quran-14

দৈনিকবার্তা-চট্টগ্রাম, ২৫ জুলাই ২০১৫: ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পাওয়া গেছে পৃথিবীর প্রাচীনতম কুরআন শরীফের পান্ডুলিপির একাংশ। পান্ডুলিপির চারটি পৃষ্ঠার মধ্যে প্রথম দুই পৃষ্ঠায় কুরআন শরীফের ১৯ নম্বর সূরা মারইয়ামের ৯১-৯৮ নম্বর আয়াত ও ২০ নম্বর সূরা ত্বা-হার ১-৪০ নম্বর আয়াত। অন্য দুই পৃষ্ঠায় রয়েছে ১৮ নম্বর সূরা কাহাফের ১৭ থেকে ৩১ নম্বর আয়াত।

২০১১ সালে সন্ধান পাওয়া পান্ডুলিপির পাতা কয়েকটি রেডিও কার্বন প্রযুক্তির মাধ্যমে পরীক্ষা করে এ বছর বলা হচ্ছে এটি কমপক্ষে ১৩৭০ বছর আগে ৬৪৫ সালে লেখা হয়েছে। এই হিসাবে পান্ডুলিপিটি নবীজীর (সা.) ওফাতের ১৩ বছরের ও তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের (রা.) খেলাফতের দ্বিতীয় বছরের মধ্যে লেখা হয়েছে।

বৃটিশ গবেষকরা কুরআনের এই প্রাচীনতম পান্ডুলিপির হদিশ পেয়ে দারুণ উচ্ছসিত। তারা বলছেন, যেই ব্যক্তি এটি লিখেছেন তার সাথে নবীজীর (সা.) সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল। সহজ কথায় একজন সাহাবী (রা.) পান্ডুলিপিটি লিখেছেন। কুরআনের প্রাচীনতম পান্ডুলিপিটি নিজেদের কাছে থাকায় এবং এটি দেখতে বিশ্বের মুসলমানরা বেশ আগ্রহী হবেন ভেবে বৃটিশরা বেশ খুশি। কোনো এক সাহাবীর (রা.) হাতে লেখা কুরআনের পান্ডুলিপির হদিশ জানতে পেরে সারা বিশ্বের মসুলমানদের মধ্যেও বেশ খুশি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মক্কা বা মদীনায় লিখিত কুরআনের পান্ডুলিপি ব্রিটেনে যাওয়া নিয়ে এরই মধ্যে বহু মুসলমানের মধ্যেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। জনপ্রিয় আমেরিকান মুসলিম পন্ডিত আবু আম্মার ইয়াসির কাজী জানিয়েছেন তিনিও কুরআনের প্রাচীনতম পান্ডুলিপির ব্রিটেনে উদ্ধারের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হয়েছেন।

ইয়াসির কাজী বলছেন, অনেক মুসলমানই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন কিভাবে প্রাচীন আমলের বহু ইসলামী দলিল-পান্ডুলিপি অমুসলিম দেশ ও লাইব্রেরিতে গেল। জবাবে আমি বলেছি, সহজ কারণ হল ঔপনিবেশিকতা ও পয়সার জোর। কিছু পান্ডুলিপি স্রেফ দখল করা হয়েছে, তবে ঐতিহাসিক মূল্যের কথা বিবেচনা করে ইউরোপীয় পর্যটকরা বেশির ভাগ পান্ডুলিপিই ব্যক্তিগত মালিকদের কাছ থেকে বা কালোবাজার থেকে অর্থের বিনিময়ে খরিদ করেছেন। ইয়াসির কাজীর কথার সূত্র ধরে কুরআনের প্রাচীনতম পান্ডুলিপি খুঁজে পাওয়ার তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেছে, মুসলিশ বিশ্বে পশ্চিমা শক্তিগুলোর দখলদারি, উপনিবেশ স্থাপন ও প্রত্নসম্পদ লুণ্ঠনের ঐতিহাসিক কালো অধ্যায় সম্পর্কে।

