rain-in-dhaka

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১ আগস্ট: মাঝারি থেকে ভারী যে পরিমাণই বৃষ্টি হোক না কেন, জলজট এবং স্থায়ী–অস্থায়ী জলাবদ্ধতার কবল থেকে রাজধানীবাসীর মুক্তি নেই। শনিবার দিন ভর মাঝারি বৃষ্টিতেই তুলনামূলক উঁচু এলাকাও তলিয়ে গিয়েছিল।জলাবদ্ধতার কারণে সাপ্তাহিক সরকারি ছুটির দিনে রাজধানীতে দিনভর ছিল যানজট, ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে।ঘূর্ণিঝড় কোমেন’ এর প্রভাবে বৃষ্টি হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে।

স্থলভাগে অবস্থান করা এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আরও দু’দিন বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।সাত বিভাগের বিভিন্ন স্থানে হালকা থেকে মাঝারি এবং খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে।আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান শনিবার বিকেলে বাংলানিউজকে বলেন, স্থলভাগে থাকা ঘূর্ণিঝড় কোমেন’র প্রভাবে সারা দেশে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আরও দু-একদিন বৃষ্টি ঝড়ে দুর্বল হয়ে পড়বে কোমেন।

শনিবার আবহাওয়ার সতর্কবাবর্তায় বলা হয়, দেশের মধ্যাঞ্চল ফরিদপুরের নিকট অবস্থানরত স্থল নিম্নচাপটি পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে বর্তমানে খুলনা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও পশ্চিম দিকে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ু চাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করার কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।এজন্য উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছে।এদিকে সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে কক্সবাজারে ২০৮ মিলি মিটার।এছাড়া চট্টগ্রামে ১৪৫ মিলি, কুতুবদিয়ায় ১১২ মিলি, টেকনাফে ৯০ মিলি, রাঙ্গামাটিতে ৭১ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।ঢাকায় শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫১ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। বিকেলে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে নগরীতে। এতে বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছেবিশেষ করে মগবাজার, শান্তিনগর, মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকার রাস্তায় পনি জমে থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। অনেক স্থানের রাস্তা জরাজীর্ণ হয়ে এই দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।সীতাকুন্ড, সিলেট, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

নোয়াখালী ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থানরত স্থল নিম্নচাপটি সামান্য পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিমে সরে গিয়ে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল ফরিদপুরের কাছে অবস্থান করছে। মূলত ফরিদপুর জেলা হয়ে নিম্নচাপটি ঢাকা বিভাগ অতিক্রম করায় রাজধানীসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলায় বৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।

কোমেন থেকে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ধীরে ধীরে আরও কিছুটা পশ্চিম উত্তর-পশ্চিমে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যার প্রভাবে বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ু চাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করবে। এদিকে, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, ভোলা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চলসমূহের নদীবন্দরগুলোকে ‪‎দুই ‬(০২) নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

এছাড়া দেশের অন্যসব নদীবন্দরগুলোকে ‎এক‬ (০১) নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়। কিন্তু সেই স্বাভাবিক বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়ছে নগরবাসী। স্থানে স্থায়ী-অস্থায়ী জলাবদ্ধতা ও জলজটের সৃষ্টি হয়। তা স্বীকারও করলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।ভোর থেকে ছিল গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি । এমন বৃষ্টিতেই মতিঝিল,দিলকুশা, গুলিস্তান, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ, বেইলি রোডের মতো তুলনামূলক উঁচু স্থানেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বাদ ছিল না পুরান ঢাকা, ডেমরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা, বৃহত্তর মিরপুরও।

দুপুর পৌনে ১২টার দিকে মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে থেকে দৈনিক বাংলার মোড় পর্যন্ত পানি জমে থাকতে দেখা যায়। সাধারণ বীমা ভবনের সামনের রাস্তাসহ দিলকুশার বিভিন্ন এলাকা, গুলিস্তান পার্কের পাশের রাস্তা থেকে জয়কালী মন্দির পর্যন্ত পানিতে সয়লাব ছিল। তলিয়ে ছিল পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, শ্যামবাজার, সোয়ারী ঘাট, পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা মুগদাপায়া, বাসাবো, সিপাহীবাগ, গোড়ান, রামপুরা।

