imported wheat
দৈনিকবার্তা-দুবাই, ০৭ জুলাই ২০১৫: ব্রাজিল থেকে আমদানি করা যে ‘পচা’ গম নিয়ে এতো হইচই, খাদ্য অধিদপ্তর ২০১৪ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ৪টি প্যাকেজে প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে তা ব্রাজিল থেকে আমদানি করেছে। তবে গত ৭ জানুয়ারি বার্তা সংস্থা রয়টার্স খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছিল, এ গম ইউক্রেন থেকে সরবরাহ করা হবে। কিন্তু পরে তা ব্রাজিল থেকে সরবরাহ করার কার গমের মান পরিবর্তন হয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে খাদ্য অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে গম ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কখনও এভাবে পচা গম আমদানির ঘটনা ঘটেনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যক্তিগত লাভের আশায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের খাদ্য বাজেটের ৯ লাখ টন কিনতে  নিয়মানুযায়ী আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান না করে তথাকথিত ‘জি-টু-জি’ পদ্ধতিতে বেশির ভাগ গম কেনার পরিকল্পনা করেন। ইউক্রেন থেকে ৫ লাখ টন গম আমদানির সমঝোতা করেন। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে উচ্চমূল্যে আড়াই লাখ টন গম আমদানির জন্য চুক্তিও হয়। রাশিয়া থেকেও ‘জি-টু-জি’ পদ্ধতিতে ২ লাখ টন গম আমদানির জন্য খাদ্যমন্ত্রী মধ্য অক্টোবরে মস্কো সফর করেন। দীঘদিন যাবৎ দরপত্রের মাধ্যমে খাদ্য অধিদপ্তরকে গম সরবরাহকারীরা এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ব্যবসা ঠিক রাখতে এরা ‘জি-টু-জি’ পদ্ধতিতে গম কেনার পরিকল্পনা থেকে সরিয়ে আনতে মন্ত্রীকে ম্যানেজ করেন। এর পর মন্ত্রী দরপত্রের মাধ্যমে গম কিনতে শুরু করেন। এ জন্য তাদের যে ব্যয় হয়েছে তা ওঠানোর জন্যই ব্রাজিল থেকে নিম্নমানের গম আমদানি করা হয়। গম নিয়ে এমন হৈ চৈ সৃষ্টি হয়ে মন্ত্রীত্ব হারানোর ঝুঁকি সৃষ্টি হবে তা খাদ্যমন্ত্রী কল্পনাও করেন নি।

খাদ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার সংসদে স্বীকার করেছেন, ব্রাজিলের গম আসলে দেখতে খারাপ, তবে মন্ত্রীর দাবি, এর গুনগত মান ঠিক আছে। মন্ত্রীর আরো দাবি, খাদ্য অধিদপ্তর গম আমদানি করে, এখানে মন্ত্রণালয়ের কিছুই করার নেই। এ সংক্রান্ত বিল মন্ত্রণালয়ে আসেনা। প্রি-শিপমেন্ট সনদ পাওয়ার পর গম এখানে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রীর সংসদে দেওয়া এসব বক্তব্যের বেশির ভাগই অসত্য। মন্ত্রীত্ব রক্ষার জন্য তিনি এখন পঁচা গমের বিষয়ে বানোয়াট কথা বলছেন বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। খাদ্য অধিদপ্তর ‘সফট রেড উইন্টার’ (এসআরডবব্লিউ) জাতের গম আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। চুক্তিও করেছে এসআরডব্লিউ শ্রেণির গমের জন্য। এ গমের রং হাল্কা হলুদ। আর গম চলতি ফসলের (কারেন্ট ক্রপ) হলে তার রং পরিবর্তন বা রং খারাপ হওয়ার কোন কারন নেই।

প্রি-শিপমেন্ট সনদ পাওয়ার পর গম এখানে এসেছে বলে সংসদে মন্ত্রী যে দাবি করেছেন তাও বিভ্রান্তিকর। খাদ্য অধিদপ্তর রহস্যজনকভাবে দরপত্রে গম জাহাজীকরনের আগে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (প্রাক-জাহাজীকরন পরিদর্শন) এজেন্সির মাধ্যমে গমের মান ও পরিমাণ যাচাই করার শর্তারোপ করে না। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে সরকারের এমন সব সংস্থাই প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন সনদ সঠিক পেলেই কেবল পণ্য জাহাজীকরণের অনুমতি দেয়।  আবার পণ্য বন্দরে পৌঁছার পর ‘পোষ্ট-ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন’ (অবতরণ-পরবর্তী পরিদর্শন) করে থাকে। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তর বন্দরে জাহাজ আসার পর সংগৃহীত গম নিজস্ব ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা করে স্পেসিফিকেশন (বিনির্দেশ) অনুযায়ী পেলে খালাসের সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রাজিলের ‘পচা’ গম, মন্ত্রীর ভাষায় ‘কালো’ গমের ক্ষেত্রে জাহাজ থেকে সংগৃহীত নমুনা স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী না পাওয়ায় তা খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা খালাসে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু মন্ত্রী চাপ প্রয়োগ করে ঐ ‘কালো’ গম খালাসেই বাধ্য করেন। জাহাজীকরণের আগে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন করা হলে ‘পচা’ গম জাহাজীকরণের সুযোগই ছিলনা।