যেভাবে বৃটেনে গেল প্রাচীনতম কুরআন

১৭৫৭ সালে সুবে বাংলাকে পরাধীন করার মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনাধীন ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হয়। আর ১৮৮৮ সালে মিশর দখল করা হয়। মুসলমানদের দুই সাম্রাজ্যের মাঝখানে থাকা উসমানীয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তুরস্কে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ ও আরব জনপদে আরব জাতীয়বাদ তৈরি করে ব্রিটিশরা। বৃটিশদের সাথে সাথে আরব জনপদে উপনিবেশ ও দখলদারিতে লিপ্ত ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, অস্ট্রিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তবে উসমানীয়া সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে আরব বিশ্বকে উপনিবেশে পরিণত করার মূল কুচক্রী ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স। মিশর দখলের ২৬ বছর পর ১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যা ১৯১৮ সালে শেষ হয়। এই যুদ্ধের দ্বিতীয় বছর ১৯১৫ সালে বৃটেনের স্যার মার্ক সাইকস ও ফ্রান্সের ফ্রান্সিস জর্জেস পিকোট উসমানীয়া খেলাফতকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়ার গোপন চুক্তি করে।

‘সাইকস-পিকোট চুক্তি’ অনুযায়ী ব্রিটেন জর্ডান, ইরাক ও কুয়েত এবং ফ্রান্স সিরিয়া, লেবানন ও দক্ষিন তুরস্ক ভাগ করে নেয়ার প্রস্তাব করে। যদিও এ সময় আরবদের সাথে ব্রিটিশরা চুক্তি করেছিল যে তুরস্ক কেন্দ্রিক উসমানীয়া খেলাফত থেকে আরব জাতি স্বাধীনতা পাবে। আরেকটি চুক্তি হয়েছিল ইউরোপে থাকা ইহুদিদের ফিলিস্তিনে থাকার জন্য বসতি নির্মাণের সুযোগ দেবে ব্রিটিশরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দেখা গেল আরবদের সাথে করা চুক্তি না মেনে নিজেদের মধ্যে আরব বিশ্বকে ভাগ করে নেয়া আর ইহুদিদের ফিলিস্তিনে পুনর্বাসনের চুক্তি ব্রিটেন-ফ্রান্স ঠিকই মেনে নিয়েছে। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত জাতিপুঞ্জ বা লিগ অব নেশনস অনেকটা সাইকস-পিকোট চুক্তির রূপরেখা অনুযায়ী উসমানীয়া খেলাফতকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্টন করে দেয়। আর ব্রিটেন-ফ্রান্স আরব দেশগুলোতে নিজেদের বশংবদ আরব গোত্রপতিদের রাজা-শাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এ সময় ব্রিটেনের ভাগে আসা ইরাককে রাজা হিসেবে বসানো হয় হাশেমী বংশের কুখ্যাত দালাল ফয়সালকে।

ফয়সালের সময়ে ইরাকের প্রাচীন জমানার ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ ও প্রত্নসম্পদসমূহ লুট হতে শুরু করে। পশ্চিমারা যেমন দুহাতে লুট করে, তেমনি পয়সার লোভ দেখিয়ে স্থানীয় লুটেরাদের দিয়েও ঐতিহাসিক সম্পদ হাতাতে থাকে পশ্চিমারা। এ সময় সিরিয়-মিশরসহ আরবের সকল প্রাচীন জনপদই এই লুণ্ঠনের শিকার হয়। আর ফয়সালের সময়কালেই ১৯২০ এর দশকে আরব বিশ্বের তিন হাজারেরও বেশি দলিল-দস্তাবেজ ব্রিটেনের বার্মিংহামে নিয়ে যান ইরাকের কলদিয় খ্রিস্টান পাদ্রী আলফন্স মিনগানা। দলিলগুলো ইরাক থেকে ব্রিটেনে নিয়ে যেতে মিনগানাকে অ্যাডওয়ার্ড ক্যাডবারি অর্থের যোগান দেন। আর এই দলিলগুলোর মধ্যেই প্রাচীনতম কুরআনের পান্ডুলিপির অংশ ছিল বলে দাবি করেছে ব্রিটেন ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি। বিবিসির এ দাবির সূত্র ধরে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, অ্যাডওয়ার্ড ব্রিটেনের বার্মিংহামের বিখ্যাত চকলেট প্রস্তুত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘ক্যাডবারি’র প্রতিষ্ঠাতা জন ক্যাডবারির নাতি। তিনি পারিবারিক চকলেট ব্যবসায় জড়িত থাকলেও কলেজ প্রতিষ্ঠা, মিডিয়া ব্যবসা ও ব্যাবসা বিষয়ক তাত্ত্বিক ছিলেন।