প্রগতি সরণি এলাকায় আগের বছরগুলোতে এমন জলাবদ্ধতা দেখা না গেলেও ওই সড়ক ও যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় পানি জমতে দেখা গেছে।টিকাটুলীর কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় এলাকা থেকে আনসার ক্যাম্প এবং পূর্বদিকে সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের সামনে পর্যন্ত পানি জমে ছিল।আনসার ক্যাম্প এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় চার মাস আগে এখানকার রাস্তা খুঁড়ে মোটা পাইপ বসায়। প্রায় দেড় মাস বন্ধ করে রাখা হয়েছিল রাস্তাটি। তারা বলেছিল, বর্ষায় এলাকায় আর জলাবদ্ধতা হবে না।

কিন্তু আধঘণ্টার বৃষ্টিতেই এখানে পানি জমে। তা স্থায়ী হয় সাত-আট ঘণ্টা পর্যন্ত।এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫ নম্বর অঞ্চলের সদ্য বিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল হাসেম বলেন, অন্য এলাকার পানির প্রবাহ আসায় জলাবদ্ধতা হয়েছে।রাজারবাগ শান্তিনগর এলাকায় সকাল সোয়া নয়টার মধ্যে পানি জমে যায়। সেখানে রিকশা উল্টে দুজন আরোহী আহত হন গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে। পীরের গলির বাসিন্দা অমিতাভ জানান, গলির কাছে শান্তিনগর-রাজারবাগ সড়কে গত মঙ্গলবার একটি পটহোল (আরসিসি গর্ত) ভেঙে যায়। পরে সেটি রাস্তার তুলনায় উঁচু করে মেরামত করে ডিএসসিসি। সার্কিট হাউস রোড, শান্তিনগর মোড়, রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইনসের সামনে বিকেল পাঁচটায়ও পানি জমে থাকতে দেখা যায়। নগরের প্রাথমিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার অতিরিক্ত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে।

বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে গতকাল আরামবাগ থেকে ফকিরাপুল, নয়াপল্টন হয়ে কাকরাইল পর্যন্ত যানজট ছিল দিনভর। যানজটে নাকাল ছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কার্যালয় থেকে মগবাজার রেলক্রসিং, টঙ্গী ডাইভারসন রোড, তেজগাঁও হয়ে মহাখালী, রামপুরা সেতু এলাকা, মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট এলাকা, মিরপুর রোড, কলাবাগান, শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, গ্রিন রোড ও ফার্মগেট এলাকা।যানজটের মধ্যে পল্টন মডেল থানার সামনে বিকেল পাঁচটার দিকে কথা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনি এলাকার বাসিন্দা ফয়সল আকবরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, মিরপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে ইফতারের দাওয়াতে যাবেন বলে বিকেল চারটার দিকে আরামবাগ এলাকা থেকে তিনি সপরিবারে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ওঠেন। ফকিরাপুল সিগন্যালে প্রায় ১৫ মিনিট আটকে থাকে অটোরিকশা। এখন পল্টন থানার সামনে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে যানজটের মধ্যে আছেন।বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মতিঝিল মধুমিতা সিনেমা হলের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলেন একদল মানুষ। এঁদের মধ্যে আরামবাগের বাসিন্দা আবদুর রশীদ বলেন, প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়েও কোনো রিকশা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, বেলা ১১টার দিকে বিশেষ প্রয়োজনে বেরিয়েছিলেন। সূর্যের তাপে মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল।

এখন চলছে বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতার সমস্যা।সন্ধ্যা ছয়টার দিকে দেখা গেল আরামবাগ, ফকিরের পুল মোড় ও আশপাশের এলাকার পানি আর পানি। ফকিরের পুল থেকে নয়াপল্টন যাওয়ার পথে তীব্র যানজট। জলাবদ্ধতা ছাড়াও নয়াপল্টনে একটি ভবনে আগুন লাগার কারণে সেখানে যানজট সৃষ্টি হয়েছিল বলে দায়িত্বরত একজন পুলিশ জানান।এ ছাড়া কে এম দাস লেন, অভয় দাস লেন, বৃষ্টিতে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, দিলকুশা, পুরানা পল্টন, কাকরাইল, মৌচাক, মালিবাগ, শেরেবাংলা নগর, রামপুরা, পরীবাগ, মিরপুরের গোলচত্বর থেকে কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, শুক্রাবাদ, পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়।