photo-1446312699

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০১ নভেম্বর ২০১৫: মর্গ থেকে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের মৃতদেহ বুঝে নিয়ে তার বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, কেবল আইনের বিচারে একের পর এক হামলা বা হত্যার সমাধান হবে না। এ সংকট থেকে বাঁচতে আদর্শগত, রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন।রোববার সকালে দীপনের লাশের ময়নাতদন্তের পর দুপুরের আগে তার লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।শনিবার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়।এই প্রকাশনী থেকে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। ছেলের লাশ পাওয়ার পর দীপনের বাবা বলেন, আমি কোনো বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

তিনি বলেন, যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন এবং যারা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয় পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। জেল-ফাঁসি দিয়ে কী হবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, দেশের ভেতর যদি শুভ বুদ্ধির উদয় হয়, তাহলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।তিনি বলেন, বিচার দিয়ে আইন আদালত দিয়ে আমরা শাস্তি দিতে পারি একজনকে। কিন্তু জাতীয় উন্নতি দরকার। সেজন্য (শনিবার) যে কথা বলেছি যৌক্তিক বিবেচনা করেই বলেছি। সেটা কোনো আবেগের উত্তেজনার কথা নয়।

দীপনের বাবা বলেন, আমি শুভ বুদ্ধির জাগরণ চাই। সমাজে, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে।মামলা করার বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী মামলা করব। আমি আইন মেনে চলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথরিটি বলেছে একটা দরখাস্ত লিখে দিতে। আজ না পারলে আগামীকাল লিখে দেব।চলতি বছর চার লেখক-ব্লগার হত্যার ঘটনায় দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, ঘটনা ঘটছে। এজন্য সরকার চেষ্টা করছে রীতি অনুযায়ী।আমার কাছে মনে হয় এটা আদর্শগতভাবে, রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। তারপরে আইনগতভাবে। তা না হলে এটা সমাধান হবে না’ যোগ করেন তিনি।

এ সময় দীপনের শ্বশুর ডা. জালালুর রহমান ও বন্ধু আজিজুল ইসলাম ওয়ালি মর্গে উপস্থিত ছিলেন।ময়নাতদন্ত ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে জাগৃতি প্রকাশক-মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপনের মরদেহ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।এদিকে, জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক-মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।রোববার (০১ নভেম্বর) দুপুর ২টা ৪২ মিনিটে আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।এসময় তার পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও লেখক, প্রকাশক ও বুদ্ধিজিবীসহ নানা স্তরের মানুষজন উপস্থিত ছিলেন।এর আগে একই দিন দুপুর পৌনে ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

জানাজায় অংশ নেন ঢাবি উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ময়না তদন্ত ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে দীপনের মরদেহ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।এ সময় নিহত দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, শ্বশুর ডা. জালালুর রহমান ও বন্ধু আজিজুল ইসলাম ওয়ালি মরদেহ গ্রহণ করেন।শনিবার রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর কয়েক ঘণ্টা আগে একইদিন দুপুরে রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর অফিসে তিন প্রকাশক-লেখককে এলোপাতাড়ি কোপানোর পর গুলি করে দুর্বৃত্তরা। এদিকে, অভিজিৎ রায়ের বইয়ের এক প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপনকে উপুড় করে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন।

রোববার সকালে দীপনের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কাজী মোহাম্মদ আবু সামা বলেন, তার মাথার পেছনে ঘাড়ে তিনটি কোপের চিহ্ন রয়েছে। এর একটি ১১ ইঞ্চি দীর্ঘ ও চার ইঞ্জি গভীর।মাথার সামনে আরেকটি আঘাতের ক্ষত রয়েছে বলে ময়নাতদন্তকারী এই চিকিৎসক জানান। তিনি বলেন, দীপনকে উপুড় করে ভারী ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘাড়ে কোপানো হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। ওই জায়গায় এমন আঘাতের পর পাঁচ মিনিটের বেশি বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর লালমাটিয়ায় অভিজিৎ রায়ের বইয়ের এক প্রকাশক শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়।