আর পাদ্রী মিনগানা তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন ইরাকের মুসলের জাখো জেলার আসিরিয়ান গ্রাম শারানিসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯১৩ সালে বার্মিংহামের সেলি অক এলাকার খ্রিস্টান ধর্মীয় গোষ্ঠী ‘কোয়্যাক’ এর আমন্ত্রণে দুই বছরের জন্য ব্রিটেনে যান। কিন্তু ১৯১৫ সালে তিনি নরওয়েজিয়ান ছাত্রী এমা সোফি ফ্লোরকে বিয়ে করে ব্রিটেনে থেকে যান এবং ম্যানচেস্টারের জন রিল্যান্ড লাইব্রেরিতে আরবী পান্ডুলিপি বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন, এখানে তিনি ১৯৩২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যেই ১৯২০ এর দশকে জন রিল্যান্ড লাইব্রেরি ও অ্যাডওয়ার্ড ক্যাডবারির কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিন দফা ইরাক সফর করেন পাদ্রী মিনগানা।

১৯২৪ সালের বসন্তে প্রথম সফরে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে যান মিনগানা। সেখান থেকে তিনি জন রিল্যান্ড লাইব্রেরির জন্য ২২টি আরবী ও সিরীয় ভাষায় লিখিত কিছু প্রাচীন পান্ডুলিপি নিয়ে ব্রিটেনে ফেরেন। এ সময় ক্যাডবারির জন্যও কিছু সিরীয় পান্ডুলিপি আনেন তিনি। পরের বছর শরৎকালে অ্যাডওয়ার্ড ক্যাডবারির একক অর্থায়নে সিরিয়া, ইরাক ও দক্ষিণ কুর্দিস্তান সফরে গিয়ে বেশ কিছু সিরীয় পান্ডুলিপির সঙ্গে কিছু আরবী পান্ডুলিপিও সংগ্রহ করে ব্রিটেনে ফেরেন মিনগানা। সর্বশেষ ১৯২৯ সালে সিনাই উপত্যকা ও মিশরের নীল নদের দুই তীরবর্তী এলাকা সফর করে বেশ কিছু আরবী পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেন, এর মধ্যে কয়েকটি পান্ডুলিপি ছিল মিশরের কপ্টিক এবং গ্রিক ভাষায় লিখিত। ১৯৩২ সালে মিনগানা ব্রিটেনে ফেরার পর প্রথম দু বছর আরব থেকে আনা দলিলের ক্যাটালগ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে ১৯৩৪ সালে তিনি সেলি অক কলেজসমূহের লাইব্রেরির কিউরেটর হিসেবে যোগ দেন। সেলি অক কলেজগুলো ছিল মূলতঃ প্রটেস্টান্ট খৃস্টান সম্প্রদায়ের বিশেষ গোষ্ঠী ‘কোয়েকার’ এর সদস্যদের নিয়ে গঠিত ‘ধর্মীয় বন্ধু সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কলেজের ফেডারেশন। কোয়েকার বন্ধু সমাজের অন্যতম সংগঠক ছিলেন অ্যাডওয়ার্ড ক্যাডবারি। পরবর্তীতে অন্য প্রটেস্টান্টরাও সেলি অকের বিভিন্ন কলেজ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন।

সেলি অক কলেজগুলোতে ধর্মতত্ত্ব ও সমাজকর্ম বিষয়ে পড়ানো হত এবং শিক্ষক প্রশিক্ষন দেয়া হত। এগুলো পরবর্তীতে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ‘ওয়েস্টহিল কলেজ’ ২০০১ সালে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একীভূত হয়ে গেছে। পরবর্তীতে উডব্র“ক কলেজ ও ফারক্রফ্ট কলেজ ছাড়া সব কলেজই বন্ধ হয়ে গেছে। সেলি অক কলেজ ফেডারেশনের লাইব্রেরির কিউরেটরের দায়িত্ব নেয়ার পর আলফন্স মিনগানা মাত্র তিন বছর বেঁচে ছিলেন। তবে শেষ বেলাতেও প্রাচীন পান্ডুলিপি ও দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ করে লাইব্রেরিটি সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন তিনি। এর অংশ হিসেবে মিনগানা ১৯৩৪ সালের মে মাসে এবং ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সুইজারল্যান্ডের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ব্যবসায়ী তরুণ এরিক ভন শেরলিংয়ের কাছ থেকে আরব থেকে আনা বেশ কিছু দলিল দস্তাবেজ কেনেন। এরিক ভন ছিলেন একজন সুইডিশ কূটনীতিকের ছোট ছেলে, তিনি বাবার কর্মস্থল নেদারল্যান্ডের রটারডামে ১৯০৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলের পাঠ চুটিয়ে লেইডেনের প্রাচীন বইয়ের বিক্রেতা জেকব গিন্সবার্গের সাথে কাজ শুরু করে এরিক আরবদেশের প্রাচীন পান্ডুলিপি, আরবী ও ল্যাটিন ভাষার উপর বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে দক্ষতা অজর্ন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ওই সময়ে আরব বিশ্বের প্রত্নসম্পদ, প্রাচীন পান্ডুলিপি ও দলিল-দস্তাবেজ এতই হরিলুট হচ্ছিল যে মাত্র ২১ বছর বয়সেই এরিক ভন ওই সবের একজন আন্তর্জাতিক কারবারিতে পরিণত হন।

