1428731624

দৈনিকবার্তা-ঠাকুরগাঁও, ২০ অক্টোবর ২০১৫: দিনটি ছিল সোমবার। তখন সময় রাত ৯টা। হঠাৎ ঘরের দরজা টক টক করে বেজে উঠে। ঘরের ভেতর আমি জানতে চায় কে? একজন জোর গলায় বলতে লাগলো আমরা পুলিশ। দরজাটা খুলে দেন। পুলিশের কথা শুনে তাৎক্ষনিক দরজা খুলে দেই। তখন ৭/৮ জন সাদা পোশাক ধারী লোক ঘরে মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারা আমার স্বামী কে ধরে থানায় নিয়ে যেতে চায়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন থানায় নিয়ে যাবেন। তখন একজন বললো তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। ৫০ হাজার টাকা দেন ওকে (স্বামী) নিয়ে যাব না। তাৎক্ষনিক ভাবে টাকা যোগার করতে না পারায় সাদা পোশাক ধারী লোকজন আমার স্বামীকে থানার কথা বলে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের লোকজন আমাকে বার বার ফোন করতে থাকে টাকা যোগার হয়েছে কি না। টাকা না দিলে মাদক ব্যবসায়ি বলে আদালতে চালান করে দিবে। ঠাকুরগাঁও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের বিরুদ্ধে এই রকম অভিযোগ করেন পৌর শহরের খালপাড়া এলাকার আসমা বেগম নামে এক গৃহবধূ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও গোয়েন্দা পুলিশের হয়রানিতে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। ডিবি পুলিশ মামলা ও ধরে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে মানুষকে হয়রানি সহ মাসোয়ারা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দীর্ঘদিন ধরে ঠাকুরগাঁও গোয়েন্দা পুলিশ প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার না করে সাধারণ মানুষদের গ্রেফতার করে বিভিন্ন প্রকার হয়রানি করছে। এছাড়ও রাতের আধারে মাদক ব্যবসায়িদের বাসায় নিজেরাও মাদক সেবন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি মাদক ব্যবসায়ী সহ জুয়ার বোড থেকে মাসোয়ার নিচ্ছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এ নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ঠাকুরগাঁও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ জেলার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার না করে উল্টো তাদের কাছ থেকে মাসোয়ার নিচ্ছে। এতে করে মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা দিব্বি চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন সদর উপজেলার ভুল্লী এলাকায় ইয়াবা ও হেরোইন ব্যবসায়ী মজিদের কাছে ১০ হাজার টাকা, পীরগঞ্জ উপজেলার শালবাগান এলাকায় জুয়ার বোডে চোখার কাছে ৪০ হাজার টাকা, একই উপজেলার সেনুয়া বাজারে ফেনসিডিল ব্যবসায়ী মামুন ও মোস্তফার কাছে ১০ হাজার টাকা, রাণীশংকৈল উপজেলার ঘুরনিয়া গ্রামের ফেনসিডিল ব্যবসায়ী রফিকুলের কাছে ৫ হাজার টাকা, একই গ্রামের ফেনসিডিল ব্যবসায়ী টেক্কার কাছে ৫ হাজার টাকা, ফেনসিডিল ব্যবসায়ী রঘুর কাছে ৫ হাজার টাকা, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় ফেনসিডিল ব্যবসায়ী মকসেদের কাছে ৫ হাজার টাকা, সদর উপজেলার ছোট বেংরোল এলাকায় ফেনসিডিল ব্যবসায়ী সাইফুলের কাছে ৫ হাজার টাকা, একই এলাকার ফেনসিডিল ব্যবসায়ী মাজেদের কাছে ৫ হাজার টাকা, শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে ট্রাক ট্যাংলরীতে জুয়ার বোডে ডাবলুর কাছে ২০ হাজার টাকা, সত্যপীর ব্রীজে জুয়ার বোডে বারেক ড্রাইভারের কাছে ১০ হাজার টাকা, সত্যপীর ব্রীজে গাজা ব্যবসায়ী মাসুদের কাছে ৫ হাজার টাকা, সত্যপীর ব্রীজে গাজা ব্যবসায়ী মাসুদের কাছে ৫ হাজার টাকা, কালিতলা এলাকায় জুয়ার বোডে মজিদের কাছে ১২ হাজার টাকা, শহরের মুন্সিপাড়ার মনঘাটি থেকে ৭ হাজার টাকা, গড়েয়ার চিহ্নিত ফেনসিডিল ও ইয়াবা ব্যবসায়ী ইব্রাহিমের কাছে ২০ হাজার টাকা, গড়েয়া হাড়িপুকুর বাজারের পাশে জুয়ার বোডে বাদলের কাছে ২০ হাজার, শহরের রোড রেল স্টেশন এলাকার গাজা ব্যবসায়ী মুসলির কাছে ৪ হাজার টাকা, রোড চিনিকল এলাকায় ফেনসিডিল ব্যবসায়ী তুলা বাবুলের কাছে ১০ হাজার টাকা, রোডের ফেনসিডিল ব্যবসায়ী সাজ্জাদের কাছে ২০ হাজার টাকা, সালন্দর চৌধুরী হাট এলাকায় গাজা ব্যবসায়ী বুড়ির কাছে ৪ হাজার টাকা সহ আরো কিছু চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা আদায় করে ঠাকুরগাঁও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