খাদ্য অধিদপ্তর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করলেও গম আমদানিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাই প্রধান। মন্ত্রণালয় দরপত্র আহ্বানের অনুমোদন দেয়। প্রাপ্ত দরপত্রের চূড়ান্ত অনুমোদন জন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রক্রিয়াকরণ করে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হয়। আর গত বছরের জানুয়ারিতে অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম আইন প্রতিমন্ত্রী থেকে পদোন্নতি পেয়ে খাদ্যমন্ত্রী হবার পর গম কেনার ব্যাপারটি নিজেই নিয়ন্ত্রণে নেন।

প্রতি বছরের বাজেটেই খাদ্য অধিদপ্তরের জন্য গম আমদানি বাবদ অর্থ বরাদ্দ থাকে। অর্থ বছরের শুরুতে জুলাইয়ে খাদ্য অধিদপ্তর গম কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চায়। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ৯ লাখ মেট্রিক টন গম কেনার বাজেট বরাদ্দ সত্বেও ২০১৪ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের অনুমোদন চাওয়া হয়। কিন্তু খাদ্যমন্ত্রী দরপত্র ছাড়াই ইউক্রেন থেকে উচ্চ দরে ৫ লাখ মেট্রিক টন (প্রথম পর্যায়ে আড়াই লাখ টন) গম কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের অনুমোদন দেননি। উচ্চদরে ১১ নভেম্বর ইউক্রেন থেকে গম কেনার অনুমোদন পাবার ২ দিন পর ১৩ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে আন্তর্জাতিক দরপত্রের প্রথম প্যাকেজটি আহ্বান করা হয়।রতিটি ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম কেনার জন্য আহুত দরপত্রের প্রথম ৪টি প্যাকেজের ২ লাখ মেট্রিক টন গমই ব্রাজিল থেকে আনা হয়। ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর আহুত প্যাকেজ-১ এ ৫০ হাজার মেট্রিক টন কেনার দরপত্রে ১০টি সিডিউল বিক্রি হলেও ৪টি দরপত্র পাওয়া যায়। এতে নেদারল্যান্ডসের গ্লেনকোর গ্রেইন বিভি’র পক্ষে স্থানীয় এজেন্ট ইমপ্রেক্স কনসালট্যান্টস (বিডি) প্রতি মেট্রিক টন গম ২৭০ ডলার দরে বিক্রির প্রস্তাব করে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। দরপত্র দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ওলাম ইন্টারন্যাশনালের দরের চেয়ে এ দর ৭.৯৫ ডলার কম ছিল। এছাড়া গ্লেনকোরের গমের দর এর আগে ইউক্রেন থেকে ২৯৭.৫০ ডলারে কেনা গমের চেয়ে ২৯.৫০ ডলার কম।

গত বছরের ২৫ নভেম্বর ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম ক্রয়ের প্যাকেজ-২ দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে ৬টি সিডিউল বিক্রি হলেও ৫টি দরপত্র পাওয়া যায়। প্রথম প্যাকেজের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ওলাম কর্পোরেশন ২৬৮.৪৭ ডলার দর প্রস্তাব করে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। প্রথম দরপত্রের সর্বনিম্ন দরদাতা গ্লেনকোর ২৮৩ ডলার দর দিয়ে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। ৫০ হাজার মেট্রিক টনের প্যাকেজ-৩ এর দরপত্রে ৫টি শিডিউল বিক্রি হলেও মাত্র ২টি দরপত্র পাওয়া যায়। এরা পূর্ববর্তী ২টি প্যাকেজে পর্যায়ক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্বর্বনিম্ন দরদাতা গ্লেনকোর এবং ওলাম। এ প্যাকেজে সর্বনিম্ন দরদাতা গ্লেনকোরের দর ২৮০.৮৭ ডলার। আর ওলামের দর ২৯১.৯৯ ডলার।

৫০ হাজার মেট্রিক টনের প্যাকেজ-৪ এর দরপত্রে ৫টি সিডিউল বিক্রি হলেও এবারও মাত্র ২ দরদাতা গ্লেনকোর এবং ওলাম। সর্বনিম্ন দরদাতা গ্লেনকোর এর দর ২৭৯.৭৫ ডলার। অপর দরদাতা ওলামের দর ৩০৯ ডলার। বিগত কয়েক বছর যাবত গ্লেনকোর এবং ওলাম খাদ্য অধিদপ্তরকে অনেকটা একচেটিয়াভাবে গম সরবরাহ করে আসছে। কিন্তু অতীতে এভাবে পঁচা গম সরবরাহের ঘটনা ঘটেনি। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত ঘুষের দাবি মেটাতে গিয়েই গ্লেনকোর ও ওলাম চুক্তির অনুযায়ী ‘সফট রেড উইন্টার’ (এসআরডব্লিউ)  এর পরিবর্তে নিম্মাননের (পঁচা) গম সরবরাহ করেছে। বন্দরে পরীক্ষায় বিনির্দেশ বহির্ভুত নিম্নমানের গমের বিষয়টি জানাজানি হয়। কিন্তু মন্ত্রী ও তদানীন্তন খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জড়িত থাকায় কর্মকর্তাদের আপত্তি ধামাচাপা দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে এ গম গ্রহণে অধিদপ্তরকে বাধ্য করা হয় বলে জানা গেছে।