VAT-NBR-409x230

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ অনুযায়ী এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ভ্যাট আরোপের সুযোগ নেই। শুধু তাই নয়, ২০১২ সালের ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন’ (ভ্যাট আইন) এও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের উপর ভ্যাট আরোপের বিধান করা হয়নি।বর্তমান সরকার ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২’ রহিত করে যে নতুন ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০’ প্রণয়ন করেছে তাতে ‘শিক্ষার্থী ফি’ (ছাত্র বেতন) সম্পর্কে আইনের ৪২ ধারায় বলা আছে: “প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উহার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করিবার নিমিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার মানদণ্ডে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি শিক্ষার্থী ফি কাঠামো প্রস্তত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন গ্রহণ করিবে।”

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নের উৎস সম্পর্কে আইনের ৪২ ধারায় বলা আছে: “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের উৎস হইবে নিম্নরূপ, যথা:-
(১) কোন জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিঃশর্তভাবে প্রদত্ত দান;

(২) কোন জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট, প্রতিষ্ঠান বা সরকার হইতে প্রাপ্ত ঋণ;

(৩) কোন জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান;

(৪) শিক্ষার্থী ফি;

(৫) বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়;

(৬) সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত অন্যান্য উৎস।”

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৪ ধারায় সাধারণ তহবিলের বিষয়ে বলা আছে:
(১) সংরক্ষিত তহবিল ছাড়াও, প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাধারণ তহবিল থাকিবে এবং প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উক্ত সাধারণ তহবিলে শিক্ষার্থীদের নিকট হইতে সংগৃহীত বেতন, ফি ও অন্যান্য উৎস হইতে প্রাপ্ত অর্থ জমা করিয়া উহা হইতে ব্যয় করিবে।

(৩) সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে অবহিতক্রমে সাধারণ তহবিলের অর্থ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কর্তৃক নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ করা যাইবে।

(৪) প্রত্যেক আর্থিক বৎসরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পূর্ববর্তী আর্থিক বৎসরের আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং সংরক্ষিত তহবিল ও সাধারণ তহবিলের হিসাব কমিশন ও সরকাররের নিকট প্রেরণ করিতে হইবে।

(৭) কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতিত অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাইবে না।”

আইনের ৪৪ ধারার (৭) উপ-ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতিত অন্য কোন উদ্দেশ্যে তহবিলের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। যদি ছাত্রদের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভ্যাট দিতে হয় তাহলে তা পরিশোধে আইনত বাঁধা রয়েছে।এদিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কিত দ্বিতীয় ভাগের ১৭ অনুচ্ছেদে ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা’ শিরোনামে বলা আছে:

“রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য;

(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য;

(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য;কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷”ফলে শিক্ষা হচ্ছে, সংবিধানে ঘোষিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কিত বিষয়, যা বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকারের উপর করারোপ (ভ্যাটও এক ধরনের কর) সংবিধানের লংঘণ।

Private-University-Act2-300x285

যদি ভ্যাট আইন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন দু’টি সংশোধন করে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভ্যাট প্রদানের বিধান করা হয় তাহলেও তা হবে সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদের লংঘন।‘সংবিধানের প্রাধান্য’ শীর্ষক সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে: “জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷”আইন সংশোধন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভ্যাট প্রদানের বিধান করে হলে তা হবে সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদের লংঘন এবং সংশোধিত আইনের ঐ অংশ বাতিল হবে।এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার হবে না বলে বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “ভ্যাট প্রত্যাহারের কোনো কারণ দেখি না। তিনি বলেন, ভ্যাট প্রদান করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কোনো শিক্ষার্থীকে ভ্যাট দিতে হবে না। টিউশন ফির মধ্যেই ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, নতুন করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়ের উদ্দেশ্যে ভ্যাট আরোপ করা হয়নি। ভ্যাটের জন্য আর টিউশন ফিও বাড়ানো যাবে না।”ভ্যাট নিয়ে অর্থমন্ত্রী এবং এনবিআর এর পক্ষ থেকে বিগত তিন মাসের বেশি সময় ধরে একেক সময় একে ধরনের যেসব কথা বলা হয়েছে ও হচ্ছে তার কোন আইনী ভিত্তি নেই। সর্বশেষ ‘টিউশন ফির মধ্যেই ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে’ বলে অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন তাও চরম অসত্য।‘টিউশন ফির মধ্যেই ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে’-এটা যদি সত্য হয় তাহলে কখন বা কবে তা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে? এতদিন কি তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে ঐ ভ্যাট আদায় করা হয়েছে?

প্রকৃতসত্য হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উপর ইতিপূর্বে না ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, না ভ্যাট আদায় করা হয়েছে।এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, “আমি ২৮টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছি, যারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তাদের প্রতিদিন এক হাজার টাকা খরচ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বিরাট অঙ্কের বেতন পায়। সেখানে আমি মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দাবি করছি। যারা প্রতিদিন এক হাজার টাকা খরচ করতে পারে সেখানে তারা সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে পারবে না কেন?”

মন্ত্রী বলেন, “ভ্যাট বাবদ অর্থ পরিশোধ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, কোনো ক্রমেই শিক্ষার্থীর নয়। বিদ্যমান টিউশন ফির মধ্যে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই টিউশন ফি বাড়ার কোনো সুযোগ নেই।”অর্থমন্ত্রীর উপরের বক্তব্যের প্রথম প্যারা থেকে এটা স্পষ্ট যে তিনি বলতে চেয়েছেন ‘প্রতিদিন এক হাজার টাকা খরচ’কারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকেই ভ্যাট দিতে হবে। আবার দ্বিতীয় প্যারায় বলেছেন, ভ্যাট দেয়ার দায়িত্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।