ভাষা বিজ্ঞানী অস্ট্রেরিয়ান অ্যাডল্ফ গ্রোম্যানকে প্যাপিরাস গাছের বাকল দিয়ে তৈরি কাগজের উপর লিখিত মিশরের কিছু প্রাচীন পান্ডুলিপি (প্যাপিরি) দেখিয়েছিলেন এরিক ভন। গ্রোম্যান আরব, মিশর ও সেমিটিক তত্ত্ববিদ ছিলেন। তিনি এরিকের সংগ্রহগুলো দেখে এসব কিনতে জার্মানির কিছু লাইব্রেরিকে সুপারিশ করেন। কিন্তু ৩০ এর দশকে জার্মানি থেকে বাইরের কারো কাছে মূল্য পরিশোধ করা সুযোগ ছিল না। ফলে জার্মানির বদলে ব্রিটেনে মিনগানার কাছে ওই প্যাপিরি এবং কুরআনের প্রাচীন পান্ডুলিপির ভগ্নাংশ বিক্রি করে দেন এরিক ভন।

বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে, এরিক ভনের কাছ থেকে ১৯৩৬ সালে আলফন্স মিনগানার কেনা দলিল-দস্তাবেজের মধ্যে চামড়া ও প্যাপিরাসের উপর লিখিত কুরআনের সাতটি প্রথম যুগের পান্ডুলিপি ছিল। প্রসঙ্গত, সেলি অক কলেজ ফেডারেশন লাইব্রেরিটি পরবর্তীতে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্গীভূত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাডওয়ার্ড ক্যাডবারি ও আলফন্স মিনগানার সংগ্রহ নিয়ে ‘‘অ্যাডওয়ার্ড ক্যাডবারি গবেষণা লাইব্রেরি’ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই লাইব্রেরিতে বিশেষ সংগ্রহ হিসেবে মজুদ রয়েছে মিনগানার সংগ্রহগুলো। যা ‘মিনগানা সংগ্রহ’ হিসেবে পরিচিত। মিনগানার সংগ্রহগুলোর উপর ১৯৩৩ সালে ৬০৬টি সিরীয় পান্ডুলিপির ক্যাটালগ, ১৯৩৬ সালে ১২০টি খ্রিস্টান আরবী পান্ডুলিপি ও ১৬টি সিরীয় পান্ডুলিপি এবং ১৯৩৭ সালে মিনগানার মৃত্যুর দুবছর পর ১৫২টি খ্রিস্টান আরবী পান্ডুলিপি ও ৪০ টি সিরীয় পান্ডুলিপির ক্যাটালগ প্রকাশিত হয়।

আলবা ফেদেলি “কুরআনের প্রথম জমানার পান্ডুলিপি, সেসবের হরফ এবং বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সংগ্রহ বিভাগে থাকা আলফন্স মিনগানার দলিল” বিষয়ক পিএইচডি গবেষণা করেন। আলবা প্রায় চার বছর ধরে পরিচালিত গবেষণার উপর লেখা থিসিস পেপার গত ১১ মে বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর জমা দেন। পরে গত ১০ জুলাই তাকে পিএইচডি ডিগ্রী দেয়া হয়। আলবা ফেদেলি গবেষণা করতে গিয়ে ২০১১ সালে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাডওয়ার্ড ক্যাডবারি গবেষণা লাইব্রেরিতে কুরআন শরীফের প্রাচীনতম পান্ডুলিপির সন্ধান পান।