আর এই টাকা প্রতিমাসে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করে ঠাকুরগাঁও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কনেস্টবল রুহুল আমিন ও এনামুল হক। পরে এই টাকা ঠাকুরগাঁও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের এসআই আবুল বাশার, এএসআই সাইফুল ইসলাম সহ ডিবি পুলিশের কয়েকজন সদস্য ভাগাভাগি করে নেয়।অন্যদিকে গত ১৬ অক্টোবর পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে রাজু ও আসাদ নামে দুই মাদক ব্যবসায়ীকে ৩০০ পিস ইয়াবা সহ গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। অথচ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ৯৮ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে দেখিয়ে এএসআই সাইফুল বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার পীরগঞ্জ থানার মামলা নম্বর- ২২, তারিখ: ১৭.১০.২০১৫ইং।

খালপাড়া এলাকার ওই গৃহবধূ আসমা বেগম জানান, আমার স্বামী একজন অটো চালক। তিনি কোন মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত নন। অথচ পুলিশ তাকে বিনা কারণে ধরে নিয়ে যায়। ডিবি পুলিশের কনেস্টবল রুহুল আমিন আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবী করে। আমি টাকা দিতে না পারলে তারা আমার স্বামীকে মাদকের মামলা দিয়ে আদালতে চালান করে দেয়।শহরের সরকারপাড়া মহল্লার বাসিন্দা জমির উদ্দীন জানান, জেলায় মাদক ব্যবসায়ীরা বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে। এখন হাত বাড়ালেই মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। এতে করে যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

হাজীপাড়া মহল্লার রফিকুল ইসলাম জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে পুলিশের যথেষ্ট পরিমাণে ভুমিকা থাকলেও কিছু অসাধু ব্যক্তিদের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ যেসব মাদক ব্যবসায়ীদের পুলিশ আটক করে আইনের আওতায় আনবে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে যদি মাসোয়ারা নেয় তাহলে কী সম্ভব এসব ব্যবসায়ী রোধ করা।সমাজসেবক দবিরুল ইসলাম জানান, গোয়েন্দা পুলিশের এসব কার্যকলাপের কারণে জেলায় মাদকদ্রব্য বিক্রেতাদের উৎপাত বেড়ে গেছে। যদি এমন চলতে থাকে তাহলে জেলার পরিবেশ ভালো থাকবে না। তাই এসব ব্যাপারে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের মাসোয়ার আদায় করছেন এমন প্রশ্ন করা হলে কনেস্টবল রুহুল আমিন বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং বলেন, আপনাদের খবর লিখে কোন লাভ হবেনা। তাই আপনাদের যা ইচ্ছে লিখেন।ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম জানান, তিনি সবে মাত্র ঠাকুরগাঁও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে যোগ দিয়েছেন। তিনি এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না। তবে অফিসে আসলে ভাল করে কথা বলা যাবে।এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ বলেন, এ ধরনের অভিযোগ তার কাছে নেই। তবে এ ধরনের অপকর্ম গোয়েন্দা পুলিশের কোন সদস্য করে থাকলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।