dhaka-city

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫: গত দুই দিন দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।শুক্রবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাজধানীর অনেক সড়কের পানি নেমে গেলেও বহু রাস্তায় এখনো পানি জমে আছে। যেখানে পানি নেই সেখানে কাদা আর গর্ত। ফলে নগরবাসীর ভোগান্তি কমেনি। বুধবার ভারি বৃষ্টি না হলেও থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে দুপুর পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার যদিও বৃষ্টি হয়নি। জলাবদ্ধতা কমলেও যানজট পিছু ছাড়েনি। এদিকে ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বৃষ্টির কারণে ঢাকার আশপাশের নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় শহরের পানি বের হতে পারছে না। হাতিরঝিল হয়ে নদীতে নিষ্কাশনের পথেও পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। অনেক এলাকায় পানি নেমে যাওয়ার পর রাস্তার কাঁদার কারণে হেঁটে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। টানা বৃষ্টির কারণে রাস্তায় যে পরিমাণ ভাঙ্গা ছিল তা আরো বেড়ে গেছে। বেশিরভাগ রাস্তারই পিচ উঠে গিয়ে ইটবালি বের হয়ে গেছে। তবে গত মঙ্গলবারের বৃষ্টির কারণে যে ভোগান্তি হয়েছে সে কথা বিবেচনায় রেখে গতকাল রাজধানীর বহু স্কুল বন্ধ ছিল। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কিছুটা কম ছিল।

এদিকে, একক নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অভাবে রাজধানী ঢাকার সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমে নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, ডেসা, রাজউক, ডিটিসিএসহ ২০টি মন্ত্রণালয়ের ওপর এ শহরটি পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সেবাও এসব প্রতিষ্ঠানের হাতে। কিন্তু একাধিক অভিভাবক থাকলেও নগর প্রশাসনের কোনো একটি দিকও দেখার দায়িত্ব একা কোনো কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। ভাঙ্গা রাস্তার কারণে রিকশা উল্টে যাওয়া, গর্তে গাড়ির চাকা আটকে যাওয়ার ঘটনা, সিএনজিচালিত গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে যানবাহন চলাচল ধীর হয়ে যায়। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

শান্তিনগর থেকে মালিবাগ যাওয়ার রাস্তাটিকে রাস্তা না বলে বলতে হয় খাল। সারাটা রাস্তা জুড়ে গর্ত। গর্তের ভয়ে যানবাহনগুলোতে আইল্যান্ডের পাশ দিয়ে এক সারিতে যাতায়াত করতে দেখা গেছে। এর কারণে এই রাস্তায় বাস চলাচল কমে যায়। বিকেলে অফিস ফেরত মানুষ যানবাহন সঙ্কটে পড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে অনেককে। রামপুরা, খিলগাঁও, বাসাবো এলাকায় দুপুরে বৃষ্টি থামার পর ধীরে ধীরে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে কিছু কিছু অংশে এখনো পানি জমে যাছে। জলাবদ্ধতার কারণে যানজটও ছিল। মৌচাক, শান্তিনগর থেকে কাকরাইল মোড় পর্যন্ত জলাবদ্ধতা গত দু’দিনেও কমেনি। এ রাস্তায় গতকাল গাড়ি চলাচল কমে যায়। দুপুরের পর জলাবদ্ধতা কমলেও বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে রাস্তায়। একই অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলসংলগ্ন রাস্তার। এছাড়া রাজধানীর নতুন বাজার, বাড্ডার কিছু অংশে পানি জমে আছে।পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড, হাজারীবাগের কিছু অংশ, শুক্রাবাদ, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর, মিরপুর রোড, মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ, রামপুরা, গ্রিন রোড, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, খিলক্ষেত ও উত্তরার কয়েকটি রাস্তায় জলাবদ্ধতা একই রকম আছে।নগরবিদদের মতে, অনেক অভিভাবকের ভিড়ে অসঙ্গতির শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। ফলে একক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার হাতে নগর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব না গেলে কোনো প্রকল্প ও পরিকল্পনায়ই ঢাকাকে রক্ষা করা যাবে না। দিন দিন এ শহরটি বসবাসের জন্য অযোগ্য শহরে পরিণত হবে।

এদিকে জনদুর্ভোগ নিয়ে নাগরিকদের সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। কিন্তু নগরবাসীকে সেবা দেয়ার জন্য আইনে সিটি মেয়রকে ২৮ ধরনের কাজ নির্দিষ্ট কওে দেয়া হলেও বাস্তবে কর্তৃত্বের অভাব রয়েছে। সেবা প্রদানের জন্য মেয়রকে ৫৬টি সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে নাগরিক সেবা নিশ্চিতের সব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন কেবল সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষেও সম্ভব নয়। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে সরকারের ২০টি মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৫২টি অধিদফতর। ফলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর নগরবাসীকে নির্বাচনের পূর্বে দেয়া নানা প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছেন ঢাকার দুই মেয়র। অন্যদিকে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে উদ্ভূত নানা সমস্যা সমাধানে সম্প্রতি ‘ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এ জন্য কোরিয়ান স্যামন কর্পোরেশন ও হ্যান-এ আরবান রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশের ডেভ কনসালট্যান্টস লিমিটেড ও শেলটেক লিমিটেড যৌথভাবে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। এ সমীক্ষার ভিত্তিতে একটি খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করে রাজউক, যাতে ঢাকার বহু অভিভাবকের ভিড়ে সঙ্গতিহীন অবস্থার চিত্র উঠে এসেছে।

এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় দুটি সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ মেয়রদের হাতে নেই। আবার ঢাকার যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে একাধিক কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) শুধু গাড়ির নিবন্ধন দেয়। সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ)। আবার সড়ক দেখাশোনার দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশনের। রেল ব্যবস্থা পরিচালনা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক অভিভাবকের উপস্থিতি অথবা একক কর্তৃপক্ষের অভাবকেই ঢাকার অসামঞ্জস্য প্রবৃদ্ধি ও পরিচালনার জন্য দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজউক পরিচালিত সমীক্ষার তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এ আয়তনের মাত্র ২ দশমিক ৩১ শতাংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ঢাকার জমির শিল্পভিত্তিক ব্যবহার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ।

অর্থাৎ রাজধানীর ৪ দশমিক ১১ শতাংশ জমি শিল্প ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ঢাকায় সড়ক ও রেল অবকাঠামো রয়েছে ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ জায়গা নিয়ে। তবে মোটরযান চলার মতো বড় সড়কের উপস্থিতি বিবেচনা করলে তা ৪ শতাংশের মতো। আর উš§ুক্ত স্থান তথা বিনোদনের জন্য অবশিষ্ট এলাকা রয়েছে দশমিক ৯৬ শতাংশ। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন মেট্রোপলিটান শহরে ন্যূনতম ২৫ শতাংশ জমি বাণিজ্যিক ও শিল্প খাতে ব্যবহার হয়। আর সড়ক ও রেল অবকাঠামো থাকে ২০-৩০ শতাংশ। আর উš§ুক্ত স্থান তথা পার্ক-উদ্যান থাকে ২০-২৫ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোও মোটামুটি এ আদলেই গড়ে উঠেছে। এছাড়া রাজধানী ঢাকার বড় অংশজুড়ে শুধু আবাসিক এলাকা। ৩৭ হাজার ৫৮৪ হেক্টর তথা ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ জমি ব্যবহার হচ্ছে আবাসিক কাজে। এ ছাড়া কৃষিজমি রয়েছে ২৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ, জলাশয় ৮ দশমিক ৭৯, প্রবেশ সংরক্ষিত এলাকা ৬ দশমিক ৭৫, সরকারি পরিসেবা ৪ দশমিক ৩ ও মিশ্র ব্যবহার্য (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) এলাকা ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

অন্যদিকে ঢাকার উন্নয়নে নানা সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। বেশকিছু পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু কোনোটাই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো পরিকল্পনার বাইরে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ১৯৯৫ সালে ঢাকার জন্য স্ট্রাকচার প্ল্যান নেয়া হয়। ২০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনাটি ২০১৫ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বহু আগেই তা কার্যকারিতা হারায়। প্রায় একই সময় নেয়া হয় ১০ বছর মেয়াদি আরবান প্ল্যান। ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ মেয়াদি পরিকল্পনাটিতে ক্ষেত্র ভেদে বিশেষ পরিকল্পিত জোন গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়, যা বাস্তবায়ন হয়নি। ড্যাপ বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১০ সালে। তবে শুরুতেই ব্যাপক আকারে ভুল ধরা পড়ে এ পরিকল্পনায়। ফলে ২০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনাটি পাঁচ বছরের মাথায় সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অথচ ড্যাপের মাধ্যমে প্রথম স্ট্রাকচার প্ল্যান ও আরবান প্ল্যান বাস্তবায়নের কথা ছিল। এর বাইরে ১৯১৭ সালে ঢাকা টাউন প্ল্যান, ১৯৫৯ সালের ঢাকা মাস্টার প্ল্যান ও ১৯৮১ সালের ঢাকা ঢাকা মেট্রোপলিটান এরিয়া ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি।

ঢাকার অপরিকল্পিত উন্নয়নের অন্যতম কারণ একক নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অভাব উল্লেখ করে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, এতে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবহন পরিকল্পনার সঙ্গে নগর পরিকল্পনার সামঞ্জস্য হচ্ছে না। আবার নগর পরিকল্পনা না মেনে বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন সময় সিটি গভর্ন্যান্সের কথা বলা হয়েছে। তবে কখনো এ সংক্রান্ত উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পরিকল্পিত নগর গড়তে একক নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ তথা সিটি গভর্ন্যান্সের বিকল্প নেই বলেই মনে করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে রাজউকের চিফ টাউন প্ল্যানার ও ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রণয়ন প্রকল্পের পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকার জমির ব্যবহারে অসামঞ্জস্যের কারণ রাজধানীর জমি ব্যবহারে কখনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না নেয়া। ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও নানা জটিলতায় তা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নগরের জমি বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কৃষিজমির বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নতুন স্ট্রাকচার প্ল্যানটি পাঁচ বছর পর পর মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অবস্থা ও বাস্তবায়ন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরিকল্পনাটি সমন্বয় করা হবে।