কুরআনের প্রাচীন পান্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা ও প্রাচীনতম পান্ডুলিপিটি খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে ২০১৩ সালেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান আলবা ফেদেলি। তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালে আমার দিকনির্দেশক শিক্ষক ইটালির প্রয়াত অধ্যাপক সার্গিও নোজা নসেদা আমাকে ইহুদি ভাষাবিদ জর্জীয় লেভি ডেইয়া ভিদার ‘১৯৪৭’ শীর্ষক সংগ্রহের প্রদর্শনীর ক্যাটালগে প্রকাশিত পশুর চামাড়ার উপর লেখা কুরআনের কিছু প্রাচীন পান্ডুলিপি দেখান। ক্যাটালগের এই ছবিগুলো দেখিয়েই গিওভানি গালবিয়াতি তরুণ পন্ডিত নসেদাকে কুরআনের পান্ডুলিপি নিয়ে অধ্যয়ন করতে পরামর্শ দেন। ড. আলবা বলেন, নসেদার অধ্যয়নের এই কাহিনী শুনে অনুপ্রাণিত হয়েই কুরআনের পান্ডুলিপি নিয়ে আমার অধ্যয়ন শুরু করি। আর কুরআনের একটার পর একটা পান্ডুলিপির তালাশের সূত্র ধরেই আমি ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালেয়ে এসে পৌঁছাই।

আলবা জানান, তিনি বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডবারি গবেষণা লাইব্রেরির ‘মিনগানা সংগ্রহ’ হিসেবে থাকা কুরআনের প্রাচীনতম পান্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর টেক্সচুয়াল স্কলারশিপ অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক এডিটিং’ (আইটিএসইই) এর ‘অ্যাডওয়ার্ড ক্যাডবারি অধ্যাপক’ ডেডিড পার্কারের তত্ত্বাবধানে ও ব্রিটেনের ‘আর্টস অ্যান্ড হিউমিনিটিজ রিসার্চ কাউন্সিল’ অর্থায়নে গবেষণা শুরু করেন আলবা ফেদেলি। তিনি জানান, বার্মিংহাম বিশ্বিবদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে থাকা কুরআনের প্রাথমিক যুগের চারটি পান্ডুলিপি ছিল তার গবেষণার ক্ষেত্র।পান্ডুলিপিগুলোর মধ্যে প্রথমটি হল ‘মিনগানা ইসলামিক অ্যারাবিক ১৫৭২’, যা পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি নয়টি কাগজে লেখা। এর দুটি অংশ ছিল। যার একাংশের সাথে পিটার্সবুর্গের ‘মার্সেল ১৭’ ও দোহার ইসলামী আর্ট যাদুঘরের ‘এমআইএ ৬৭’ সংগ্রহের মিল রয়েছে।

দ্বিতীয় পান্ডুলিপিটি হল ‘মিনগানা ইসলামিক অ্যারাবিক ১৫৬৩’, যা মূলতঃ পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি ৩৯টি কাগজে লেখা প্রাচীন কুরআনের পান্ডুলিপি। তৃতীয় পান্ডুলিপিটি হল এরিক ভন শেরলিংয়ের কাছ থেকে কেনা প্যাপিরির সাথে থাকা কুরআনের পান্ডুলিপির ক্ষুদ্রাংশ। চতুর্থ পান্ডুলিপিটি নিয়েই এখন সারা দুনিয়া তোলপাড় হচ্ছে। এই পান্ডুলিপিটি ক্যাডবারি গবেষণা লাইব্রেরিতে ‘মিনগানা ক্রিশ্চিয়ান অ্যারাবিক অ্যাডিশনাল ১৫০)’ নামে অতিরিক্ত সংগ্রহ হিসেবে ছিল। ড. আলবা বলেন, ঘঁষামাজা করে মূল লেখার উপর লেখায় পান্ডুলিপিটি বিকৃত (প্যালিম্পসেস্ট) এবং খ্রিস্টান ধর্মের অপরিচিত লিখিত দলিল হিসেবে ভুল ক্যাটালগ করায় পান্ডুলিপিটির হদিশ বহু বছর ধরেই গোপন ছিল। গবেষণা করতে গিয়ে আমি দেখতে পাই যে, এর মূল লেখাগুলো কুরআনের অংশ, যার সাথে হুবহু মিল আছে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে থাকা ‘লুইস-মিনগানা প্যালিম্পসেস্ট’ (ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি ওরিয়েন্টাল ১২৮৭) নামে পরিচিত কুরআনের বিখ্যাত পান্ডুলিপির। আলবা জানান, আলফন্স মিনগানার মৃত্যুর দু বছর পর ১৯৩৯ সালে ভুল ক্যাটালগ করার পর কুরআনের এই প্রাচীনতম পান্ডুলিপিটি ২০১১ সাল পর্যন্ত অযত্ন-অবহেলার শিকার হয়েছে।

