মামলায় স্থায়ী জামিনে রয়েছেন খালেদা জিয়া।কানাডার কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিসাধন ও দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় নাইকো দুর্নীতি মামলাটি করেন।২০০৮ সালের ৫ মে এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক এস এম সাহেদুর রহমান।