এরপর বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ফয়সল আরেফিন দীপনের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়।দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ও লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দুপুর দেড়টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসে যান তার ছেলে। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে মোবাইলে কল করে সাড়া না পেয়ে বিকালে আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে দীপনের লাশ পান তিনি। দুটি হামলা কাছাকাছি সময়ে হয়েছে বলে পুলিশ ধারণা করলেও ঠিক একই সময়ে কি না- সে বিষিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আর ময়নাতদন্তের আগে রাতে লাশ হিমায়িত অবস্থায় রাখায় কতক্ষণ আগে মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ে চিকিৎসকও কোনো ধারণা পাননি।তিনি বলেন, দীপনের পাকস্থলীতে যে খাবার ছিল- সেই খাবার মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগের। অর্থাৎ দুপুরে খাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তার মৃত্যু হয় বলে মনে হচ্ছে।অভিজিৎ রায়সহ মোট চারজন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক ও ব্লগার চলতিবছর একই কায়দায় খুন হন। এর মধ্যে সিলেটের অনন্ত বিজয় দাশ ছাড়া বাকি সবার ময়নাতদন্ত ঢাকা মেডিকেলেই হয়েছে।

ডা. আবু সামা বলেন, সবগুলো আঘাতের ধরন প্রায় একই রকম। এমনকি বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান মুহ্ম্মদ খিজির খানকে হত্যার সময়ও ঘাড়ে আঘাত করা হয়েছিল। সবগুলো হত্যাকাণ্ডে ভারী ও ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছে। দেখে মনে হয়েছে আক্রমণকারীদের টার্গেট থাকে ঘাড়।এদিকে, জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে আজিজ সুপার মার্কেটের ব্যবাসায়ীরা।শনিবার বিকালে এই মার্কেটের তৃতীয় তলায় নিজের কার্যালয়ে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।এর প্রতিবাদে রোববার দুপুরে শাহবাগে মার্কেটের সামনে বিক্ষোভ শেষে টিএসসি ও কাটাবন এলাকায় মিছিল করেন ব্যবসায়ীরা।আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেট দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান নাজু বলেন, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার প্রতিবাদে রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত আজিজ সুপার মার্কেটের সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে।নিহত দীপন ওই সমিতির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

সমিতির কোষাধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এরকম হত্যাকাণ্ড চলতে থাকলে দেশে জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। আমরা দীপনের বর্বর হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এমন হত্যাকাণ্ড যেন না হয় সেজন্য প্রশাসননের সহযোগিতা চাই।ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আমরা সকল ব্যবসায়ী রাস্তায় নেমে এসেছি, আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলতে চাচ্ছি- ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারীকে হত্যা এবং শুদ্ধস্বরের কর্ণধারসহ আরও তিনজনের ওপর হামলার প্রতিবাদে সোমবার সারাদেশে আধাবেলা সব বই ও শিক্ষা উপকরণের দোকান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।আর জাগৃতির প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার ঘটনাস্থল ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের সব দোকান বন্ধ থাকবে তিন দিন।

রোববার বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশের সব বই ও শিক্ষা উপকরণের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সোমবার সকাল থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।সমিতির সভাপতি আলমগীর সিকদার লোটন বলেন, আধাবেলা দোকান বন্ধ রাখার পাশাপাশি তিন দিন শোক পালন করবেন ব্যবসায়ীরা।ঢাকাসহ সব জেলায় সমিতির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হবে। সোমবার কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে হবে মানববন্ধন। এছাড়া সব জেলা কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ ও মৌন মিছিলের মত কর্মসূচি পালন করা হবে।শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবিন আহসান বলেন, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতিসহ সবাই একযোগে এই কর্মসূচি পালন করবে।এদিকে, এ হত্যার প্রতিবাদে ঢাবিতে রাজু ভাস্কর্যেও সামনে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষক শিক্ষার্থীলেখক ও নাগরিক সমাজ ।