06-02-16-PM_56th IEB Convention-9

দৈনিকবার্তা-গাজীপুর, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী জনগণের বাহিনী। দেশের সর্ব বৃহৎ ও তৃণমূল বাহিনী হিসেবেও এর অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। জাতির প্রয়োজনে এ বাহিনীর সদস্যরা যে সাহস, সততা ও একাগ্রতার পরিচয় দিয়েছে তার জন্য আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ। জনগণের জানমালের হেফাজত করা আপনাদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে আনসার বাহিনীর সদস্যদের সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ত্ব পালন করতে হবে। সকলের সহযোগিতায় ২০২১ সালের মধ্যে আমরা একটি ক্ষুধা, দারিদ্র ও নিরক্ষরমুক্ত এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর দেশ গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্ব সভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করবো ইনশাআল্লাহ। আমি আশা করি, বিগত দিনের মতো বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে যোগ্য অংশীদার হিসেবে থাকবেন এবং সহযোগিতা করবেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার সামগ্রিক উন্নয়ন বান্ধব সরকার। দেশের সর্বত্র সড়ক ও রেল যোগাযোগের ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়েছে। দেশীয় অর্থায়নে পদ্মাসেতু এবং দেশের সর্বপ্রথম কর্ণফুলি নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণ প্রকল্প সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বাক্ষর বহন করে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ছাড়াও টঙ্গী-ভৈরব ও লাকসাম-চিংকিয়ানাস্তানা’র মধ্যে ২য় রেল লাইন স্থাপন যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছে। শীঘ্রই ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করনের কাজ শেষ হবে। এছাড়া একই রুটে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। রাজধানীর যানজট নিরসনে নতুন নতুন ফ্লাইওভার নির্মাণ ও মেট্রোরেল প্রকল্পসহ আধুনিক নগরায়নের সকল বিষয়ে সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৩১৬ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে। আমরা ১২৩ ভাগ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি করেছি। বাংলাদেশ আজ নি¤œ মধ্য আয়ের দেশ। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। গত অর্থ বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। আশা করি অচিরেই প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ৫ কোটি মানুষ নি¤œ আয়ের স্তর থেকে মধ্যম আয়ের স্তরে উন্নীত হয়েছে। আমরা দারিদ্রের হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। সরকারি ও বেসরকারিভাবে দেড় কোটি মানুষের চাকুরি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৪ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য-শষ্য উৎপাদন হয়েছে। এখন আমরা বিদেশে চাউল রফতানি করছি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৪ হাজার ৭৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১শ’ অতিক্রম করেছে।

বৃহস্পতিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুরস্থ আনসার ও ভিডিপি একাডেমীতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৩৬তম জাতীয় সমাবেশ উদ্বোধন অনুষ্ঠাণে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে সফিপুর আনসার একাডেমিতে আসেন। পরে সকাল ১১ টা ৪০ মিনিটের দিকে তিনি আনসার একাডেমির ইয়াদ আলী প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌছান। প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌছালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সচিব মোজ্জামেল হক খান এবং বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নাজিম উদ্দীন তাকে স্বাগত জানান। এসময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ উস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী খোলা জিপে চড়ে প্যারেড পরিদর্শন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনসার সদস্যদের কুচকাওয়াজ ও সালাম গ্রহণ করেন এবং ভাষণ দেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ বছরের ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রায় ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজারের বেশি বই বিনামূল্যে বিতরন করেছি। প্রাথমিক থেকে ডিগ্রী পর্যন্ত ১ কোটি ৩৮ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি ও উপ-বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হচ্ছে। মানুষ বিনামূল্যে ৩২ ধরনের ঔষধ পাচ্ছেন। ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ২শ’ ধরনের ডিজিটাল সেবা প্রদান করা হচ্ছে।

আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার আনসার বাহিনীর সদস্যদের জন্য কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে পাঁচ লাখ ও গুরুতর আহত হলে এক লাখ টাকার আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করেছে। ব্যাটালিয়ন আনসারদের পারিবারিক রেশনের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। গত বছর ৬৭২ জন মহিলা আনসার সদস্যকে স্থায়ী পদে পদায়ন করা হয়েছে। মহিলা থানা প্রশিক্ষিকাদের চাকরি স্থায়ী করা হয়েছে। এই বাহিনীর কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টার ছাড়াও বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যা এবাহিনীর গুণগত মান বহুগুণে বৃদ্ধি করে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের অধীনে এই বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন মেয়াদে মেডিকেল এসিসটেন্স হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা অংশগ্রহনকারীদের কারিগরি দক্ষতা বহুগুণে বৃদ্ধি করবে। এছাড়াও তাদের সামনে নিশ্চিত অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার দ্বার উন্মুক্ত হবে। এই বাহিনীর ৮টি রেঞ্জে এমআই রুম চালু হওয়ায় স্বাস্থ্য সেবা সুলভ হয়েছে। আমি জেনে আনন্দিত হয়েছি, ১৭২ কোটি টাকায় ১৫টি ব্যাটালিয়ন সদরদপ্তরে আধুনিক কমপ্লেক্স নির্মাণ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। আপনাদের কাজের স্বীকৃতি ও বিশেষ সম্মান প্রদর্শনে আনসার বাহিনীতে আমাদের সরকারই পদক প্রবর্তন করেছে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে আপনাদের জাতীয় পতাকা প্রদান করি। ব্যাটালিয়ন আনসারদের চাকরি ১৫ বছর পূর্ণতার সাপেক্ষে স্থায়ী করি।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৪৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আনসার বাহিনী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইতিহাসের প্রায় সকল ক্রান্তিকালে অবদান রেখেছে এই বাহিনী। এ বাহিনীর বহু সদস্য জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ওই যুদ্ধে এ বাহিনীর ৬৭০ জন শহীদ হন। আমি তাদেও রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। এছাড়াও সরকারের বিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় যে সকল আনসার ও ভিডিপি সদস্যকে আমরা হারিয়েছি তাদের পরিবার বর্গকে আমি গভীর সহমর্মিতা ও সমবেদনা জানাই।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিটি সদস্য আমাদের এ উন্নয়ন অগ্রযাত্রার অংশীদার। প্রায় ৪২ হাজার আনসার সদস্য সামগ্রিক নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর কার্যক্রম নির্বিঘœ রেখেছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যাবস্থা উন্নয়নে সম্প্রতি গঠিত বিশেষায়িত বাহিনী এভিয়েশন সিকিউরিটি-এ অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে আনসার বাহিনীর সদস্যদের বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ পেশাদারিত্বের অর্জন। পার্বত্য চট্রগ্রামের আইন শৃঙ্খলা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় অপরাপর বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ আনসার বাহিনীর প্রতিনিধিত্বশীল অংশগ্রহন রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সন্ত্রাস দমনে এবাহিনীর সদস্যরা আইন শৃঙ্খলায় সহায়তা করছেন। র‌্যাব ও স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও আনসার বাহিনীর অফিসারগণ সুনামের সঙ্গে কর্মরত আছেন।

সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনসার ও ভিডিপি বাহিনীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ বীরত্বপূর্ন ও সেবামূলকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের পদক প্রদান করেন। এর মধ্যে তিনজনকে বাংলাদেশ আনসার পদক (সাহসিকতা), সাতজনকে প্রেসিডেন্ট আনসার পদক (সাহসিকতা), একজনকে মরনোত্তর বাংলাদেশ গ্রাম প্রতিরক্ষা দল পদক (সাহসিকতা), ছয়জনকে বাংলাদেশ গ্রাম প্রতিরক্ষা দল (সেবা) পদক, ৩৭ জনকে প্রেসিডেন্ট আনসার (সেবা) পদক, ১৯ জনকে প্রেসিডেন্ট গ্রাম প্রতিরক্ষা দল (সেবা) পদক প্রদান করা হয়। এছাড়া ২০১৪-১৫ কার্যকালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও অস্ত্র উদ্ধারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রথম পুরস্কার হিসেবে ১৭ জনকে স্বর্ণপদক, দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে ২৫ জনকে রৌপ্যপদক, তৃতীয় পুরস্কার হিসেবে ২১ জনকে ব্রোঞ্জ পদক ও ৪০ জনকে বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৩৬তম জাতীয় সমাবেশের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। সমাবেশ চলাকালে প্যারেড গ্রাউন্ডের দক্ষিণ পশ্চিম পার্শ্বে আনসার ও ভিডিপি’র সদস্য-সদস্যাদের মনোজ্ঞ ডিসপ্লে প্রদর্শণ করেন। পরে তিনি দরবারে যোগ দেন।

সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনসার একাডেমীর লেকের পাশে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন ও কুটির শিল্প পরিদর্শণ করেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, ন্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নাজিম উদ্দীন, সেনা বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের উর্ধতন কর্মকর্তাগণসহ বিভিন্ন বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।