এর জন্য মিনগানাকে কিছু দায়ীই মনে করেন আলবা ফেদেলি। তার মতে, এটা খুবই সম্ভব যে প্যালিম্পসেস্টেড হয়ে যাওয়া কুরআনের এই পান্ডুলিপির মূল লেখার সম্পর্কে মিনগানা জানতেন। কারণ ১৯৩৭ সালে অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করে পান্ডুলিপিটির কয়েকটি ছবি তুলে তিনি কিছু পরীক্ষী-নিরীক্ষা চালিয়েছেন বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে আলবা ফেদেলি কুরআনের এই পান্ডুলিপিটি কত প্রাচীন জানতে রেডিওকার্বন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওকার্বন অ্যাক্সেলেরেটর ইউনিট ওই পা-ুলিপি পরীক্ষা করার পর জানায়, পান্ডুলিপিটি ছাগলের বা ভেড়ার চামড়ার ওপর ৫৬৮ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময় লেখা হয়েছিল। এটি কোরআন শরিফের সবচেয়ে পুরোনো পান্ডুলিপি। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সংগ্রহবিষয়ক পরিচালক সুসান ওরাল বলেন, আমরা জানতাম এটি বেশ পুরোনো। তবে গবেষকরা কখনোই আশা করেননি এটি মহানবীর (সা.) জীবিত অবস্থায় লেখা হতে পারে। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্রিষ্ট ও ইসলামতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড টমাসের মতে, খোঁজ পাওয়া পান্ডুলিপির অংশবিশেষ যিনি লিখেছেন, তিনি সম্ভবত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় বেঁচে ছিলেন। হয়তো তিনি মহানবী (সা.)-কে চিনতেন। হয়তো মহানবী (সা.)-এর বাণী তিনি সরাসরি শুনেছেন। টমাস বলেন, ওই পান্ডুলিপি আমাদের ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রকৃত সময়ের কাছাকাছি বছরগুলোতে নিয়ে যায়। ব্রিটিশ লাইব্রেরির পান্ডুলিপি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ইসা ওয়ালি বলেন, সুন্দর ও স্পষ্টভাবে হিজাজি লিপিতে (মক্কা-মদীনাসহ হিজাজ অঞ্চলে এ লিপিতেই আরবী লেখা হত) লেখা ওই দুটি পৃষ্ঠা ইসলামের প্রথম তিন খলিফার সময়ের।

ঔপনিবেশিক দখলদারির সময়ে লুণ্ঠিত হয়ে আরব বিশ্ব থেকে ব্রিটেনে গিয়েছে অজানা এক সাহাবী লিখিত কুরআনের প্রাচীনতম পান্ডুলিপি। তাও আবার প্রায় ৮০ বছর ধরে অযত্নে-অবেহলায় পড়েছিল সংগ্রহশালার অবিন্যস্ত বাড়তি দলিল হিসেবে। এখন প্রশ্ন হল, কুরআনের প্রাচীনতম দলিলটির সন্ধান জানার পর এটি কি ইরাক, সিরিয়া, মিশর বা সৌদি আরবে ফেরত পাঠানো হবে? সম্ভবত উত্তরটি না। কারণ ঔপনিবেশিক দখলদারি, শোষণ ও লুণ্ঠন সম্পর্কে সংবদেনশীল মুসলমানদের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রশ্ন থাকলেও মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের এমন প্রশ্নও যেমন নাই, তেমিন ঐতিহ্যের উপর নিজেদের উত্তরাধিকারের দাবি বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক দরবার করতেও তাদের আগ্রহ নেই। অবশ্য এরই মধ্যে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কুরাআনের প্রাচীন পান্ডুলিপির দখলিসত্ত্ব নিয়ে অবস্থান পষ্ট করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সংগ্রহবিষয়ক পরিচালক সুসান ওরাল বলেন, এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে, পৃথিবীর প্রাচীনতম কুরআনের একটি অংশ আমাদের কাছে আছে। এটি নিয়ে আমরা গর্বিত। আর বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় একথাও জানিয়েছে, আসছে অক্টোবরের ২-২৫ তারিখ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বারবার ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস কুরআনের প্রাচীনতম পান্ডুলিপি উন্মুক্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে।